অসমের বিখ্যাত hotspot জৈব বৈচিত্র ভান্ডার বরাক এর শোন বিল অবহেলার শিকার
বর্ষায় সাগর শীতে ডাঙ্গা ,প্রকৃতির
রহস্য আর জৈব বৈচিত্রে ভরপুর শনবিল
শনবিল দৈর্ঘ্যে ১২ কিলোমিটার প্রস্তে ৪ কিলোমিটার
২৪টি বিল নিয়ে তৈরি হয়েছে শনবিল
বিশিষ্ট সাংবাদিক. Chayon Bhattacharya silchar
, শিলচর:শনবিল উৎসব। কিন্তু জায়গাটায় পৌঁছে প্রথমে মনটা ছোট হয়ে গেল। কোথায় বিল। এত শুধু শুকনো ডাঙ্গা আর আর কিছুটা জল জমেছে মাঝে মধ্যে। বহু দূরে কিছু কিছু জল দেখা যাচ্ছে।এইটাই কি শনবিল? পরে ভুল ভাঙলো। এই যে বিশাল প্যান্ডেল বানিয়ে শনবিল উৎসবের সূচনা করা হলো । রাজ্যপাল ভাষণ দিলেন। এই প্যান্ডেলের জায়গাটা বর্ষার সময় জলের তলায় চলে যায়। এখানেই প্রায় ৩০ ফুট জল হয়ে যায়।আর এই সময় পুরো বিলটা সাগর হয়ে যায়। আর বর্ষা চলে গেলে
সবকিছু শুকিয়ে যায়। কিভাবে যে জল আসে আর কিভাবে যে জল যায় সেটা আর কেউ জানে না। আর এই আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য নিয়ে শনবিল মানুষকে আকর্ষণ করে যাচ্ছে।
শনবিল নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন এই বিষয়ে গবেষক আসাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রমাকান্ত দাস অনেক অজানা তথ্য জানালেন। আসলেই এই বিশাল বিলে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জলদ্বীপ। এই যে শনবিলকে নিয়ে এত আগ্রহ, এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এ ধরনের একটি বিল যে পর্যটক আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে সেটা বলাই বাহুল্য। যখন বর্ষার আসে তখন এই বিলে শুধু জল আর জল। যেদিকে চোখ যায় শুধু জল।
বর্ষার সময় এই বিলের আকার দাড়ায় দৈর্ঘ্যে ১২ কিলোমিটার আর প্রস্তে ৪ কিলোমিটার। এত বড় বিল ভূভারতে আর কয়টা আছে। ১২ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে শুধু জল আর জল।এর দুপাশে রয়েছে অসংখ্য জনপদ। এই জায়গায় লোক সংখ্যা বেড়েছে স্বাধীনতার পরে। উদ্বাস্তুরা সবকিছু হারিয়ে এখানে আশ্রয় নেয়। শনবিল তাদের আপন করে নেয়। এই বিল তাদের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে।
আচ্ছা এই জায়গাটার নাম শনবিল কেন হল। অধ্যাপক দাসের ভাষ্য মতে শনবিল নামের অনেকগুলি কারণ শোনা যায়। যেমন এই বিলে সময় শন শন শব্দে বাতাস বয় তাই নাম হয়েছে শনবিল। আবার অনেকে বলেন শন শব্দের অর্থ নাকি রক্ত ।সেখান থেকে নাম হয়েছে এটা। তবে বেশি যে প্রচলিত সেটা হলো শন নামের একধরনের মাছ এখানে সবসময় পাওয়া যেত। তাই নামটা হয়েছে শনবিল। এই কারণটাই বেশি যুক্তিযুক্ত হতে পারে।
শনবিলের এলাকারই এক সন্তান যিনি এই শনবিল উৎসবের ডিরেক্টর তিনি হলেন মানবেন্দ্র
দত্ত চৌধুরী। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি যেটা বললেন, সেটা হলো শনবিলের গুরুত্ব তিনটা দিক থেকে। প্রথমত এই যে একটা বিশাল জলধারা বর্ষার সময় এখানে আসে, আবার শীতে চলে যায় এটা একটা আশ্চর্যের কথা। আর এখানে প্রায় ৮৯ টি প্রজাতির পাখি রয়েছে। এসব বিরল প্রজাতির। আর ৬৯ টি প্রজাতির মাছ হয়েছে। তার মানে ধরেই নেওয়া যায় জৈব বৈচিত্রের ক্ষেত্রে এই বিল একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। তাই এইসব প্রাণীকে রক্ষা করা এবং জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করার একটা জরুরি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু এই যে জল আসে এবং জল চলে যায় এই জলটাকে আটকানোর কোন ব্যবস্থা নেই। এটা একটা বিস্ময়কর বিষয়।
আরো একটা কথা হলো ,শনবিলের বৈশিষ্ট্য হলো ,যখন জল থাকে না তখন এখানে প্রচুর বরো ধান চাষ হয়। বর্ষায় জল এলে সব একাকার। তখন জমির কেউ মালিক থাকেন না। যিনি মাছ ধরবেন তিনিই মাছের মালিক। এসব মাছ ছাড়তে হয় না, কোথা থেকে যে এত মাছ আসে আর চলে যায় তার কোন হিসাব নেই। প্রতিদিন প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকার মাছ এই বিল থেকে বিক্রি হয়।
এই বিলের মধ্যে রয়েছে আরো ২৪ টি বিল। আবার এই ২৪টি বিলের মধ্যে সবচাইতে বড় যে বিল সেটার নাম হলো ছোটো বিল। এভাবে বহু বিল মিলে এই শনবিল তৈরি হয়েছে। এটাও কম বিষ্ময়ের কথা নয়।
ড: রমাকান্ত জানালেন,এই বিলকে কেন্দ্র করে একটা আলাদা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এই এলাকায়। এবং এই সংস্কৃতির সিংহভাগ লালন পালন করছেন কৈবর্ত সমাজের লোকজন। ৪৭ সালে দেশভাগের পরে এসেছেন। প্রথমে আলিপুর উদ্বাস্তু কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। এসব তথ্য জানিয়ে রমাকান্ত দাস বলেন, আসলে কৈবর্তদের যেটা পেশা সেটা হল মাছ ধরা। আর এই পেশার সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন গান ও নৃত্য। একটা সময় বিলে মাছ ধরার নানা কৌশল ছিল। একটা বেড়া জাল ব্যবহার করতেন কৈবর্তরা। মূলত তাদের বসতি হওয়ার পরে এখানে একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এছাড়া মানবেন্দ্র দত্ত চৌধুরীর কথায়, শনবিলের যে সংস্কৃতি ,যে পরিচিতি গড়ে উঠেছে সেটা স্বতন্ত্র। কে কোন জায়গা থেকে এখানে এসেছেন তার ঠিক নেই। কিন্তু সবার একটা পরিচয় আমি শনবিলের। এখানে কে কোথা থেকে এসেছেন কে কোন জাতির কে কোন ধর্মের এ প্রশ্নটা ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। এটাও এই এলাকার একটা বৈশিষ্ট্য।
তবে একটু মনে মনে দুঃখ লাগলো। এখনকার স্থানীয় সংস্কৃতির কোন নিদর্শন এই উৎসবে দেখা গেল না। হয়তো আসাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টা তেমন খেয়াল করেননি। কিন্তু আগামীতে করলে ভালো। কারণ শনবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু নয় ,এখানকার লোকসংস্কৃতিও পর্যটককে আকর্ষণ করতে পারে। একটা বিশাল বিলকে ঘিরে একটা বিশাল এলাকার আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এই মহোৎসব হচ্ছে। তবে একটা কথা স্পষ্ট শনবিলকে ঘিরে যে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে সেটা মূলত বর্ষার চার মাস। কিন্তু সম্ভাবনা প্রচুর রয়েছে। এখন রাস্তা অনেকটা ভালো। রাজ্যপাল গোলাব চাঁদ কাটারিয়া শনবিল দেখে উচ্ছ্বসিত। এটা একটা আশার কথা। তবে এই শনবিল সম্পর্কে যা দেখা গেল যা শোনা গেল তাতে স্পষ্ট এটাকে জাতীয় পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে অবশ্যই গড়ে তোলা যায়।
কোন মন্তব্য নেই