Header Ads

সিপি এম দলের নয়া সংকট

সিপিএমে নয়া সংকটের নাম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব 

দেবদূত ঘোষঠাকুর 

আরজি কর-কান্ড নিয়ে সবে সিপিএম সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে শুরু করেছিল, প্রতিবাদীদের এককাট্টা করে নিজেদের সঙ্ঘবদ্ধ করার চেষ্টা করছিল। এমন সময় একটা 'বোমা' ফাটিয়ে এক মহিলা সাংবাদিক সিপিএমের সেই লড়াইয়ে সিপিএম কে অনেকটাই পিছিয়ে দিলেন।
 সিপিএমের এই 'দুঃসময়ে' যে ক'জন বলিয়ে কইয়ে নেতাকে টিভি চ্যানেলগুলি তাদের অনুষ্ঠানে চাইত, তাঁদের সর্বাগ্রে থাকা উত্তর ২৪ পরগনার জেলা নেতা তন্ময় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে শুধু ফেসবুককে সরব হওয়াই নয়, পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ ও করেছেন ওই মহিলা সাংবাদিক। পুলিশের তলব পেয়ে বরাহনগর থানায় গিয়ে একাধিকবার জবাবদিহি  করতে হয়েছে তন্ময় ভট্টাচার্যকে। 
আরজি কর আন্দোলনে প্রথম থেকেই সিপিএমের যে দুই নেতা সব থেকে সরব ছিলেন তাঁরা হলেন, মিনাক্ষী মুখার্জি এবং তন্ময় ভট্টাচার্য। সেই তন্ময়ের বিরুদ্ধে চটজলদি দল সাসপেনশনের শাস্তি ঘোষণা করায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই কিন্তু হতবাক। এক জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্যের মন্তব্য, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটি কিংবা 'প্রভাবশালী' কলকাতা জেলা কমিটিতে কোনো আলোচনা হলনা, অভিযুক্তের বক্তব্য শোনা হলনা, অভিযোগ ওঠার পরদিনই খোদ রাজ্য সম্পাদক শাস্তি ঘোষণা করে দিলেন-এটাতে বেশ অবাক হয়েছি।' রাজ্য সম্পাদক এক তরফা এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারেন কী না উঠেছে সেই প্রশ্ন। 
 সাধারণত কোনও নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কোনও গুরুতর অভিযোগ উঠলেও, চট জলদি কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা সিপিএমের কখনও ছিলনা। পার্টি কমিশনে তদন্তের পরে সাসপেন্ড কিংবা বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এমন কিছু নেতা রয়েছেন যাঁদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি সহ নানা অভিযোগ দলের কাছে বহুদিন ধরে পড়ে থেকে থেকে তামাদি হয়ে গিয়েছে। তন্ময়ের বিরুদ্ধে মহম্মদ সেলিম শাস্তি ঘোষণা করার পরে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করা দলের মহিলা সদস্যদের কেউ কেউ বিচার না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। এখন দল ওই সব অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অতি সত্তর কোনও ব্যবস্থা নেয় কী না সেটা দেখতে চান অনেকেই। মোদ্দা কথা হল তন্ময়ের ব্যাপারে দলের রাজ্য সম্পাদকের 'অতি সক্রিয়তা' নিয়ে দলের অন্দরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এমনকী দলের রাজ্য সম্পাদক দলের গঠনতন্ত্রের ও উপরে কী না সেই প্রশ্ন তোলাও ঠেকানো যাচ্ছেনা। তবে, রাজ্য সম্পাদক মন্ডলীর এক ঘনিষ্ঠ সূত্রের মন্তব্য, এই সিদ্ধান্ত রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম  সম্পাদক মন্ডলীর অন্য সব সদস্যের সঙ্গে কথা বলেই ঘোষণা করেছেন। দলের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার কোনও বিরোধ নেই। 
তবে তাতেও বিতর্ক কিন্তু থামছেনা। বর্তমানে রাজ্যে সিপিএমের সংগঠনে উপরতলার ও মাঝারি তলার অস্তিত্ব থাকলেও, নীচু তলা বলে কিছু নেই। তা বিলীন হয়ে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসে। তাই নির্বাচনে শূণ্য আসনে নিয়ে ফিরতে হচ্ছে তাদের। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মূলত তৈরি হয় উপর তলা আর মাঝারি তলায়। দল বড় থাকার সময়ে নীচু তলার চাপে অনেক সময়েই উঁচুতলার মাঝারি তলাকে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নিতে হয়। এখন সেই বালাই আর নেই। মতানৈক্য ভুলে তন্ময় ইস্যুতে দলের মাঝারি তলার বিবাদমান দুই পক্ষের অনেকেই প্রশ্ন করছেন, 'রাজ্য সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হওয়া দূরে থাক, দল তৃণমূল জমানায় বিধায়ক হওয়া  তন্ময় ভট্টাচার্য কে উত্তর জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্যই করেনি। এ হেন এক 'সামান্য' নেতার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জন্য রাজ্য সম্পাদক মন্ডলী কে এই ভাবে সাসপেনশনের সিদ্ধান্ত নিতে হল কেন' -অনেকেরই বিষয়টি 'অস্বাভাবিক' ঠেকেছে। মনে হয়েছে কোনও 'চাপ'-য়ের মুখে তড়িঘড়ি এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। 
আর ঠিক এখানেই তন্ময়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কিংবা অন্তর্ঘাত নিয়ে প্রশ্ন উঠছে দলে। দলে ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ার পরিস্থিতিতেও দলের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন কিন্তু এতটুকুও কমেনি।  সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছিদ্র ধরেই তন্ময়ের বিরুদ্ধে কেউ সুপরিকল্পিত চক্রান্ত করেছেন কী না তা দলে তাঁর কট্টর বিরোধীদেরই ভাবাচ্ছে। আলিমুদ্দিনের অভ্যন্তরে লালিত বর্তমানে শাসক দলের এক নেতার সঙ্গে দলেরই একাংশের জড়িত থাকার কথাও বলছেন অনেকে।‌ তৃণমূল জমানায় প্রথম থেকেই সিপিএমের ওই অংশটি শাসক দলের ওই নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে আসছেন বলেসিপিএমের অন্দরে ফিসফাস শোনা যাচ্ছে।‌
উত্তর ২৪ পরগনায় তন্ময়ের এক কট্টর বিরোধী নেতার মন্তব্য, দলীয় রাজনীতিতে আমি আর উনি সম সাময়িক। বিভিন্ন বিষয়ে ওঁর সঙ্গে নানা মতবিরোধ থাকলেও মহিলা ঘটিত ব্যাপারে তন্ময় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে কখনও কোনও রকম অভিযোগ কেউ করেনি। তাই এমনটা বিষয়ে তিনি অভিযুক্ত হওয়ায় সন্দেহের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। ভাবমূর্তি বাড়াতে চটজলদি তন্ময় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করলেও, দল কিন্তু স্বস্তিতে নেই।
সিপিএমের যে সব তাত্ত্বিক নেতাকে ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, তাঁরা সাধারণ মানুষের থেকে নিজেদের  কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখতেন। নীচু তলার, এমনকী মাঝারি তলার নেতা কর্মীরাও খুব সহজে তাত্ত্বিক নেতাদের ধারেকাছে পৌঁছতে পারতেন না দূরে দূরে থাকতেন। কিন্তু এই জমানার তথাকথিত তাত্ত্বিক নেতা তন্ময় কিন্তু সাধারণ কর্মীদেরও কাছের মানুষ। তিনি দলীয় পর্যায়ে যেমন সাবলীল ভাবে দলীয় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতেন, তেমনই দলীয় বুদ্ধিজীবীদের কাছেও ছিল তাঁর সমান গ্রহণ যোগ্যতা। এই প্রতিবেদক যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বাসিন্দা, যা  সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কমিটির অন্তর্ভুক্ত। গত এক বছরের মধ্যে যাদবপুর বিধানসভা এলাকায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিপিএমের মঞ্চে প্রধান বক্তা হিসেবে তন্ময় ভট্টাচার্যকে বলতে শুনেছি রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসার সময়ে। রাজনৈতিক বক্তৃতা শুনতে চরম অনাগ্রহী এই প্রতিবেদকেও একবার দশ মিনিট দাঁড়িয়ে তাঁর কথা শুনতে বাধ্য করেছিলেন তন্ময়।  সম্ভবত আন্তর্জাতিক কোনও বিষয় ছিল। 
সাধারণ পার্টি প্রেমীদের মধ্যে  জনপ্রিয় হলেও, রাজ্য নেতৃত্বের কাছে তা লোকসভা নির্বাচনে টিকিট পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই গত লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার‌ নেতা সুজন চক্রবর্তী দমদম লোকসভা নির্বাচনের টিকিট পেলেও তন্ময় পাননি। সুজন কিন্তু সেভাবে বহিরাগত নন। কারণ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুরের সঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনার ও দেখভাল করেন। তন্ময়ের ভাগ্যে জোটে বরাহনগর বিধানসভা কেন্দ্রের উপর নির্বাচনের টিকিট। সেখানে অবশ্য তিনি জিততে পারেননি। আরজি কর কান্ড আরও একবার তন্ময়কে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছিল। সাংবাদিকদের কাছে সহজলভ্য তন্ময়ের 'বাইট' পাওয়া  ছিল অতি সহজ। সহজ ভাবে মিশতে মিশতে তিনি সম্ভবত গন্ডি ছাড়িয়ে ছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি না কি ইয়ার্কি, রঙ্গ তামাশাও করতেন। বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো সাংবাদিকের পিঠে সওয়ার হওয়াও যে কতটা 'বিপজ্জনক' তা বোধহয় এবার বুঝে গিয়েছেন 'পোড়' খাওয়া সিপিএম নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তার সত্যাসত্য আদালতই বিচার করবে। 
তবে তন্ময়কে এই মুহুর্তে পুলিশ যে ভাবে টানা হ্যাঁচরা করছে, তার থেকেও যে ভাবে তাঁকে দল রাতারাতি বর্জন করল তা বেশি দৃষ্টিকটু লাগছে। আরজি কর কান্ডে সাত সকালে ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে 'বিচার চাই' স্লোগান তুলেছিলেন, এখন সেই স্লোগান উঠেছে তন্ময়ের বিরুদ্ধেই। দলের বাইরে তো বটেই, এমন কী দলের মধ্যেও। 'অভিমুন্য' তন্ময়কে রাতারাতি সাসপেন্ড করে তাঁদের ডুবতে থাকা তরীকে বাঁচাতে পারবেন কি মহম্মদ সেলিম অ্যান্ড কোম্পানি? 

উত্তরবঙ্গ সংবাদ 
০১/১১/২০২৪

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.