Header Ads

মনোহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেল খেটে ছিলেন

🌻|| বাঙালির পকেট হারকিউলিস ||🌻

একটা সময় নাকি ইংল্যান্ডে থাকার প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখান করেছিলেন কলকাতার জন্য। তিনি সব সময় বলতেন "কলকাতার মতো আবহাওয়া নাকি কোথাও নেই। এমনকী ইংল্যান্ডেও নেই। এখানকার পরিবেশ বডি বিল্ডারদের জন্য আদর্শ। তাই কখনও কলকাতা ছাড়ার কথা মাথাতেই আসেনি তাঁর।’’ এতটাই টান ছিল তাঁর বাংলার প্রতি |তিনি ‘বিশ্বশ্রী’ মনোহর আইচ..🌿

‘বিশ্বশ্রী’ মনোহর আইচকে তো সবাই চেনেন। তবে তাঁর যে আরও একটা পরিচয় আছে, সেটা কি জানেন? শুনলে হয়তো আঁতকে উঠবেন অনেকে যে, তিনি এক সময় জেলও খেটেছিলেন! তবে চুরি, ডাকাতির জন্য অবশ্যই নয়। মনোহরের সাত বছরের জেল হয়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য। স্বাধীনতার আগে। তাঁর সবচেয়ে পুরনো ছাত্র ক্ষিতীশবাবুর কথায়, ‘‘কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না যে, উনি ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি হয়েও রয়্যাল এয়ারফোর্সে কাজ করেছেন।এয়ার ফোর্সের একজন অফিসার ছিলেন রিউব মার্টিন। মনোহরের শরীরচর্চা প্রীতি দেখে তিনি তাকে উৎসাহ দেন এবং আধুনিক অনেক শরীরচর্চা পদ্ধতির সাথে তাকে পরিচিত করান। কিন্তু বেশি দিন তিনি চাকরি করতে পারেননি। আসলে ওই সময় একটা নিয়ম ছিল। রাতে ব্রিটিশ অফিসারদের ডিনারের পর যে খাবার বাঁচত, সেটা সকালে ভারতীয় সৈনিকদের দেওয়া হত। আর মনোহরদা সেটা খেতে শুধু অস্বীকার করেছিলেন তাই নয়, প্রতিবাদও করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। যার ফলে সাত বছর সাজা হয় তাঁর।’’

যদিও চার বছরেই সেই সাজা শেষ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। লাহৌর, পেশোয়ার হয়ে মনোহরের হাজতবাস শেষ হয় আলিপুর জেলে। তবে এই চার বছরের হাজতবাসের সময় বডি বিল্ডিংয়ের চর্চায় পুরোপুরি ডুবে যান মনোহর। তার মনে হতে থাকে তিনি চাইলে বিশ্ব বডি বিল্ডিং প্রতিযোগীতায় যেতে পারেন। এর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি। তখন এমন সময়ও গিয়েছে যে, দিনে কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়াই তিনি বারো ঘন্টা ব্যায়াম করে গেছেন।মজার ব্যাপার হল, বডি বিল্ডিংয়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং নিষ্ঠা দেখে জেলের আধিকারিকরাও মনোহরের জন্য জেলে স্পেশ্যাল ডায়েট চালু করে দেন। কেন না মানুষ মনোহরকে কাছ থেকে দেখার পরে মুগ্ধ হন ব্রিটিশরাও। আর মনোহর? কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার জেল থেকে বেরোনোর পরেই হাতেনাতে চলে আসে। এক বছরের মধ্যে স্বাধীন ভারতে প্রথম মিস্টার ইউনিভার্সও হয়ে যান। তারপর একে একে আরও সাফল্য।

মনোহর আইচের জন্ম ১৯১২ সালের ১৭ মার্চ, বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ধামতি গ্রামে। বারো বছর বয়সে আক্রান্ত হন কালাজ্বরে। রোগটি তাকে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে, কিন্তু তিনি ফিরে আসেন। ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে শুরু করলেন দেশীয় স্টাইলে শরীর চর্চা। সেই থেকে শুরু |তাঁর গুরু ছিলেন প্রবাদপ্রতিম বিষ্ণু ঘোষ। বিষ্ণু ঘোষের আখড়াতেই বডি বিল্ডিংয়ের হাতেখড়ি। পড়াশোনা করতেন ঢাকার জুবিলি স্কুলে। একবার সে স্কুলে জাদু দেখাতে আসেন বিখ্যাত জাদুকর পি সি সরকার। মনোহর আইচের শরীর চর্চা ও শরীর নির্ভর ক্রিয়াদি দেখে তার ভালো লাগে। তিনি তাঁর দলে নিয়ে নেন তাঁকে।

মনোহর তখন পি সি সরকারের সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রামে তার ক্রীড়াকৌশল দেখাতে শুরু করেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:

• দাঁত দিয়ে ইস্পাত বাঁকানো
• গলার সাহায্যে বল্লম আনমিত করা
• তরবারির উপর পেট রেখে শুয়ে থাকা,
• দেড় হাজার পাতার বই নিমিষে ছিঁড়ে ফেলা

ধীরে ধীরে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেহচর্চার টানে ছুটে গিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। ১৯৫০-এ মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মিস্টার হারকিউলিস প্রতিযোগিতা জেতেন। ’৫১-তে মিস্টার ইউনিভার্স-এ দ্বিতীয় হন। ১৯৫২-তে প্রথম বাঙালি বডিবিল্ডার হিসেবে ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ খেতাব জেতেন তিনি। নয়াদিল্লি (’৫১), ম্যানিলা (’৫৪) ও টোকিও (’৫৮) এশিয়ান গেমসে তিনটি করে সোনা জেতেন তিনি। এর পর আর থেমে থাকেননি তিনি। একের পর এক প্রতিযোগিতায় দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন মনোহরবাবু। আশি পেরিয়েও সমান ভাবে শরীরচর্চা করে গিয়েছেন তিনি। তাঁর শেষ শো ছিল ৮৯ বছর বয়সে..💪🏼♥️

কিন্তু বডি বিল্ডিং চালিয়ে নেয়া তার জন্য সহজ ছিল না।দরিদ্র পরিবারের সন্তান | স্ত্রী এবং চার সন্তান ছিল পরিবারে।তাই মনোহর বিভিন্ন ছোটখাট কাজ করে নিজের বডি বিল্ডিংয়ের জন্য অর্থ জোগাড় করতেন। তাঁর এই পরিশ্রম ও চেষ্টা বৃথা যায়নি।তিনিই ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মিস্টার ইউনিভার্স খেতাবধারী | ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আমাদের মতোই একজন বাঙালি, জীবনাচরণে ছিলেন বেশ সাদামাটা। এখনকার যারা জিম করেন তাদের ডায়েটের কত নিয়ম আছে, ভাত খাওয়া যাবে না, কমপ্লেক্স কার্ব খেতে হবে ইত্যাদি। মনোহর আইচ কিন্তু ভাতই খেতেন। ‘পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল‘- এ কথা তিনি বলতেন।তিনি একসময় দিনে চারবেলা পান্তা খেতেন।

যখন তার বয়স শত বছর পেরিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে খেতেন দুধ দিয়ে চিঁড়া, এরপর খেতেন এক কাপ কফি। দুপুরে ভাত, ডাল এবং সবজি বা মাছ। বিকেলে থাকতো কফি। রাতের বেলায় আবার ভাত। কখনো ফলের রস খেতেন দিনে। তিনি বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফলের ও মাছের ভক্ত ছিলেন। সপ্তাহে তিন দিন মাংসও থাকত খাবারের তালিকায়। মুসুরির ডাল আর পুঁইশাকের চচ্চড়ি তো বটেই, মাছের মুড়ো আর কচুর লতিও অসম্ভব ভালবাসতেন তিনি।

সবচেয়ে দারুণ ছিল তার জীবন দর্শন। তিনি বলতেন, “আমি কখনো দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় দেই না। ছোটবেলা থেকে টাকা রোজগার নিয়ে আমার সমস্যা ছিল। কিন্তু অবস্থা যা-ই হোক না কেন, আমি চিন্তিত হই না, খুশি থাকি।”নিজের তৈরী ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম শেখাতেন। ভারতের আটবারের চ্যাম্পিয়ন বডি বিল্ডার সত্য পাল তারই শিষ্য। এছাড়া আরেক শিষ্য প্রেমচাঁদ দোগরা ১৯৮৮ সালে জিতেছিলেন মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব।

মনোহর আইচ মনে করতেন, দেহের উন্নতির জন্য মনের সাথে তার সংযোগ জরুরী। এজন্য মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। শুধুমাত্র শারীরিক কসরতের উপরই বডি বিল্ডিং নির্ভর করে না।মনোহর আইচের জীবনে দেখা যায়, দারিদ্রতার জন্য তিনি অনেক প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছেন, কিন্তু হতোদ্যম হননি। সবসময় হাসিখুশি থেকেছেন এবং নিজের কাজ করে গেছেন। একসময় তিনি এটাও বলেছেন যে, মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব জিতবেন কি না তা ভাবেন নি, কেবল নিজের ব্যায়ামটা ঠিকমত করে গেছেন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নিজের ভবিষ্যত জীবনের ভালোর জন্য অন্যের গোলামী করার মানসিকতা তার ছিল না। তাই সেই ব্রিটিশ অফিসারের মন্তব্যের প্রতিবাদ তিনি করতে পেরেছিলেন।

মাত্র ৪ ফুট ১১ইঞ্চি উচ্চতা হওয়ার কারণে তাঁকে 'পকেট হারকিউলিস' ও 'ভারতীয় শরীরচর্চার জনক' নামে অভিহিত করা হত।মনোহরবাবুর সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে তাঁকে বঙ্গবিভূষণ সম্মানে সম্মানিত করা হয়।বডি বিল্ডিংয়ের এই কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব মারা যান ২০১৬ সালের ৫ জুন। তখন তার বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর।এই বডিবিল্ডারের প্রয়াণ এক চলমান ইতিহাসের অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি..💫🌷

♦️তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, Roar বাংলা

© এক যে ছিলো নেতা 

| #এক_যে_ছিলো_নেতা |

#মনোহর_আইচ #ব্যায়ামবীর #পকেট_হারকিউলিস #ভারতীয়_শরীরচর্চার_জনক #বাঙালী #বাংলা #ব্যায়াম

📌 Facebook এর পাশাপাশি আমরা পথচলা শুরু করেছি YouTube এও.. আমাদের কাজ ভালো লাগলে আমাদের channel টি Subscribe করে পাশে থাকবেন.. এই রইলো link 👇 https://appopener.com/yt/19zgtp0em

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.