শিলঙে অ-উপজাতির জন্য চাকরি কোথায়?
-বর্ণালী বিশ্বাস-
আমি এই লেখাটি লিখেছি কারণ আমি শিলঙের অ-উপজাতির মধ্যে একজন। আমার জন্ম শিলঙে। আমিও সেখানে বৈষম্যের শিকার হয়েছি। যদিও পরবর্তীকালে নিজের প্রকাশনা শুরু করার জন্য কলকাতায় স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল। আমার প্রাথমিক প্রশ্ন হচ্ছে - শিলঙে অ-উপজাতিদের জন্য চাকরি কোথায় ? মেঘালয় জাতিগত উত্তেজনা দেখা দিয়েছে ১৯৭০ এর দশক থেকে। রাজ্যের অ-উপজাতীয়দের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা বা ভূমিপুত্র সরব হয়েছে। ছাত্র এবং যুব গোষ্ঠীগুলি, এই ধরনের আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। তারা শুধুমাত্র উপজাতিদের পক্ষেই সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধার দাবি করে আসছে।
অ-উপজাতীয়রা ব্রিটিশের সময় থেকেই শৈল শহরের শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশে প্রচুর অবদান রেখেছেন। তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও বিদ্যমান এবং সাধারণ মানুষের জীবনকে এখনও সমৃদ্ধ করে চলেছে। তথাকথিত অবাঞ্ছিত অ-উপজাতিদের কঠোর প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ মেঘালয়ের ভূমিপুত্ররা আজ উন্নয়ন উপভোগ করছে।
মেঘালয় রাজ্য ১৯৭২ সালে অসম থেকে আলাদা রাজ্য হিসেবে বিভাজিত হয়। ছয় বছর পরে, ১৯৭৮ সালে খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (কেএসইউ) নামে একটি ছাত্র সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে যার মূলমন্ত্র ছিল - 'মাটির সন্তানদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করুন'।
মাটির সন্তান বলতে শুধুমাত্ৰ খাসিদেরই বোঝানো হতো। বাদ দেওয়া হয়েছিল সমস্ত অ-খাসিদের। মেঘালয়ে কত প্রজন্ম ধরে অ-খাসিরা বসবাস করছে তার কোনও হিসেব নেই। মেঘালয়ের ইতিহাসে তাদের যথেষ্ট অবদানও আছে যার জন্য মেঘালয় আজ বিশ্ব পরিচিত। KSU বা খাসি ছাত্র সংগঠনটি অ-উপজাতীয়দের লোকদের জন্য একটি শব্দ তৈরি করেছে, Dkhar – বহিরাগত। তাদের নজরে মেঘালয়ে বসবাসকারী অ-উপজাতিরা রাজ্য থেকে বিতাড়িত করার জন্য প্রতিটি সুযোগে অপমানিত, ধাক্কা দেওয়া এবং মারধর করার যোগ্য। কিন্তু উগ্র মানসিকতার অধিকারীরা ভুলে গেছে যে এই বহিরাগতরা উনিশ শতক থেকে শিলঙের ইতিহাস সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ১৮৭৪ সালে অসমকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাইরে একটি পৃথক প্রদেশ হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। আর, এই সুন্দর পাহাড়ি শহর ছিল প্রদেশের রাজধানী। রাজকার্য্যে বাঙালিদের অবদান ছিল অপরিসীম।
রাজধানী শিলঙ একটি সুন্দর পার্বত্য শহর হওয়ায় কারণে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকদের ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল - বিশেষ করে একটা সময়ে বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলা থেকে বহুলোক এই পার্বত্য শহরের প্রতি আকর্ষিত হয়েছিল। তারা এই শহরের সরকারি ও বেসরকারি অফিস, স্কুল ও কলেজে চাকরিতে যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে এ শহরেই পাকাপাকিভাবে চিরকালের জন্য থেকে যান।
ব্রিটিশদের নেতৃত্বে খ্রিস্টান মিশনারিরা শিলঙে বেশ কয়েকটি ভালো স্কুল ও কলেজ স্থাপন করেছিল। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাংস্কৃতিকভাবে ছিল প্রাণবন্ত। অ-উপজাতি, বিশেষ করে বাঙালিদের, সেখানে নিয়োগ করা হয়েছিল।
যখন বিভাজন হয়ে সিলেট পাকিস্তানের চলে গেলো, বৃহৎ সংখ্যক হিন্দু বাঙালি জনসংখ্যা উদ্বাস্তু হিসাবে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়। শিক্ষার সুযোগের কারণে তারা বেশিরভাগ শিলঙ ও অসমের বরাক উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে। শিলঙ তখনও অসমের রাজধানী ছিল। ১৯৬০-এর দশকে, যখন বঙ্গাল খেদা বা 'বাঙালি তাড়া' আন্দোলন অসমে বাঙালিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়, তখনও কিন্তু শিলঙ বরাবরের মতো শান্তিপূর্ণ ছিল। উগ্র জাতিবাদ শিলঙের সবুজ পাহাড় এবং নীল আকাশে তখন অবধি অশুভ ছায়া ফেলতে পারেনি। এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে বাঙালি ও খাসিরা অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তাদের মধ্যে পারস্পরিক একটি সহানুভূতিশীল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
যাই হোক, একবার মেঘালয় গঠিত এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে অ-আদিবাসীদের মেঘালয়ে সম্পত্তি অর্জনে সামগ্রিকরূপে বাধা দেওয়া শুরু হয়ে যায়।
নতুন রাজ্য তার উপজাতীয় জনসংখ্যার জন্য চাকরির সংরক্ষণের অধিকার প্রয়োগ করা শুরু করে। তারপর, নিজেদের অসুরক্ষিত বোধ করে এবং নুতন রাজ্যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে অ-উপজাতি জনগোষ্ঠীরা ধীরে ধীরে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। কিন্তু ধীর গতির স্থানান্তরিত হওয়ার যাত্রা ছাত্র সংঘঠন কেএসইউর নেতাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র উপজাতিদের জন্য রাজ্যকে সুরক্ষিত করার জন্য অ-উপজাতি জনগোষ্ঠীর সামগ্রিকভাবে শীঘ্রই তাড়িয়ে দেওয়া। তারপর, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করা। পরবর্তীকালে, কেএসইউর এক নেতা মন্ত্রী হন। নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য, কেএসইউ একটি বিভ্রান্তিকর কার্যকর কৌশল তৈরি করে। একটা সময়ে একটি বিশেষ অ-উপজাতি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে উস্কানি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সরব হয়।
তারা জানতো যে এই একটি মাত্ৰ অ-উপজাতি সংখ্যায় অল্প হওয়ায় জন্য তারা মেঘালয় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে। কৌশলটি ছিল একটি মাস্টারস্ট্রোক। এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা ছিল না যে কেএসইউ গঠনের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে অক্টোবর মাসে কেএসইউ দ্বারা প্ৰরোচনামূলক উস্কানিতে শিলঙে সর্ব প্রথমবারের মতো বাঙালিদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দাঙ্গার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেই দাঙ্গার ঘটনা শিলঙের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায় ছিল। বাঙালিদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আর, বাঙালিদের ঘর থেকে টেনে বের করে আনা হয় পেটানো এবং নৃশংসভাবে হত্যা করার জন্য। ঘরের মেয়েদের ধর্ষণও করা হয়।
হত্যাকারী ও ছিনতাইকারীরা নৃশংসভাবে খুন ও মারপিটে লিপ্ত হলেও সে সময় পুলিশ ও প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল।
১৯৭৯ সালের পর সিংহভাগ বাঙালি শিলঙ ছেড়ে চলে যায়। কেএসইউ-র প্ররোচনায় এই ধরনের কার্যকলাপ তখন মেঘালয়ে প্ৰায়ই সংঘটিত হতে শুরু করে। এরপর ১৯৮৭ সালে সেখানে নেপালি, শিখ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও সরব হয় স্থানীয় ভূমিপুত্ররা । যার ফলস্বরূপ শিলঙে এক বছরব্যাপী কারফিউ জারি হয়েছিল। এর ফলে সেখানে অর্থনীতি এবং শিক্ষার উপর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। শত শত উদ্বাস্তু যাদের বাড়িঘর এবং সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের কয়েক মাস ধরে শরণার্থী শিবিরের স্কুলগুলিতে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হয়েছিল বেশ কিছুকাল। রাজ্যের একাডেমিক সেশনগুলি সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
ধীরে ধীরে ঘৃণা ও বৈষম্য এতটাই বেড়ে যায় যে এখন মেঘালয়ে বিশেষ করে শিলঙে অ-উপজাতিদের জন্য স্কুলে ভর্তি, চাকরি, সম্পত্তি, আন্দোলন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি শিলঙে বেকারত্ব নিয়ে একটি জনসভা হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিল।
মেঘালয়ের উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্ব দাবি করে একটি নাগরিক সমাবেশ সম্প্রতি শিলঙে হিংসাত্মক হয়ে উঠে। রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আগামী বছরের প্রথমভাগে। কয়েকটি ভিডিওতে দেখানো হয়েছে যে বিক্ষোভকারীরা নির্বিকারে পথচারীদের মারধর করছে।
ফেডারেশন অফ খাসি-জয়ন্তিয়া এবং গারো পিপল (এফকেজেজিপি) এর নেতৃত্বে, শত শত যুবক শিলঙে ফায়ার ব্রিগেড গ্রাউন্ডে পৌঁছনোর জন্য সেদিন পদযাত্রার আয়োজন করে। কী কারণে তাদের এই পদযাত্ৰার সূত্রপাত হয়েছিল তা এখনও অজানা। কিন্তু ভিডিওগুলি শীঘ্রই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হতে শুরু করে যেখানে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের ট্রাক চালক এবং বাইক চালকদের কোনো প্ররোচনা ছাড়াই মারধর করতে দেখা যায়।
সোশ্যাল মিডিয়া দর্শকরা সেদিনের আন্দোলনকারীদের হিংসতার জন্য বিস্মিত হন।কেউ কেউ পুরো ঘটনাটি "জেনোফোবিক" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ভিডিওগুলির একটিতে একজন আহত টেম্পো চালক, দৃশ্যত একজন অ-উপজাতি, কথিতভাবে মারধরের পরে রাস্তার উপর পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ভিডিও তোলার জন্য স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রহার করা হয়।
এ সম্পর্কে এফকেজেজিপি-র সভাপতি ডান্ডি খংসিট (FKJGP president Dundee Khongsit) বলেছেন “আমাদের দাবি অবিলম্বে সরকারি দপ্তরে শূন্য পদ পূরণ করা হোক। আমরা একটি রাষ্ট্রীয় কর্মসংস্থান নীতিও দাবি করেছি যাতে সরকার বেসরকারি এবং সরকারি খাতে চাকরি দেওয়ার এবং স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়ার উপায় খুঁজে পাওয়া যায়”।
সম্প্রতি, হাইনিউট্রেপ ন্যাশনাল ইয়ুথ মুভমেন্ট রাজ্যের বেসরকারি খাতে স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে এমন একটি নীতি প্রণয়নে মেঘালয় সরকারের বিলম্বের প্রতিবাদে একটি জনসভা করেছে।
“সাম্প্রতিককালে একটি আরটিআই অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে সরকারি দপ্তরে ৭ হাজার টিরও বেশি শূন্য পদ রয়েছে,” খংসিট বলেন।
যার অর্থ সরকারি চাকরিতে শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও তারা বেসরকারি চাকরিও চায় যাতে অ-উপজাতিদের নিয়োগ না হয়। খাসি, জয়ন্তিয়া এবং গারো হল মেঘালয়ের তিনটি প্রধান উপজাতি, যেখানে উপজাতিরা রাজ্যের জনসংখ্যার ৮৬.১৫ শতাংশ।
আদিবাসী এবং অ-উপজাতিদের মধ্যে বৈরিতা অনেক দূরে চলে যায়।
২০১৮ সালে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (NPP) সভাপতি কনরাড সাংমা আঞ্চলিক দল, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং একজন স্বতন্ত্র বিধায়কের সহায়তায় একটি জোট সরকার গঠন করেন। সে বছরও শিলঙে খাসি এবং শিখদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। এই উত্তর-পূর্ব রাজ্যে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে ভোট হবে৷
এতো কিছু সম্প্রতি ঘটে সত্ত্বেও রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা রয়েছে। তাদের নজরে উদ্বাস্তু জীবন কখনও মূল্য পায়নি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির অ-উপজাতিদের ভবিষ্যত কী, যারা জন্মসূত্রে ভারতীয় এবং যাদের ভোট সরকার গঠনের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।
নন-ট্রাইবেলরা বা অ-উপজাতীয়রা কবে ন্যায়বিচার পাবে? কেন্দ্রকে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং এই হিংসার পরিবেশ এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রপতি শাসনেরও প্ৰয়োজন হতে পারে………
[লেখিকা কলকাতার ওয়েব পোর্টাল নিউজ ম্যানিয়ার প্রধান সম্পাদিকা। মতামত নিজস্ব।]
কোন মন্তব্য নেই