Header Ads

অবহেলা নিয়ে জন্ম যার সেই আশা পূর্ণা স্মরণে

অবহেলা নিয়ে জন্ম। আর মেয়ে সন্তান জন্মাক পরিবারের কেউ সেটা চায়নি। মেয়ের স্বাদ তাঁদের মিটেছিল। তাই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ‘আশাপূর্ণা’! নামটি তাঁর ঠাকুমা দিয়েছিলেন। জানা যায় যে, হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও সরলাসুন্দরীর ন’টি সন্তানের পঞ্চম এবং কন্যা হিসেবে তৃতীয় হওয়ায় তাঁর ঠাকুমা অমনটাই চেয়েছিলেন। কালে কালে এই কন্যাই স্বয়ং রবিঠকুরের স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। কবিগুরু বলেছিলেন – ‘আশাপূর্ণা তুমি সম্পূর্ণা’! 

আশাপূর্ণা দেবী ছোটতে খুব ডাকাবুকো ছিলেন। ঘুড়ি যেমন ওড়াতেন, তেমনই বাধ্য মেয়েও ছিলেন। জন্ম উত্তর কলকাতায়, পটলডাঙায় তাঁর মামাবাড়িতে। বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন সে যুগের শিল্পী। মা সরলাসুন্দরীর ছিল বই-অন্ত প্রাণ। বৃন্দাবন বসু লেনের শরিকি বাড়ি থেকে হরেন্দ্রনাথ যখন তাঁর পরিবার নিয়ে আপার সার্কুলার রোডে উঠে এলেন, আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর। 

অক্ষর-পরিচয়ও হয়েছিল সেই অবহেলা দিয়েই | বৃন্দাবন বসু লেনের বাড়িতে ছেলেদের জন্য মাস্টারমশাই আসতেন। মেয়েদের অবশ্য নিষেধ ছিল সেই পাঠে যোগ দেওয়ায়। কখনও উল্টো দিকে বসে, কখনও পাশের ঘরে থেকে সেই শুনতে শুনতেই বালিকা আশাপূর্ণার পড়া শেখা শুরু হয়েছিল। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইস্কুলের ভেতর যাওয়া দূরে থাক, চৌকাঠেও পা রাখতে পারেননি। কিন্তু পরে তিনিই আবার তিন হাজার ছোট গল্প, আড়াইশো উপন্যাস, ষাটেরও বেশি ছোটদের কাহিনি, অসংখ্য প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন। বিশ্বভারতীর শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ থেকে অজস্র সম্মানিক ডক্টরেট আর সোনার মেডেল পেয়েছিলেন। এমনকী সর্বভারতীয় স্বীকৃতি ‘জ্ঞানপীঠ’ও হাতে তুলেছিলেন। এমন মানুষই বোধ হয়, নিজেকে অনায়াসে আখ্যা দিতে পারেন – ‘‘আমি মা সরস্বতীর স্টেনোগ্রাফার।’’

আশাপূর্ণা দেবীর লেখার ভঙ্গিটি ঠিক ছবির মতো ছিল। আধশোয়া। উপুড় হয়ে ছোট্ট একটা কাঠের ডেস্কে নিজের প্যাডে লিখে যেতেন। কতবার হয়েছে, লিখতে লিখতে ভোর। অসম্ভব সরল। সাদাসিদে। কিন্তু ‘টিপটপ’ বলতে যা বোঝায়, ঘরের আশাপূর্ণা দেবী ছিলেন তেমন। বিকেলে চুল বেঁধে গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ি পরা। সুগন্ধি চন্দন সাবান মাখা। মাথায় জবাকুসুম, নয়তো মহাভৃঙ্গরাজ তেল দেওয়া। মুখে হিমানী স্নো, ওটিন ক্রিম। খুব পছন্দ ছিল তাঁতের শাড়ি। তাতে হালকা কমলা বা হালকা সবুজ বা হালকা নীল পাড়। কিন্তু কোনও দিন খুব রঙিন শাড়ি পড়তেন না |
আশাপূর্ণা দেবী চলে যাওয়ার দু’তিন মাস আগেও লিখেছিলেন। হঠাৎ করেই শরীরটা ভেঙে পড়েছিল। বোঝা যেত, লিখতে কষ্ট হচ্ছে। তবু লিখতেন। কোলের উপর প্যাড নিয়ে লেখার চেষ্টা করতেন। লাইনগুলো ছেড়ে ছেড়ে যেত। অক্ষর কেঁপে যেত। একটা গল্প ওইভাবেই শেষ করেছিলেন। শেষের দিকে শুয়েই থাকতেন।

১৯৯৫ সালের যে দিন চলে গিয়েছিলেন, সেটা ছিল ১৩ই জুলাই। গহন রাতে ঘুমের মধ্যেই কখন যে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল তা কেউ বুঝতে পারেননি।

প্রকৃতই আধুনিকা ,নারীবাদী , নারী স্বাধীনতা এসবের কথা বললে যাঁর কথা মনে পড়ে, আজ তাঁর আবির্ভাব দিবস। মেয়ে মানেই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। মেয়েরাই কিভাবে মেয়েদের কষ্টের কারণ হয় তাঁর শক্তিশালী স্পষ্ট লেখা বুঝিয়ে দেয়। আহা বয়স্ক মানে দোষ নেই ; এই মনোভাব কতটা ভুল সেটা তিনি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বলেছেন | অথচ আমরা এখনও এসব থেকে না বেরিয়ে নিজেদের আধুনিকতার ধ্বজাধারী ভাবি ! আজকালকার শুধু পুরুষবিদ্বেষী নারীবাদ কেন উপহাস বোঝা যায়। 

বিনম্র প্রণাম 🙏

Ⓒ অহর্নিশ ও বর্ষা কর্মকার ঘোষ

আশাপূর্ণা দেবীর লেখা সুবর্ণলতা, বকুলকথা এবং প্রথম প্রতিশ্রুতি সংগ্রহে রাখার মত বই ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.