Header Ads

১৯ ৭১ সালের ১৩ জুন কয়েক হাজার নিরীহ ব্যবসায়ী সম্প্রয়াদের মানুষকে হত্যা করা হয়

১৩ জুন ১৯৭১। দিনটি ছিল রবিবার। আগের রাত থেকেই সাড়ে চারশর বেশি মাড়োয়ারি অপেক্ষমান সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনে। ট্রেনে যদি জায়গা না পাওয়া যায় সেই আশঙ্কায় আগেই হাজির হয়ে গিয়েছিলেন মাড়োয়ারিরা। ভোর পাঁচটার দিকে ট্রেন আসতেই ট্রেনের চারটি বগিতে গাদাগাদি, হুড়োহুড়ি করে উঠে পড়েন মাড়োয়ারিরা। বাক্স পেটারা আর মানুষে পূর্ণ তখন ট্রেন। অপেক্ষা কখন ট্রেন ছাড়বে। ট্রেন ছাড়ার আর কতো দেরি। অপেক্ষার তর সইছেনা তাদের। মনে একদিকে উত্তেজনা, অন্যদিকে ভয় কাটিয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার অপেক্ষা। 

অবশেষে নির্ধারিত সকাল ১০টায় ট্রেনটি ছাড়ে। ট্রেন ছাড়ার পর সব জানালা-দরজা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিলো। ট্রেনটি ধীরগতিতে দুই মাইলের মতো পথ অতিক্রম করার পর শহরের গোলাহাটের কাছে এসে থেমে যায়। সবাই আশ্চর্য হয়ে ভাবছে কী হলো, ট্রেন থেমে গেল কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি! ভয় ও শঙ্কা দেখা দিলো তাদের চোখেমুখে।

বিহারী মোল্লা কাইয়ুম খান, ইজাহার আহমেদ ও তাদের সহযোগীদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র রাজাকারদের একটি দল গোলাহাটের কাছে অপেক্ষা করছিল ট্রেনটিরই।

ট্রেন থামতেই প্রতিটি বগির দরজা খুলে ভেতরে রামদা হাতে কয়েকজন বিহারি প্রবেশ করে, বাইরে তখন ভারী আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছে। যেন একজন মাড়োয়ারিও পালাতে না পারে। শুরু হয় রামদা দিয়ে কোপানো। মুহূর্তের মধ্যেই বীভৎস আর পৈশাচিক উৎসবে মেতে ওঠে বিহারীরা। কোনো কোনো লাশকে কয়েক টুকরো করে রেললাইনের চারপাশে ছুড়ে ফেলা হয়। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় শিশুদের।

ট্রেন থেকে একের পর এক যাত্রী নামিয়ে জবাই করতে থাকে। কান্নাকাটি করা শিশুদের মায়ের কোল থেকে কেড়ে রেলের পাতে অথবা কালভার্টের পাকা শানে জোরে আছাড় দিয়ে মারা হতে থাকলো। এ দৃশ্য দেখে এক মা তার দুধের শিশুকে বুকে আঁকড়ে ধরলে মায়ের কোলেই কোপ দিয়ে শিশুটাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললো। 

মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহীদ হন ৪৪৮ জন।

ঘটনার প্রেক্ষাপট বুঝতে যেতে হবে একটু পেছনে। তখনও বাংলাদেশ হয়নি। ভারতবর্ষের মানচিত্রেও পড়েনি আঁকিবুঁকি দাগ। ব্রিটিশ আমল চলছে। সে সময়ে ব্রিটিশরা ব্যবসার সুবিধার জন্যে সৈয়দপুরে রেল কারখানা স্থাপন করেন। সে সাথে বেশ কিছু ব্যবসার উদ্যোগও নেয়া হয় এখানে। এই সময়ে বেশ কিছু মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী চলে আসেন সৈয়দপুরে। তারা পাটসহ বেশ কিছু ব্যবসার পসার সাজিয়ে বসেন এই ব-দ্বীপে।

বছরের পর বছর কেটে যায়। আস্তে আস্তে মারোয়াড়িদের একটি কমিউনিটি তৈরী হয় সৈয়দপুরে। সৈয়দপুরের যে অংশে তারা বাস করতেন, সে অংশের নাম হয়ে যায় 'মারোয়াড়ি পট্টি।' বংশপরম্পরায় সেখানেই বাস করতে থাকেন মারোয়াড়িরা।

১৯৭১-এর ৫ জুন পাকিস্তানি বাহিনী মাইকে ঘোষণা শুরু করে। ওই ঘোষণায় বলা হয়, যাঁরা হিন্দু মাড়োয়ারি তাদের নিরাপদ স্থান ভারতে পৌঁছে দেওয়া হবে। একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই ট্রেনটি ১৩ জুন সকালে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চিলাহাটি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের জলপাইগুড়িতে পৌঁছাবে। এ ঘোষণায় মাড়োয়ারিপট্টিতে স্বস্তি নেমে আসে। ১৩ জুন রেলওয়ে স্টেশনে ঠিকই আসে বিশেষ ট্রেনটি। সৈয়দপুর রেল-কারখানা থেকে ট্রেন র‌্যাকটি সকাল আটটায় স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। গাদাগাদি করে বসতে থাকেন বৃদ্ধ-যুবক, তরুণ-শিশু ও সকল পর্যায়ের নারীরা। ওই ট্রেন থেকে কমপক্ষে ২০ জন তরুণীকে নামিয়ে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের মিলিটারি জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে।

ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে কোনোরকমে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান প্রায় ১০ জন যুবক। তারা ট্রেন থেকে নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে দিনাজপুর হয়ে ভারতে পালিয়ে যান।

সেদিন পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে একজন নিঝু কুমার আগরওয়াল। ৬৫ বছর বয়সী নিঝু অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও বাবা ও বড় ভাইসহ পরিবারের নয় জনকে পাকিস্তানি ও রাজাকাররা হত্যা করেছিল।

তিনি বলেন, ‘১২ জুন বিকেলে সৈয়দপুর সেনানিবাসের দুজন আমাদের রেলস্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন। তারা বলেছিলেন, দ্রুত যেতে হবে। কারণ দেরি করলে ট্রেনের বগিতে জায়গা পাওয়া যাবে না।’

স্টেশনে পৌঁছানোর পরপরই সাদা পোশাকে সেনাবাহিনীর সদস্য ও বিহারিরা ট্রেনের বগিগুলোতে সবাইকে উঠিয়ে দেয়।
নিঝু আরও বলেন, ‘সেদিন ট্রেন ছাড়ার আগেই প্রায় ২০ জন মাড়োয়ারি তরুণীকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাদের সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের অভিভাবকদের তখন কিছুই করার ছিল না, নিজের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা ছাড়া।’

সেদিন বেঁচে যাওয়া তপন চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ১৩ জুন পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের কথায় সরল বিশ্বাসে ট্রেনে উঠেছিলেন। কিন্তু শহর থেকে বেরিয়ে রেলওয়ে কারখানা পার হয়ে গোলাহাটে হঠাৎ থেমে যায় ট্রেনটি। বন্ধ জানালা একটু ফাঁক করতেই বুক ধড়ফড় করে ওঠে। বাইরে রাইফেল হাতে সারি সারি সেনা। সঙ্গে চকচকে রামদা হাতে তাদের দোসর বিহারিরা।

তিনি আরও বলেন, থেমে থাকা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ঢুকেই চিৎকার করে পাকিস্তানি সেনারা উর্দু বলতে থাকে, ‘একজন করে নেমে আসো। তোমাদের সবাইকে মেরে ফেলব, কিন্তু দামি গুলি খরচ করা হবে না। সবাইকে এক কোপে বলি দেওয়া হবে। তারপরই শুরু হয়ে যায় বেপরোয়া সেই হত্যাযজ্ঞ।

শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবাইকে কোপাতে থাকে তারা, এমন বিভীষিকাময় স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, বাইরে যাদের কোপানো হচ্ছিল, তাদের চিৎকার শুনে অনেকে ট্রেন থেকে নামতে চায় না। তখন ওরা ভেতরে ঢুকে কোপ শুরু করে। তখন আমি একটি জানালা খুলতে পেরে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে বাঁচি।

প্রাণে বেঁচে যাওয়া বিনোদ আগরওয়াল জানান, কুপিয়ে হত্যার এই বীভৎসতা চোখের সামনে দেখে কয়েকজন তাদের গুলি করে হত্যা করার জন্য অনুরোধ করেছিল। বিহারি ও রাজাকাররা উত্তরে বলেছিল, তোদের জন্য পাকিস্তানের দামি গুলি খরচ করা হবে না। তাদেরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।’

বিনোদ বলেন, ‘রেললাইনের দুই পাশে এক বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে হাঁটু সমান গর্তে মরদেহগুলো ফেলে দেওয়া হয়। শিয়াল, কুকুর, শকুনে টেনেহিঁচড়ে তা খায়।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গণহত্যার সময় হত্যাকারীরা ‘খরচাখাতা, খরচাখাতা’ বলে চিৎকার করছিলেন। ‘অপারেশন খরচাখাতা’ ছিল পাকিস্তানি সেনা, বিহারি ও রাজাকারদের পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নাম।

খরচের খাতায় পাঠিয়ে দেওয়ার নীল নকশা করেছিল পাকিস্তান সরকার৷ তাদের প্রত্যক্ষ মদতদাতা হিসেবে রাম দা নিয়ে গণহত্যায় সামিল হয় স্থানীয় উর্দুভাষী ‘বিহারি মুসলিম’ সম্প্রদায়৷

রাত ন'টা নাগাদ যাত্রীশূন্য ট্রেন সৈয়দপুর ফিরে এলে, রক্তেভেজা বগিগুলো দ্রুত ধুয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে শেষ হয় “অপারেশন খরচাখাতা”।

অনেকের মতে, এই গণহত্যায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেলেও সরকারি হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে মাত্র ৪৪৮ জন শহীদ মাড়োয়াড়ির নাম। বাকিরা হয়ে গেছেন বেমালুম হাওয়া। গণহত্যার এই স্থানটিকে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ এর জন্যে কোনো সরকারই সেরকম কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেন নি। সামাজিক কিছু সংস্থা আর স্থানীয় প্রশাসন মিলে একটা স্মৃতিসৌধ বানালেও, তা শুধু বানানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.