Header Ads

কলকাতার যীশু পথে ঘাটে

তিন নম্বর লাঞ্চবক্স

কলকাতার গড়িয়াহাট মোড়। রোদের তেজে কাঁচের গাড়ির জানালাগুলোওও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাতাসে প্রবল রোদের তাপ । ফ্লাইওভারের ওপর জ্যামে থেমে থাকা গাড়িগুলোর মাঝে একজোড়া পায়ের শব্দ যেন ছুটে বেড়াচ্ছে।

জয়নাল, দশ বছর বয়স। মা নেই, বাবা নেশাগ্রস্ত। রাত কাটে গড়িয়াহাটের ফুটপাতে। সকালে চায়ের দোকানে বাসন মাজে, দুপুরে রাস্তায় গাড়ির জানালায় টোকা দেয়।

“কাকু, একটু ভাত দিন না... আজ অনেকক্ষণ কিছু খাইনি।”

গাড়ির যাত্রীরা জানালাগুলোর কাঁচ তুলে দিল প্রায় সবাই, কিন্তু একটা গাড়ির ভেতর থেকে এক জোড়া চোখ চেয়ে ছিল ছেলেটির দিকে।

অর্ণব সেন, পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই, এক বহুজাতিক সংস্থার ম্যানেজার। নিয়মিত অফিসের পথে এই  পথ দিয়ে যান। ব্যস্ত, হিসেবি, আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত একজন মানুষ,তবু ওই ছেলেটির চোখে সেদিন তিনি কী যেন এক অদ্ভুত কিছু দেখলেন।

হয়তো নিজের ছোটবেলার প্রতিচ্ছবি। অর্ণবের নিজের ছোটবেলায়, এক দিন সকালে যখন তাঁর মা কোথাও গিয়েছিলেন জরুরী কাজে , দুপুরে বাড়ি ফিরতে পারেননি , সেদিন দুপুরে রান্না হয়নি, সেদিনই তিনি বুঝেছিলেন "খিদের মুখ" ঠিক কেমন হয়।

গাড়ির পিছনের আসন থেকে বের করলেন তাঁর বাড়ি থেকে আনা তাজা,গরম লাঞ্চবক্স। আজকে তাঁর অফিস লাঞ্চ ছিল,ভাত, মুগ ডাল, পনির আর বেগুন ভাজা।
অর্ণব তাঁর গাড়ির জানালা খুলে বললেন, “নাও, খাও। আজ এই খাবারটা তোমার প্রাপ্য।”

জয়নাল থমকে গেল। খাবারটা নিয়ে সে  রাস্তার পাশে বসে পড়ল। একবারে খেল না ,ধীরে ধীরে, যত্ন নিয়ে খেতে লাগল, যেন কোনও উৎসবের প্রসাদ।

অর্ণব অফিসে গিয়ে কাজ শুরু করছিলেন ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই যেন আজ তাঁর কাজে মন বসছিল না। একটা ছোটো ছেলে, তার শরীরে অপুষ্টির ছাপ, কিন্তু মুখে বিস্ময় আর কৃতজ্ঞতা মিশ্রিত সেই হাসিটা কিছুতেই তিনি যেন ভুলতে পারছিলেন না।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলেন। তার স্ত্রী অনুষ্কা সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন এক সময়, কিন্তু পরে চাকরি-সংসার-সন্তানের পড়াশোনার চাপ সামলাতে সেই সব ছেড়ে দিয়েছিলেন।

সেই রাতেই অর্ণব বললেন,
“অনু, ভাবছি... যদি প্রতিদিন আমরা কিছুটা অতিরিক্ত খাবার বানাই, একটা লাঞ্চবক্স, ওই রকম কোনো ক্ষুধার্তের জন্য?”

অনুষ্কা থেমে গেলেন। তারপর বললেন, “তাহলে নামটা রাখো 'তিন নম্বর লাঞ্চবক্স’। দুটো তো আমরা খাই। তৃতীয়টা সেই ‘অচেনা’র জন্য।”

সেই নামেই শুরু হল তাঁদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

প্রথমে অর্ণব ও অনুষ্কার উদ্যোগে প্রতিবেশীদের অনুরোধ করা হল,যদি কেউ তাঁদের বাড়িতে তৈরি এক বেলার খাবার দিয়ে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ পোস্ট করা হল,

“প্রতিদিন একটি লাঞ্চবক্স,একটি অনাহারী পেটের জন্য। আসুন, আমরা তিন নম্বর লাঞ্চবক্স তৈরি করি।”

প্রথমে পাঁচটা, তারপর দশটা, একমাসের মধ্যেই প্রায় তিরিশটি পরিবার এতে অংশগ্রহণ করল।

অনুষ্কা দুজন কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েকে সাথে নিয়ে খাবারগুলো রুটম্যাপ করে রোজ বিলি করতে লাগলেন,গড়িয়াহাট মোড়, বালিগঞ্জ ফ্লাইওভার, রাসবিহারী, পার্ক সার্কাস।

বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন ক্ষুধার্তের সাথে দেখা হয়। কেউ রেলস্টেশনের পাশে ঘুমোয়, কেউ ফুটপাথে।
তারা প্রায় সবাই পায় , যতক্ষণ না শেষ হয় ,সেই “তৃতীয় লাঞ্চবক্স” ,তাজা, গরম, ভালোবাসায় ভরা।

তিন মাস কেটে গেল। এক সকালে গড়িয়াহাট মোড়ে আবার দেখা অর্ণবের ,সেই ছেলেটার সাথে,জয়নাল। কিন্তু তখন সে আর ভিক্ষে করছিল না।

তখন সে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার পাশে এক ছোট এনজিওর গেটে। স্কুলব্যাগ পিঠে, জলের বোতল হাতে। একজন স্বেচ্ছাসেবক তাকে বলছে, 'জয়নাল, গেটে দাঁড়িয়ে আছ কেন ? পা চালাও তাড়াতাড়ি, ক্লাসে যাও।”

অর্ণব রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে নামলেন। অর্ণব নিজে পরিচয় দিলে ,স্বেচ্ছাসেবক ভদ্রলোক হেসে বললেন, “এই ছেলেটা রোজ আসে, সঠিক সময়ে আসে, একটুও গাফিলতি করে না। একটা জিনিস দেখেছি ওদের ক্ষিদে কমলে পড়াশোনার ইচ্ছেটা জেগে ওঠে। আর হ্যাঁ,ও কাল ক্লাসে একটা  গল্প বলছিল,'তিন নম্বর লাঞ্চবক্স' নামে! মনে হয় আপনাদের এই প্রকল্পটা নিয়ে।

বিশ্ব ক্ষুধা দিবস উপলক্ষে শহরের এক অনুষ্ঠানে “তিন নম্বর লাঞ্চবক্স” প্রকল্পকে সংবর্ধনা দেওয়া হল।

অর্ণব মঞ্চে উঠে বলেন,

“আমরা ছেলেবেলায় শিখেছিলাম, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’
আজ এই শহরে বহু শিশুর কাছে শুধু একটু গরম ভাত, একটুখানি ডাল -তরকারিই ঈশ্বর।
একটি অতিরিক্ত লাঞ্চবক্স, একটু ভালোবাসা, একটি ভরা পেট,এই নিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের মানবিক প্রচেষ্টা," তিন নম্বর লাঞ্চ বক্স।”

এর কয়েক বছর পর জয়নাল তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। 

সেসময় সে এই রকম এক ক্ষুধা দিবসের অনুষ্ঠানে, মঞ্চে উঠে তৃপ্ত মুখে বলল,

“তিন নম্বর লাঞ্চবক্সটা আমার কাছে শুধু খাবার ছিল না, ওটা ছিল আমার কাছে সত্যিকারের ভালোবাসা।”

আর অর্ণব ও অনুষ্কা এই 'কবছরে বুঝে গেছেন,মানুষের জীবন বদলাতে কেবল মুখের কথা আর ক্ষুধা দিবস উদযাপন বা অনুষ্ঠানই শুধু নয়, ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে কিছু খাবার তুলে দিতে পারাটাই সত্যিকারের কাজের কাজ।

-কলমে কাজল 

২৮শে মে,২৫

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.