আমার বাবা স্কুল মাস্টার
আমার বাবা।
স্কুলমাস্টার জাফর আলী সরকারের ছেলে জনাব আলী সরকার, জনাব আলী সরকারের ছেলে ডাঃ মোঃ রজব আলী। জন্মেছিলেন মাদারিনগর গ্রামে, ময়মনসিংহের নান্দাইলে।
চন্ডিপাশা স্কুলের সেরা ছাত্র ময়মনসিংহ শহরে এসে লিটন মেডিক্যাল স্কুলে পড়লেন। সেখানেও তিনি সেরা। হলেন এল এম এফ ডাক্তার। প্রথম চাকরিঃ লিটন মেডিক্যাল স্কুলের এনাটমির শিক্ষক। তারপর দেশে এলো এম বি বি এসের সিস্টেম। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে কন্ডেন্সড পরীক্ষা দিয়ে হলেন এম বি বি এস ডাক্তার। চাকরি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে, এনাটমির শিক্ষক।
এরপর কিছুকাল দেশের নানা সরকারি হাসপাতালে বদলি হয়েছেন। পাবনা সেন্ট্রাল জেলের ডাক্তার ছিলেন। ঠাকুরগাঁওয়ে ছিলেন। ঈশ্বরগঞ্জে ছিলেন। ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ছিলেন। এরপর আরও উচ্চস্তরের ডাক্তারি বিদ্যে অর্জন করলেন, আরও পরীক্ষা দিলেন, আরও ডিগ্রি নিলেন। হলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের জুরিসপ্রুডেন্স বা ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক। কিছুকাল ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ এবং মিটফোর্ড হাসপাতালে জুরিসপ্রুডেন্সের অধ্যাপক হিসেবে চাকরি করেছেন। ফিরে এসেছেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের জুরিসপ্রুডেন্সের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট হয়ে। অবসর গ্রহণ করেছেন ওই কলেজ থেকেই।
শহরের নতুন বাজার এলাকায় আরোগ্য বিতান নামে তাঁর ছিল ফার্মেসি, এবং চেম্বার। অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রাইভেট প্র্যাক্টিশানার ছিলেন। গরিব রোগীদের চিকিৎসা বিনে পয়সায় করতেন।
ছিলেন প্রায় ছ'ফুট লম্বা, অত্যন্ত সুদর্শন। তাঁর স্ত্রীর নাম ঈদুল ওয়ারা। চার সন্তান তাঁদের। ময়মনসিংহ শহরের টি এন রায় রোডে ছিল গাছপালা ঘেরা তাঁর নিজের বাড়ি, 'অবকাশ' নাম। নামটি তিনিই রেখেছিলেন। যখন লোকেরা তাঁদের বাড়ির নাম রাখতেন ''আখন্দ লজ'', ''সৈয়দ ভিলা'', ''হোসেন কুটির'' , বাবা নাম রেখেছেন ''অবকাশ''।
ব্যক্তিজীবনে সৎ, নিষ্ঠ, আদর্শবান এবং কর্মঠ ছিলেন। বিশ্বাস করতেন কষ্ট করিলে কেষ্ট মেলে। বিশ্বাস করতেন ছাত্রানাং অধ্যয়নাং তপঃ। কিছুকাল এও বিশ্বাস করতেন, না পিটাইলে সন্তান মানুষ হয় না। সন্তানদের সুশিক্ষিত করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
মৃত্যু হয়েছে বারডেমে, সেপটিসেমিয়ায়, প্রথমবার ডায়ালাইসিস করার সময় ।
ভূত প্রেতে, দোযখ বেহেস্তে, আল্লাহ রসুলে বিশ্বাস ছিল না। নামাজ পড়তে জানতেন না। নামাজের সুরা জানতেন না। কোরান পড়তে জানতেন না। জানতে চাইতেনও না। ধর্ম পালন করার উপদেশ কখনও সন্তানদের দেননি, উপদেশ দিতেন বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার, যুক্তিবাদী হওয়ার। বিশ্বাসে নয়, কালচারে তিনি মুসলমান ছিলেন। বছরে দুটো ঈদ সামাজিক উৎসব হিসেবে পালন করতেন। চিরকাল প্যান্ট সার্ট টাই পরা মানুষ ঈদের দিনই শুধু পাজামা পাঞ্জাবি পরতেন। সকালে ঈদগাহ মাঠের নামাজে গিয়ে উঠবস করে আসতেন। অগুণতি চেনা-পরিচিত লোক আর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হতো, কোলাকুলি হতো। বাড়িতে সন্তানদের সঙ্গে সেমাই জরদা পোলাও মাংস খেয়ে তিনি ঈদের বিকেলটা ঘুমোতেন। সারা বছরে ঈদের দুটো ছুটিতেই কাজ-পাগল মানুষটির খানিকটা বিশ্রাম হতো।








কোন মন্তব্য নেই