Header Ads

পরিমল বাবু আপনি কোথায় ?নিরুদ্দেশ সংবাদ দিতে হবে কি।

পরিমলবাবু, আপনি কোথায়!

প্ৰণবানন্দ দাশ

বরাক উপত্যকায় এই মুহূৰ্তে মোট চারজন সাংসদ, দু’জন মন্ত্ৰী, তেরোজন বিধায়ক৷ এই চার সাংসদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূল কংগ্ৰেসের রাজ্যসভা প্ৰতিনিধি সুস্মিতা দেবও রয়েছেন৷ যেহেতু তিনি এই উপত্যকারই কন্যা এবং তাঁর রাজনীতির শেকড় এখানকার জল-হাওয়া-মাটির সঙ্গে জড়িয়ে তাই তালিকায় তাঁকেও রাখলাম৷ স্বাধীনতার পর বরাক উপত্যকার রাজনৈতিক ইতিহাসে একসঙ্গে চার-চারজন সাংসদ আর কবে পাওয়া গিয়েছিল, বা প্ৰাপ্তিযোগ ঘটেছিল কি না, তা ঘাঁটতে ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হবে৷ আপাতত সেই পরিশ্ৰমে যাচ্ছি না৷

তাৎপৰ্যপূৰ্ণ ঘটনা হল, চার সাংসদের তিনজনই শাসক দলের ৷ করিমগঞ্জে টানা দু’বার লোকসভার সাংসদ হয়েছেন কৃপানাথ মালা৷ শিলচরের সাংসদ হয়েছেন প্ৰবীণ বিজেপি নেতা তথা রাজ্যের প্ৰাক্তন ক্যাবিনেট মন্ত্ৰী পরিমল শুক্লবৈদ্য৷ আর সদ্য রাজ্যসভায় গিয়েছেন প্ৰাক্তন কেন্দ্ৰীয়মন্ত্ৰী কবীন্দ্ৰ পুরকায়স্থের তনয় কণাদ পুরকায়স্থ৷ আপাত দৃষ্টিতে, রাজ্য সরকার ও দিল্লির সংসদে একটি জনপদের একসঙ্গে এত এত প্ৰতিনিধি পাওয়াটা রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার৷ কিন্তু বরাক উপত্যকা নামের এই অভাগা জনপদের জন্য এমন এক ‘গণতান্ত্ৰিক শক্তিশালী প্ৰতিনিধিত্ব’ আদৌ কি ভাগ্যের কোনও ফেরবদল করতে পেরেছে?

গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি দেখলে, তেমন তো মনে হয় না৷ কংগ্ৰেসের আমলে এই উপত্যকা যেমনটা উপেক্ষিত ছিল, আজও ঠিক তাই রয়ে গিয়েছে৷ উল্টে পরিস্থিতির আরও অবনতিই ঘটেছে৷ গত প্ৰায় একপক্ষকাল ধরে এই উপত্যকা কাৰ্যত অবরুদ্ধ৷ মেঘালয় ও ডিমা হাসাও দিয়ে সড়ক অনেক জায়গায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে৷ ফলে এই সড়কপথে একমাত্ৰ জীবন হাতে নিয়ে চলতে হচ্ছে৷ আর বৰ্ষার সময়ে যে রেলপথ উপত্যকা তথা পড়শি ত্ৰিপুরা, মিজোরাম, মণিপুরের একমাত্ৰ জীবনরেখা হতে পারতো, সেই রেলযাত্ৰা যেন ধসের অভিশাপ থেকে মুক্তই হতে পারছে না৷ একের পর এক ধসে এই অঞ্চলের সঙ্গে বাদবাকি দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে৷ এতে করে অবৰ্ণনীয় যন্ত্ৰণা ও ভোগান্তির মুখে পড়েছেন সাধারণ মানুষ৷

আকাশপথে গুয়াহাটি যাওয়া বা গুয়াহাটি থেকে শিলচর আসা কোনও বিলাসী বিদেশ ট্ৰিপের নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ প্ৰায়ই এই মিনিট চল্লিশের যাত্ৰার জন্য কলকাতা-দুবাইর চেয়েও বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে৷ 
এমন এক দমবন্ধ পরিস্থিতিতে আমাদের জনপ্ৰতিনিধিরা ঠিক কী করছেন৷ এর খোঁজ নিতেই আজকের এই লেখা৷ 

আজ শুরু করা যাক শিলচরের সাংসদ পরিমল শুক্লবৈদ্যকে দিয়ে৷ লোকসভায় সাংসদ হয়ে গিয়েছেন একবছর হল৷ কিন্তু এই একবছরে তিনি নিজের কেন্দ্ৰের জন্য ঠিক কী কী কাজ করেছেন? এসব নিয়ে ময়নাতদন্ত করতে গেলে, লেখাটি কয়েকপাতা গড়াবে৷ তাই আজ আর ওই প্ৰসঙ্গে যাচ্ছি না৷ শুধু গত কয়েকদিন বরাক উপত্যকা যে বেনজির অবরোধের মুখে পড়েছে, সেসময় মাননীয় সাংসদের ভূমিকা ঠিক কী, তাতে একটু নজর দেওয়া যেতে পারে৷

যোগাযোগ ব্যবস্থার এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে উপত্যকার সাধারণ মানুষের প্ৰচণ্ড ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে প্ৰতিদিন৷ কিন্তু আমাদের সাংসদকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না৷ প্ৰথমে ভেবেছিলাম, হয়তো তিনি দিল্লিতে রয়েছেন সরকারি কাজে৷ কিন্তু তাঁর ফেসবুক পেজে গত ন’দিনের কাজকৰ্মে চোখ বোলাতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, না তো, তিনি উপত্যকাতেই আছেন৷ এবং খেলা থেকে রাজনৈতিক মেলা সবকিছুতেই বেশ উৎসাহের সঙ্গে অংশ নিচ্ছেন৷

এই লেখা পড়ার পর আপনারা হয়তো মাননীয় সাংসদের ফেসবুক প্ৰোফাইলে গিয়ে একবার ঢুঁ মেরে দেখতে চাইবেন৷ সেই কষ্ট লাঘবে আমিই বলে দিচ্ছি, গত ন’দিনের তিনি ঠিক কী কী করেছেন৷ এই ন’দিনে তিনি বেশ কয়েকটি দলীয় কৰ্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন, স্বামী বিবেকানন্দের পুণ্যতিথিতে শ্ৰদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন, কয়েকটি সংগঠনের গাছের চারা রোপণের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, উল্টো রথযাত্ৰা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন, দলের এসসি মোৰ্চার সংবৰ্ধনা নিয়েছেন, শ্যামাপ্ৰসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিনে শ্ৰদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে পোস্ট দিয়েছেন সঙ্গে এ সম্পৰ্কিত পদযাত্ৰায় পা মিলিয়েছেন, চাতলায় একটি গাৰ্লস হস্টেলের শিলান্যাসে উপস্থিত ছিলেন, ব্ৰিকস শীৰ্ষ সলেনে যাওয়া প্ৰধানমন্ত্ৰী নরেন্দ্ৰ মোদিকে ব্ৰাজিলের রাষ্ট্ৰপতি লুলা ’দ সিলভা সেদেশের সৰ্বোচ্চ অসামরিক সম্মান দেওয়ার ছবি শেয়ার করেছেন এবং একটি ফুটবল টুৰ্নামন্টে পুরস্কার বিতরণ করেছেন৷

ভাবলাম, হয়তো ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার)-এ তাঁর নিজস্ব হ্যান্ডেলে কিছু পাওয়া যেতে পারে৷ না, ওখানেও সেই একই অনুষ্ঠান আর শুভেচ্ছা-শ্ৰদ্ধাঞ্জলির পোস্ট ৷ মনে হল, হয়তো সংবাদ মাধ্যমে কোনও বিবৃতি দিয়ে থাকতে পারেন৷ তন্ন তন্ন করে গত কয়েকদিনের সব খবরের কাগজ দেখলাম ৷ কোথাও কোনও বিবৃতি পেলাম না৷ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দাবা প্ৰতিযোগিতায় অতিথি হিসেবে তাঁর অংশ নেওয়ার সচিত্ৰ প্ৰতিবেদন ছাড়া৷

সত্যি বলতে কী, কিছুটা অবাক হলাম৷ শুধু অবাক হওয়াই নয়, হতাশও হলাম৷ যে উপত্যকা গত এক পক্ষকাল ধরে অবরুদ্ধ, সাধারণ মানুষ মাঝপথে ট্ৰেন বাতিল হওয়ায় নরক যন্ত্ৰণায় ভুগছেন, গুয়াহাটিতে আটকা পড়েছেন অসংখ্য মানুষ, উপত্যকার মেধাবী যুবারা সরকারি চাকরিতে ইন্টারভিউ দিতে গুয়াহাটি না যেতে পেরে জীবনের একটা বড় সুযোগ হাতছাড়া করছেন, শিলচর মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউ-এ রোগীর ভিড়, কারণ চিকিৎসকরা রেফার করলেও তাঁদের গুয়াহাটিতে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, চব্বিশ থেকে ত্ৰিশ ঘন্টায় প্ৰাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ মেঘালয় বা মহাসড়ক দিয়ে বাসে, ছোট গাড়িতে করে দ্বিগুণ অৰ্থ খরচ করে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন সেখানে আমাদের ভোটে নিৰ্বাচিত লোকসভার সাংসদ চুপ থাকতে পারেন কী করে ? কী করে তিনি এই প্ৰচণ্ড দুৰ্যোগে বিভিন্ন অনুষ্ঠাতে হাসিমুখে অংশ নিতে পারেন? দিল্লি বা দিসপুরে ছুটে গিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্ৰকের শীৰ্ষ কৰ্তাদের সঙ্গে দেখা করে উপত্যকার এই বিপৰ্যয়ের কথা জানাতে পারতেন না? নিদেনপক্ষে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে তাঁদের দৃষ্টি আকৰ্ষণ করা যেত না? মানুষের দুৰ্দশা যাতে লাঘব হয় তারজন্য জেলাশাসক বা রেল কৰ্তৃপক্ষের সঙ্গে শিলচরে একটি বৈঠক করতে পারতেন না? গ্যামন সেতুর কাজ কতটা এগোচ্ছে, আর কতদিন লাগবে, ভাঙ্গারপারে হারাং নদীর উপরে বেইলি সেতুর কাজ হচ্ছে কি না, জাটিঙ্গার কাছে সড়ক সংস্কার করে যানবাহন চলাচলের জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা করা যায় কি না,.......এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়াটা তাঁর কি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?

আমরা তাঁকে কীসের জন্য ভোট দিয়ে দিল্লিতে পাঠিয়েছি? দলীয় যেসব কৰ্মসূচিতে তিনি অংশ নিচ্ছেন তারজন্য তো দিল্লি যাওয়ার প্ৰয়োজন হয় না৷ জেলাস্তরে দলীয় সংগঠনের নেতা হলেই যথেষ্ট ৷ জানি না, তিনি ভুলে গিয়েছেন কি না, তিনি নিৰ্বাচিত সাংসদ৷ এই কেন্দ্ৰের প্ৰতি, উপত্যকার প্ৰতি তাঁর দায়বদ্ধতা রয়েছে৷ সাতষট্টি বছরের পোড়খাওয়া জনপ্ৰতিনিধিকে এটা মনে করিয়ে দেওয়াটা ঔদ্ধত্য বলেই মনে করি৷ কিন্তু এটা আমাদের দুৰ্ভাগ্য ৷  জানি না, হয়তো তিনি বলতে পারেন, এই দুৰ্যোগ নিয়ে তিনি মন্ত্ৰী, আমলাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন, চিঠি দিয়েছেন৷ কিন্তু এসব কিছুই প্ৰকাশ্যে আসেনি৷ যেখানে আজকের দিনের জনপ্ৰতিনিধিরা সামান্য নড়াচড়া করলেই সামাজিক মাধ্যমে ‘লাইভ’ করে সবাইকে জানান দেন, সেখানে এত গুরুত্বপূৰ্ণ বিষয়  শিলচরের সাংসদ গোপন রাখবেন, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না৷

পরিমলবাবুকে প্ৰশ্ন, আপনি ঠিক কোথায় রয়েছেন? মাত্ৰ একবছর হল সাংসদ হওয়ার৷ এত তাড়াতাড়ি শিলচর বা উপত্যকাকে ভুলে গেলে চলবে? আপনাকে তো ‘পোস্ট রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট’ বা ‘অবসর পরিবৰ্তী সুবিধা’ দিতে মানুষ দু’হাত উপুড় করে ভোট দেননি৷ দিয়েছিলেন এই অভাগা অঞ্চলের জন্য দিল্লি-দিসপুরে আওয়াজ হতে৷ কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে আপনি সফল না ব্যৰ্থ, তা ভেবে দেখার দায়িত্ব আপনার বিবেকের কাছেই ছেড়ে দিলাম৷ *(বার্তালিপি, ১০ জুলাই, ২০২৫)*(  সৌজন্যে বার্তা লিপি)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.