কলকাতায় বাঙলিরা প্রতিপদে অপমানিত হচ্ছে সবাই পালাচ্ছে , পড়ে থাকবেন শুধু বুড় বাবা মা
অর্পণ গুপ্ত
গত সপ্তাহে আমার পিসি বাসে করে যাওয়ার সময়ে এক অবাঙালি ভদ্রলোককে বাংলায় সরে দাঁড়াতে বলেন। তিনি উত্তর তো ভদ্রভাবে দেনই নি, উলটে বলে দেন যে বাংলায় যেন কথা না বলা হয়। প্রতিবাদ করলে তাঁর বক্তব্য-'বঙ্গাল মে, আপলোগ সিক্সটি ফর্টি হো গ্যায়ে হো; হিন্দী মে হি বাত করনা হোগা।'
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যখন একথা তিনি বলছেন, তখন বাসের কেউ প্রতিবাদ করেননি, কারণ তিনি ভুল বলছেন না। বাসে বসে থাকা প্যাসেঞ্জারের ৬০ ভাগ-ই বিহার নতুবা উত্তরপ্রেদেশের লোক।
লোকাল ট্রেনের টিকিট কাউন্টারে বাংলায় রাণাঘাট যাবার টিকিট দিতে বলা হলে অবাঙালি রেলকর্মী জানান যে তাড়াহুড়োর সময়ে যেন কেউ বাংলা না বলে, তাতে তাঁর কাজে সমস্যা হয়। আমার পরিচিত প্রতিবাদ করলে, তাঁকেই উলটে দাবিয়ে দেয় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি লোকেরা, কারণ সেই লাইনেও ৬০ শতাংশ অবাঙালি।
পুজোয় রিলিজ করা বাংলা ছবি, রমরমিয়ে ব্যবসা করেছে। কিন্তু হিন্দী ছবি আসা মাত্রই হল কমিয়ে হিন্দী ছবিকে দেওয়া হল, কারণ? বাংলার মাটি থেকে সালার, স্ত্রী-র মতো ছবিগুলি যে টাকা তুলে নিয়ে গেছে এতদিনে বাংলা ছবি তার অর্ধেকও তুলতে পারেনি। এর কারণ বাংলায় বাঙালি নেই। বাংলা এখন বাঙালিদের বৃদ্ধাশ্রম, আর বিহারী-উত্তরপ্রদেশীয় গোঁড়াদের চারণভূমি। হিন্দীভাষী জনতার কাছে যাতে অপশন বাড়ে, তাই বাংলা ছবিতে কোপ। অর্থাৎ বাংলার মাটিতে বাঙালি এখন সংখ্যালঘু।
কিছুদিন আগে পড়ছিলাম, এদেশের বিভিন্ন মেট্রোসিটিতে সর্বাধিক বাথরুম সাফাইয়ের কাজ করেন বাঙালিরা। সুইগি-জোমাটোর খাবার ডেলিভারির ক্ষেত্রেও অন্য রাজ্যে গেলে দেখবেন বাঙালিরা ডেলিভারি করছে বেশি সংখ্যায়। ব্যাঙ্গালোরের আইটি হাবগুলোতে গিয়ে দেখুন, গিজগিজ করছে বাঙালি। এরা বাই চয়েস নেই, কম্পালশানে আছে। বাধ্য হয়ে। দশ হাজার-বিশ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে,এদিকে নিজেদের বাড়িতে পড়ে আছে বুড়ো বাপ-মা। লিংকডিন খুলুন, নকরি খুলুন- স্কিলসেট পুট করে লোকেশান ফিল্টারে কলকাতা দিন, দেখবেন একটাও রেসাল্ট আসছে না। আসবেও না। প্রত্যেকদিন এখানকার ছেলেমেয়েরা বাইরে যাচ্ছে বাধ্য হয়ে। কলকাতা সস্তা, কেন সস্তা? কারণ গ্রোথ নেই। ডেভেলপমেন্ট নেই। সস্তায় লেবার পাওয়া যায়। যে স্টার্ট আপে আপনি কলকাতায় ১০ টাকা কামাবেন, একই কাজ করে বাইরে ২০ টাকা কামাবেন। সম্ভবত নীরদ চৌধুরীর লেখাতেই পড়েছিলাম যে, অর্থনৈতিক দৈন্য বাঙালিকে একদিন শিকড় থেকে আলাদা করে দেবে৷ গত পাঁচ-দশ বছরে একদম সেই জায়গায় এসে পৌঁছেছে পরিস্থিতি। পঞ্চাশোর্ধ বাবা-মা, মধ্য ত্রিশের লোকজন যাদের নাইন্টিজ নস্টালজিয়া আছে, আর কিছু এক্সেপশান বাদে আজকের টিনেজাররা কেউ বাঙালির শিকড়ের সঙ্গে কানেক্টেডই নেই আর। সরকারী বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোর অবস্থা তথৈবচ। দিল্লীবোর্ডের স্কুলে বাংলা বহুক্ষেত্রে থার্ড ল্যাঙ্গোয়েজ। এই ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে সবাই চাইছে বাইরে চলে যেতে। রাস্তাঘাটে সর্বত্র শুনবেন একটাই কথা- 'বাইরে তো যেতেই হবে, এখানে তো কিসুই নাই...'
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটা জেনারেশন প্রায় সত্তরভাগ শিফট হয়ে যাবে হাইটেক সিটিগুলিতে। যাবেই। সেখানে তারা দিওয়ালি 'মানাবে', রঙ্গোলি 'চিপকাবে', ডিনার 'পাকাবে' আর অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অপেক্ষা করে বসে থাকবে, কবে ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি ঘরে ফিরবে তার। রাজ্যজুড়ে দাপিয়ে বেড়াবে বিহার-ইউপির সখত লউন্ডারা;
আর পড়ে থাকবে বিশ্ববাংলার এত্ত বড় 'ব'- বাবাজি কা ঠুল্লু!
---(লিখেছেন অর্পণ গুপ্ত)---








কোন মন্তব্য নেই