Header Ads

ভারতীয় সংস্কৃতির সংকট

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতির সংকট

তারাপ্রসাদ বণিক 

সাম্প্রতিক সময়কালে তথাকথিত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যময় বহুত্ববাদী সংস্কৃতি প্রবল সংকটের মুখে। স্মরণাতীত কাল থেকেই এই ভূ-খণ্ডের অধিবাসীদের জীবন শৈলীর বৈচিত্র্য, পোষাক পরিচ্ছদের অদ্ভুত চমৎকারিত্ব, খাদ্যাভ্যাস, ভাবনা চিন্তা ও বিশ্বাসের রকমফের এবং ধর্মাচরণের বহুবিধ রীতি সত্বেও যুগ যুগ ধরে পারস্পরিক সৌহার্দ্যকেই পরিপুষ্টি দানে ব্রতী হয়েছে সাধারণ মানুষ। এর মধ্য দিয়েই হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে এবং বিকশিত হয়েছে বহুত্ববাদী ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি। মানব সভ্যতায় কোনও বিশেষ মতাদর্শ কিংবা উদ্ভাবন নির্দিষ্ট  কোনও রাজ্য বা দেশের ভৌগোলিক সীমার মাঝে রুদ্ধ রাখা যায়না। এভাবে মানুষের জীবন যাপন ও ভাবনাচিন্তার মাঝে নব নব সৃষ্টি বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। 
 সংস্কৃতি শব্দটির মাধ্যমে মানুষের ক্রম বিকশিত সত্তা, সৃজনশীল হৃদয়বত্তা ও মননের সুগঠিত ধারণার চিত্র প্রকাশিত হয়। মানুষের সমস্ত ইতিবাচক নন্দিত চেতনার আধারই হচ্ছে সংস্কৃতি। 
    সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে মানুষের সার্বিকভাবে সুন্দর হয়ে ওঠার অবিরাম সাধনার নামই সংস্কৃতি। এর স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণে মার্জিত রূপের মাঝে। যেকোনও জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমির ভূ-প্রাকৃতিক গঠন ও উৎপাদন প্রক্রিয়াই মূলতঃ সংস্কৃতির নিয়ামক। 
ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ফলে অঞ্চলভেদে তারতম্য ঘটে মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পোষাক, গৃহনির্মাণ থেকে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের নানাবিধ আচার ও রীতিতে।
 মানব সভ্যতার আদিকাল থেকে মূলত প্রকৃতিই মানুষের শিক্ষক। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় রূপ মানুষকে দিয়েছে জীবন শৈলীর বিচিত্র উপকরণ। এরমধ্যে কিছু সরাসরি, আর কিছু প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে উপভোগ করে প্রীত ও ধন্য হয়েছে মানুষ। 
  এভাবেই লক্ষ লক্ষ বছর চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে মানুষ এগিয়েছে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নময় লক্ষ্য স্পর্শ করবার জন্য। চলতে চলতে কখনও কোথাও স্বপ্ন পরিণত হয়েছে ভয়ানক বিভীষিকায়। দীর্ঘ খরা, প্রবল বন্যা, দাবানল দহন, ভূমিকম্প প্রভৃতি নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে বহু জনপদ। এর মধ্য দিয়েই মানুষ খুঁজে পেয়েছে  সমস্যাসঙ্কুল জীবনের বাঁকে বাঁকে উত্তরণের বিভিন্ন পথ ও উপকরণ। বহুবিধ অকারণ কিংবা অন্যায্য পরাজয়ে গ্লানি ও হতাশায় বিলাপ করেছে অহরহ। দুঃসহ ভার লাঘবে নিবিষ্ট সাধনায় উদ্ভাবন করেছে একে সহজতর করবার পন্থা ও পদ্ধতি। বিকশিত হয় ভাব বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম ভাষার। এর মাধ্যমে রেখে গেছে তাদের উত্থান-পতন, জয়-পরাজয়, আনন্দ বেদনার মিশ্র অনুভব। 
  সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে জীবনের সাথে লীন হয়ে থাকা পরিপার্শ্ব যেমন নদী, পাহাড় পর্বত, বৃক্ষ, অরণ্য পশুপাখি, আকাশ,  চন্দ্র সূর্য ইত্যাদি এবং তাদের দলের সঙ্গীজনেরা ( বলা বাহুল্য তখনো পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উদ্ভব হয়নি) আনন্দ অবগাহনে কল্পনার স্রোতে ভেসে উপস্থিত হয় একই সমতলে। সকলেই পরস্পরকে সম্বোধন করে সুখ-দুঃখ মনোবেদনা, জয়ের উল্লাস, পরাজয়ের গ্লানি বিনিময় হয় বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে। তা থেকে সৃষ্টি হয় নৃত্য।  হৃদয় মধ্যস্থ আবেগের সুরেলা প্রক্ষেপণ জন্ম দেয় সঙ্গীতের। 
সুর যেন প্রবহমান তরঙ্গের সাথে মিশে বয়ে চলে উজান ভাটির টানে। ফসল উৎপাদন-কৌশল রপ্ত হবার পর  অযুত নিযুত বছর ধরে যাপিত যাযাবর জীবন কোনো এককালে থিতু হয় কোনো নদী অববাহিকায়, উপত্যকায়, হয়তো কোনো উপকূলে কিংবা অরণ্যে। যেখানে জীবনধারণের উপকরণ সমূহ তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য। নানা অঞ্চলে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ভাষিক জাতিগোষ্ঠী। জীবনের এইসব উপাদান নিয়ে কোনও অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস,পোষাক পরিচ্ছদ, গৃহনির্মাণ শৈলী, সামাজিক সম্পর্ক সমূহের সূচনা ও আচার অনুষ্ঠান, জীবনধারণের প্রধান উপাদান  খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠানাদি, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষের যাপিত জীবনের ছন্দোময় অভিব্যক্তিসমূহের সমন্বিত রূপের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আত্মপরিচয়ের প্রধানতম অবলম্বন জাতিসত্তার রূপ।  একই রকম ভূমির গঠন, একই জলবায়ু, খাদ্যাভ্যাস, পোষাক, সাদৃস্যময় জীবনযাপন পদ্ধতি, ভাষিক ঐক্য ইত্যাদি সমন্বিত উপাদানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে এক একটি জাতিসত্তার পরিচিতি গড়ে ওঠে।
ওইসব উপাদান সমূহের প্রতি সেইসব ভূ-খণ্ডের মানুষদের মনে যুগ যুগ ধরে বিরাজ করে  এক অসীম আবেগঘন অনুরাগ। একে নিয়ে তাদের আবেগ ও গর্বের শেষ নেই। মায়ের সমতুল বিবেচিত হয় এর মর্যাদা। 
হাজার হাজার বছর ধরে এরকম অসংখ্য জাতিসত্তার অস্তিত্ব রয়েছে এ দেশে। সেইসব মানুষদের বৈচিত্র্যময় জীবন শৈলী ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে মহিমান্বিত করেছে অজ্ঞাত অতীতকাল থেকেই। 
নানাধরণের বর্ণময় উৎসব, লোক-মেলা এবং সংগীত, নৃত্য সহ অসংখ্য নির্মিতির মাঝে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বৈচিত্র্যময় বহুত্ববাদী  ভারতীয় সংস্কৃতি। 
ওইসব ভাষা ও সংস্কৃতি ক্রমশ বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে লীন ; প্রকারান্তরে বলা যায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্রাস করে নেবার যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক এক প্রয়াস। ওইসমস্ত জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি  বৈচিত্র্যময় ভারতীয় সংস্কৃতিরই শেকড়বাকড়, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। ভারতবর্ষের মতো বহুভাষী ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময় একটি দেশ রাষ্ট্রীয় আয়োজনে যখন একটি বিশেষ অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধূয়া তুলে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন তা  ভারতবর্ষের আত্মাকেই রক্তাক্ত করার শামিল। ইদানীং গ্রামগঞ্জে বিশেষ ধর্মীয় বেশভূষায় সজ্জিত কিছু মানুষের গতিবিধি লক্ষ করা যায়, যাঁরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে খাদ্য/অখাদ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। বলাবাহুল্য এঁরা সকলকে সাত্ত্বিক আহারের নিদান দিচ্ছেন। এঁরা বলছেন, নিরামিষ খাবারে সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে। তা থাকে বৈকি!  নিরামিষ সহজপাচ্য খাবার। এই উপদেশ দুর্বৃত্তদের উদ্বৃত্ত পুঁজির দৌলতে শরীরে সঞ্চিত উদ্বৃত্ত চর্বি স্খলনের যথার্থ নিদান হতে পারে। নিদান হতে পারে অন্নচিন্তা রহিত কিছু সৎ সুখী মানুষের সুস্থতার। কিন্তু যে দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ অপুষ্টির শিকার তার বেলা? 
কর্মহীন কিংবা কর্মচ্যুত অসংখ্য মানুষ যারা দু'বেলা ভরপেট খেতে পায়না তার বেলা?ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে আমিষ কি নিরামিষ, সাত্ত্বিক কি অসাত্ত্বিক, তপ্ত কি পান্তা, ক্ষুধা নিবৃত্তি তারচেয়ে বেশি  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমিষ নিরামিষ প্রশ্ন নয়। অনন্তকাল ধরে যে খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত, যে খাবার  পরম তৃপ্তিদায়ক তাতে কারও হস্তক্ষেপ গুরুতর অপরাধ। এমন সংকীর্ণ ভাবনা দ্বারা চালিত ধর্মান্ধতা চর্চা দেশের ঐক্য ও সংহতির সংকট তৈরি করে। ভাষা, খাদ্যাভ্যাস সহ জাতিসত্তার অন্যান্য উপাদানগুলোকে রক্ষা না করে, তথাকথিত ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ওই সমস্ত জাতিসত্তার  অস্তিত্ব বিলীন করার ক্ষেত্রে  প্রকাশ্যে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। 
জাতিসত্তার পরিচিতিকে ম্লান করে কিংবা নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় চেতনার নির্মিতি অসম্ভব। একজাতি,  একধর্ম, এক সংস্কৃতি... এরূপ অপরিণামদর্শী অ্যাজেন্ডা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথকে সাময়িক প্রশস্ত করলেও বৃহত্তর পরিসরে আগামীর জন্য মোটেও মঙ্গলদায়ক নয়।এই সময়ে বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা করা প্রকৃত দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব।  এ ক্ষেত্রে দেশের সারস্বত সমাজের উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও  লক্ষণীয়। একে রোধ করা না গেলে  ক্রমবর্ধমান বৃহত্তর ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সুদৃঢ় ঐক্য বিঘ্নিত হবে। ব্যাহত হবে বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতির সুসংহত ভিত্তি।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.