পশ্চিম বঙ্গে ভালো ট্যুরিস্ট স্পট আছে ট্যুরিস্ট গাইড নেই
'দিশাদা'-র বৃত্তেই আটকে বাঙালির ভ্রমণ
দেবদূত ঘোষঠাকুর
সোনার কেল্লা ছবির জন্য সত্যজিৎ রায় যে রাজস্থানের জয়সলমেঢ় শহরকে বেছে নিয়েছিলেন তা তামাম বাঙালির জানা। কিন্তু যদি হীরক রাজার দেশের শুটিং স্পটের নাম জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে সঠিক জবাব ক'টি মিলবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে যথেষ্টই।
জয়সলমেঢ় ভারতের অন্যতম পর্যটন স্থল। সত্যজিৎ বাবুর জন্য নয়, আসলে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু 'হীরক রাজার দেশ' টি যে কোথায় এবং তার যে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেই, তা রাজ্য পর্যটন দফতরের প্রচার পুস্তিকায় কিন্তু খুঁজে পাবেন না। তাই আমরা বলতেই পারিনা ওই শুটিং স্পটের নাম। আমি ই তাহলে বলে দিচ্ছি। রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। জেলা পুরুলিয়া। থানা রঘুনাথপুর। শহরের উপকন্ঠে দাঁড়িয়ে আছে জয়চণ্ডী পাহাড়। ‘হীরক রাজার দেশে’-র শ্যুটিং স্পট। আমরা জানলাম কি জানলাম না সেটা বড় কথা নয়। জয়চণ্ডী পাহাড়কে স্থানীয় মানুষ কিন্তু চেনেন ‘হীরক রাজার দেশে’-র নামেই।
এক সময় রঘুনাথপুর কে বেছে নেওয়া হয়েছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের 'হাব' তৈরির জন্য। কিন্তু শিল্প আসেনি। তাতে হাল ছাড়েননি স্থানীয় মানুষদের কেউ কেউ। জয়চন্ডী পাহাড় পর্যটন উৎসবের শুরু ওই উৎসব কমিটির প্রচেষ্টায় কিন্তু সরকারের তরফে তেমন উৎসাহ না থাকায় শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলার ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনা 'হীরক রাজার দেশ'। এক উৎসব উদ্যোক্তার ক্ষোভ , রাজ্য সরকারের নজর শুধু দিঘা, দার্জিলিং আর শান্তিনিকেতনের দিকে। সুয়োরানি ওই তিন পর্যটন কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে কংক্রিটের জঙ্গল
যখন ঘন হচ্ছে , তখন সম্ভাবনাময় তকমা নিয়েই দিন কাটছে জয়চন্ডী পাহাড়ের।
অনেকে রসিকতা করে বলেন, মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রিয় ছুটি কাটানোর জায়গা 'দিপুদা'। দিঘা-পুরী-দার্জিলিঙ'। মধ্যিখানে 'মহরানি' হয়ে বিরাজ করছে ওড়িশার পুরী। এই জায়গাটা কি বাংলার কাউকে দেওয়া গেলনা! যদি শুধু পশ্চিমবঙ্গ কে নিয়ে উত্তর খুঁজতে বলা হলে এক বেসরকারি পর্যটন সংস্থার এক পদস্থ কর্তা এক গাল হেসে বললেন, 'মাঝখানে 'পু'-য়ের জায়গায় একমাত্র ঢুকতে পারে 'শা', অর্থাৎ কী না কবিগুরুর শান্তিনিকেতন। তাই থেকেই 'দিশাদা'। '
দার্জিলিং বলতে কিন্তু শুধু পাহাড় নয়। হিমালয় এবং তার পাদদেশের চিরহরিৎ অরণ্য। যাকে আমরা ডুয়ার্স
বলে জানি। আমাদের ছোটবেলায় অবশ্য উত্তরবঙ্গে বেড়াতে যাবো বললেই আমাদের টাইগার হিল থেকে সুর্যোদয়, টয় ট্রেন-বাতাসিয়া লুপ আর পাহাড়ের থাকে থাকে থাকা সবুজ চা বাগানের কথা মনে পড়ে যেতো। তখন ডুয়ার্সের জঙ্গলের সাফারির প্রচলন ছিল কী না জানতাম না । জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়িতে কোনও বিয়ের নেমত্তন্ন থাকলে বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিতেন বাবা। টিনের ট্রাঙ্কে গরম জামা-কাপড় ভরা হত। বুঝে যেতাম বিয়ের নেমত্তন্নের সঙ্গে দার্জিলিং ফাউ। এখন তো দার্জিলিং পাহাড়ে হোটেল, রিসর্ট, হোম স্টের ছড়াছড়ি। আর ডুয়ার্সেও নদী এবং জঙ্গলের ধারে দু'পা অন্তর অন্তর বেসরকারি লজ আর রিসর্টের দাপাদাপি। অন্য শিল্প না হোক, পর্যটন শিল্পে যে লগ্নি বেড়েছে তার উদাহরণ রয়েছে চোখের সামনেই। তবে বছরে ১২ মাস কিন্তু সমান সংখ্যক পর্যটক আসেনা ডুয়ার্স আর দার্জিলিং পাহাড়ে।
ছোটো বেলায় আমরা জানতাম সমুদ্র মানে পুরী। আমার মনে আছে শীতের ছুটি কিংবা গরমের ছুটি পড়ার কয়েকদিন আগে থেকেই আমাদের বাধাছাঁদার
কাজ শুরু হয়ে যেত। পেল্লাই সাইজের জনা তিনেক হোল্ডল। তার মধ্যে যাবতীয় জিনিস। দুটি বড় বড় স্টিলের ট্রাঙ্ক। আমরা তিন ভাই বোন বাবা,মা ছাড়া ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, ছোটো পিসি, টাঙ্গাইল থেকে ঠাকুরদার সঙ্গে এদেশে চলে আসা শ্যামাপদ জ্যেঠু, কালী পিসি- সে এক পল্টন। পুরী, কাশী, গয়া ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আর দিন পনেরোর জন্য ভাড়া ভাড়া নেওয়া হত। পুরীতে স্বর্গ দ্বারে ওই ভাড়া বাড়িটা লায়েক হয়ে ওঠার পরে অনেকবার খুঁজেছি। হোটেল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি।
তবে আরও দুঃখ লাগে দিঘার অবস্থা দেখে। তরুণ বয়সে পিন্টু ভট্টাচার্যের গলায় 'চলোনা দিঘার সৈকত ধরে, ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায়, শুরু হোক পথ চলা'- গানটা শুনে দিঘার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। বাবা মায়ের সঙ্গে কখনও দিঘা গিয়েছি বলে মনে পড়েনা। কলেজের কয়েকজন বন্ধু একবার দিঘা গিয়েছিলাম। এক রাত ছিলাম। তখন নিউ দিঘা হয়নি। সেই জায়গায় তখনও ছিল ঝাউবন। দিঘায় এখন আর ঝাউবন নেই।
সেখানে হোটেলের পর হোটেল। কয়েক ছটাক জমি পেলেই হল। সেখানে দিয়াশলাই বাক্সের মতো হোটেল হয়েছে। নেই সেই বালিয়ারি আর সমুদ্র সৈকতও। পাথরের বোল্ডারের উপর শুধু কালো কালো মাথা। বালায়ারি না থাকায় সমুদ্র এখানে বাধাহীন। বোল্ডারের উপর থেকে মানুষ টেনে নিয়ে যায় অবলীলায়। ঝাউবন হারিয়ে, বালিয়ারি হারিয়ে দিঘা যেন উলঙ্গ রাজা'। সমুদ্র যেন গিলে খেতে আসছে। ।
নিউ দিঘা এলাকার পুরনো বাসিন্দা বলছেন, 'এখন কোনও ঘূর্ণিঝড় আসবে শুনলেই বুক কেঁপে ওঠে। সমুদ্র আর লোকালয়ের মধ্যে কেবল মাথা উঁচু করে থাকা হোটেলগুলি।' ওই প্রবীণ মানুষটি চান, 'শুধু দিঘার পিছনে অহেতুক টাকা খরচ না করে , অন্য সমুদ্র সৈকত গুলিকে 'পর্যটক ' বন্ধু করে গড়ে তোলা হোক।' রেলপথে জুড়ে যাওয়ায় দিঘায় এখন দুপুরে পৌঁছে রাতের মধ্যেই কলকাতা ফিরে যাওয়া সম্ভব। কাজের প্রয়োজনে এক রাতে দিঘার উপর দিয়ে ফিরছিলাম। তখন মধ্যরাত। জ্যোৎস্না স্নাত দিঘার রাস্তায় পিলপিল করছে মানুষ। হোটেলে জায়গা নেই, সমুদ্রের ধারে পুলিশ যেতে দিচ্ছেনা। নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় বসে, দাঁড়িয়ে মানুষ। সকালের জন্য অপেক্ষা করছেন সবাই।
দিঘার উপরে চাপ কমাতে তৈরি হয়েছিল শঙ্করপুর, মন্দারমণি আর তাজপুর সৈকত পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু পরিবেশ আইনের গেরোয় পড়ে মন্দারমণি আর তাজপুরের হাঁসফাঁস দশা। শঙ্করপুরকেও সেভাবে পর্যটকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়নি। যতো উন্নয়ন হয়েছে দিঘাকে ঘিরে। শঙ্করপুরে হোটেলগুলি যখন মাছি মারছে তখন বছরে ৯০ লক্ষ টাকায় লিজ দেওয়া হচ্ছে দিঘার হোটেল। সারা বছর পর্যটকের ভার সামলাতে এতো নির্মাণ কাজ হচ্ছে দিঘায় চারদিকে যে সৈকত শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দিঘার সমুদ্র এখন সারা বছর ধরেই ফুঁসছে। কবে যে সে বোল্ডারের বেড়াকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে কে বলতে পারে!
দিঘার মতোই এখন ক্লান্ত মনে হয় কবিগুরুর শান্তিনিকেতন কেও। দিঘায় যেমন ঝাউবন অস্তিত্ব হারিয়েছে, শান্তিনিকেতনে তেমনই ছাতিম, কৃষ্ণচুড়া, পলাশ, শিমুলেরা সঙ্কটে। দিঘা আর শান্তিনিকেতনের আবহাওয়া দু'রকম। গরমে তাপমাত্রা ৪২-৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠে যায় বোলপুরের। শীতে নেমে যায় ৫-৬ ডিগ্রিতে। গাছপালা কেটে হোটেল রিসর্ট গজিয়ে ওঠায় এখন আর বসন্ত তেমন মনোরম নয় শান্তিনিকেতনে। তবুও পর্যটকের বিরাম নেই। ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের রোদ মাথায় নিয়ে মানুষ ভরা গ্রীষ্মে হোটেল খুঁজে চলেছেন প্রান্তিক, শ্যামবাটি, গোয়ালপাড়া, শ্রী নিকেতন, তালতোড়ে। ওই সব এলাকার শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এখন অতীত। প্রান্তিক - সাঁইথিয়া সড়কে রেল লাইনের পাশে নীচু জমিতে পর্যন্ত রিসর্ট তৈরির ধুম পড়েছে। আগে যে পরিমাণ বৃষ্টি শান্তিনিকেতনে হতো এখন তা আর হয়না। না হলে রেল লাইনের ধারের নীচু জমিতে বর্ষার দুই মাস কোমর জল জমে থাকতে দেখেছি এই সেদিনও। আর পুরো এই উন্নয়ন চলেছে চাষের জমি বিসর্জন দিয়ে। জমি বেচে হাতে দুই পয়সা আসছে বটে, কিন্তু বোলপুর লাগোয়া গ্রামীণ এলাকার প্রবীণেরা এসবের মধ্যে বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁদের একজনের আক্ষেপ, 'আজকাল আর তেমন বৃষ্টি হচ্ছেনা। ফসল হচ্ছেনা। তাই চাষের বিক্রি হচ্ছে হু হু করে। বিপদ কেউ বুঝতে পারছেনা।'
এক সাংবাদিক শান্তিনিকেতনের ১২ কিলোমিটার দূরে অনেকটা পরিত্যক্ত জমি কিনে অবসরের পরে সেখানে একটি বাড়ি বানিয়েছেন। পুকুর কাটিয়েছেন। কাঁটা ঝোপের জঙ্গলকে সবুজে পরিবর্তন করিয়েছেন। দো'তলার বারান্দায় বসে সামনের রাঙা মাটির পথ দেখতে দেখতে, পাখির গান শুনতে শুনতে, বাগানের পরিচর্যা করতে করতে কেটে যাচ্ছিল সময়। কিন্তু গত দু'-তিন বছরে আশপাশের গ্রামগুলিতে এক দপ্তরে প্রচুর জমি বিক্রি হওয়ার কথা শুনেছেন। বড় বড় গাছ কেটে জমি সমান করা হবে। রিসর্ট হবে সেখানে। রাঙা মাটির পথ প্রথমে কংক্রিট হয়েছে। তার পরে পিচ। ওই সাংবাদিক প্রমাদ গুনছেন, 'শান্তি নিকেতনের 'অশান্তি' এখানেও এলো বলে!'
উত্তরবঙ্গে কিন্তু দিঘা এবং শান্তিনিকেতনের সেই আগ্রাসী উন্নয়নে কিছুটা রাশ টেনেছে পরিবেশ আইনের বিধিনিষেধ। ডুয়ার্সের হাতির করিডর আর পাহাড়ে ধস নামার প্রবণতা রুখতে আইন কড়া ভাবে কার্যকর করার চেষ্ট হওয়ায় সেখানে আগ্রাসন অনেকটা সীমিত। পর্যটক টানতে চা বাগানের উদ্বৃত্ত জমি এবার লক্ষ্য রাজ্য সরকারের। উত্তরে এখনও পর্যন্ত শান্তি অনেকটাই বিরাজমান। যাঁরা দিঘা, শান্তিনিকেতন বা উত্তরের পাহাড় আর জঙ্গলে বেড়াতে যান তাঁদের মানসিকতার মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। দিঘায় হুল্লোড় বাজ পর্যটকের সংখ্যা বেশি। কম বয়সীদের ভিড় সেখানে অনেক বেশি। খরচের দিক থেকে শান্তিনিকেতন অনেক সাশ্রয়ী। পারিবারিক ভ্রমণে বিশেষ করে দু'তিন দিনের ছুটিতে শান্তিনিকেতন ডুয়ার্সকে পিছনে ফেলে দেবে।
তবে শান্তিনিকেতন, দার্জিলিং, দিঘা যে যার থাক, প্রয়োজন আরও কিছু পর্যটন কেন্দ্রকে এই স্তরে। আমার এই দেশের , এই বাংলার বহু মানুষ মিশর, জেরুজালেম, আজারবাইজান যান ইতিহাসকে কাছ থেকে দেখতে। অথচ আমাদের রাজ্যে ঐতিহাসিক স্থানের কোনও অভাব নেই। কোচবিহার, গৌড়, বিষ্ণুপুর , মুর্শিদাবাদ, চন্দননগর , নবদ্বীপ আমাদের ডাকছে। রাজ্য জুড়ে কতযে মন্দির আছে যেগুলি ইতিহাসের সাক্ষী। ভাগিরথী ও তার শাখা নদীর দুই ধার বহন করছে ইতিহাসের নানা পট পরিবর্তন। সত্যি করে আছে 'হীরক রাজার দেশ', আছে অযোধ্যা পাহাড়, আছে বাদাবন, পাতা ঝড়া শাল পিয়ালের জঙ্গল। দরকার শুধু একটি 'জাদু কাঠি'। (ওপরে মুর্শিদাবাদ জেলার আন্ডুলিয়া গ্রামে ৫০০ বছরে তেঁতুল গাছ পর্যটকরা খবর রাখে না।)
কোন মন্তব্য নেই