সুমনের সুর মূর্চ্ছনা ভয়েস অফ আমেরিকা
"১৯৭৯ সাল। ডিসেম্বর মাস। কয়েক মাস হ'ল ওয়াশিংটন ডি সি-তে ভয়েস অফ আমেরিকায় “আন্তর্জাতিক বেতার সম্প্রচারক' হিসেবে চাকরি করছি। বাসা নিয়েছি মেরিল্যান্ডের সিলভার স্প্রিং নামে ছোট্ট একটি শহরে। প্রয়োজনীয় আসবাব কেনার আগে কিনে ফেলেছি একটি ডবল ডেক্ অর্গ্যান। তারই সঙ্গে পেয়ে গেছি একটি টুল।
শীতকালের রোববার সকাল। ছুটি। কফি বানিয়ে নিয়ে টুলের ওপর বসে বসে জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছি। মাঝে মাঝে অর্গ্ানে অনির্দিষ্টভাবে আঙুল চালাচ্ছি। বাইরে তুষার। সামনের রাস্তার ফুটপাথ সাদা হয়ে গিয়েছে। আকাশটা মাড়ম্যাড়ে। ছুটির দিন বলেই বাইরে লোকজনের দেখা নেই। সব কিছু কেমন যেন নিথর। কলকাতার কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বাবা মায়ের কথা, বন্ধুদের কথা, গড়িয়ায় আমাদের পাড়াটার কথা। মন কেমন করছে। মন কেমন করছে কলকাতার জন্য। নোংরা রাস্তার দুধারে ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলোর জন্য।
কোনো কোনো বাড়ির জানলায় হঠাৎ দেখে-ফেলা মুখগুলোর জন্য।
অর্গ্যানে অসংলগ্ন সুর তুলছি আর ভাবছি কত জানলায় কত রকমের ভাব, দৃষ্টি। কোনো মুখ উদাস। কোনো মুখ বিষন্ন। কোনোটা চেনা-চেনা। একেবারে অচেনা মুখেও তো কখনও দেখে ফেলেছি আগুনের আভা। পড়ে নিয়েছি আগুনের ভাষা। জানালা দিয়ে দেখে ফেলা কোনো মুখে আবার দেখেছি অপার নিঃসঙ্গতা। এক লহমায় কারুর অচেনা মুখে দেখেছি চেনা মুখের আদল।
খাতা কলম এনে-টুলে বসে বসেই লিখে ফেললাম প্রথম লাইন : “আগুন দেখেছি আমি কত জানলায়'। পুরো গানটা লিখে ফেললাম বোধহয় আধ ঘন্টার মধ্যে। লিখতে লিখতেই প্রথম লাইনের সুরটা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতে লাগল।
লেখা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার সূত্র ধরে পুরো সুরটা করে ফেললাম। সকালে বাঁধা গান, অথচ কোথেকে যে রাতের সুর বাগেশ্রীর আদল এসে পড়ল কে জানে। স্বর মেপে মেপে নয়। ছোয়ায় ছোয়ায়।"
---কবীর সুমন
('সুমনের গান
সুমনের ভাষ্য'
নামক বই থেকে)








কোন মন্তব্য নেই