জীবনের উত্তরণ ,জীবনের গল্প
উত্তরণ
""""""""""
(আমার চাকরি জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
রঞ্জনা গুহ ভট্টাচার্য্য
১৪.৩.২০২০
সালটা ২০০৭,৩১শে জানুয়ারী, মুর্মু সাহেবের রিটায়ারমেন্টের দিন।সেন্ট্রাল টেলীগ্রাফ অফিসের মুখ্য অধীক্ষক অর্থাৎ চিফ সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসাবে তিনি অবসর গ্রহণ করছেন,অফিস বিশাল আয়োজন করেছে। চারিদিকে ফুলের স্তবক, অনেক উপহার••সবাই কিছু না কিছু ভালো ভালো কথা ওনার সম্বন্ধে বলছে। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও পরিচালক হিসাবে আমি এবার সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললাম;-"এবার আমরা বিদায়ী সি.এসের মুখ থেকে ওনার জীবনের কিছু কথা শুনতে চাই।"
সবাই সমর্থন করল, কিন্তু মুর্মু সাহেব আমতা আমতা করে বললেন;-"কি হবে ম্যাডাম অতীতে ফিরে গিয়ে,এই তো বেশ আছি,আপনারা বলছেন আমি শুনছি••ভারী অন্ধকার দিনগুলোকে পেরিয়ে আজ এই এতো আলোর সি.এস চেম্বারে।"
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো;-"বলুন স্যার বলুন,সেই অন্ধকারের গল্পই বলুন,আমরা শুনবো।"
মুর্মু সাহেব চোখটা একটু ক্ষণ বন্ধ করে আবার খুলে বলতে শুরু করলেন;-"বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে তিন বছরের মধ্যে মা-বাবাকে হারাই, মাটির একটা বাড়ি ছিল কিন্তু একবার প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে সেটা ধসে গেল।সাত বছর পর্যন্ত এর বাড়ি ওর বাড়ির উচ্ছিষ্ট খেয়ে,রাতে কারোর গোয়ালঘরে চটে শুয়ে কাটিয়েছি। শীতের সময় ওই চট মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকতাম, কিন্তু সূর্য ওঠার আগেই গোয়ালঘর ছেড়ে পালাতে হতো,কারণ মালিক উঠে পড়লে তাড়া করত। এইভাবে চলছিল জানেন! হঠাৎ একদিন গাঁয়ের স্কুলের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশপাতাল ভাবছি, হঠাৎ একজন এসে জিজ্ঞেস করল,'খোকা ইখানে বেন্দাবন মুর্মুর ঘরটো কুথায় রে?'
আমি তখন ওই ভাষাতেই অভ্যস্ত ছিলাম, বললাম,-'উ ঘরটো তো কবেই ধুয়্যে গেছে,আর ঐ বেন্দাবন হুই ওপারে,মুই সনাতনটো আছি,বেন্দাবনের বেটা।'
ওমা!লোকটা আমার হাতটা ধরে বলল,-'আর তুর মা?'
আমি বললাম,-'উ তো কব্যেই গেছে,মনে লাই রে।'
লোকটা হু হু করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরল তারপর বলল,-'চল ক্যানে তুর মামাটো ইখনো ব্যেইচ্যে আছে।'
বুঝলাম ওই লোকটাই মামা কিন্তু সম্পর্কের মানে তখন বুঝতাম না,তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম,-'তুর সনে গ্যেলে তু আমাকে মুড়ি দিব্যি?'
লোকটা বলল,-'ভাইত দ্যিবো রে ভাইত।ইখন চল ক্যানে।'
পরে বুঝেছি ওটা মামার বাড়ি। মামার বাড়ি গিয়ে জীবনে প্রথম ভাত খেয়ে শরীর ফুলে সে এক কান্ড!আবার আদিবাসী গ্রামে তার ওষুধ শুনলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন, সারাদিন খালি গায়ে একটা বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে রাখা হলো আমাকে,সামনে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হল,সন্ধ্যেবেলা দেখলাম আমি আবার আগের সনাতন।
মামার অবস্থাও বিশেষ সুবিধার ছিল না,মামী রাতদিন চেঁচাত।মাস তিনেক পর জীবনে প্রথম ট্রেণে চেপে এলাম ঝাড়গ্রাম অনাথ আশ্রমে।সেখানে শুরু হল পড়াশোনা আর আশ্রমের কাজ।তবু কি জানি কেন পড়তে খুব ভালো লাগত,ক্লাস সেভেনে ডবল প্রমোশন পেয়ে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অনাথাশ্রমে এসে ভাগ্যের চাকাটা ঘুরে গেল। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বলে মঠের সন্ন্যাসীরা আমাকে পড়াতেন।এমনি করে হায়ার সেকেন্ডারির পাট চুকল, রেজাল্ট ভালো হলো কিন্তু আঠারো বছর হয়ে গেছে তাই অনাথ আশ্রম আর রাখবে না, ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়েছি কিন্তু পড়ার পয়সা নেই।সেইসময় আশ্রমের হিসাব পরীক্ষকের একটা পোস্ট খালি হতে আমি মহারাজকে অনুরোধ করলাম।চাকরি জুটল,দিনে কলেজ আর রাতে হিসাবের খাতা,আর মাঝরাত পর্যন্ত কলেজের পড়া।যখন থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ ফোর্থ ইয়ারে ক্লাস শুরু করব,এই টেলীফোনে জুনিয়র টেলীকম ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিটা পেয়ে গেলাম•••আর তারপর তো এই তেত্রিশ বছর কর্মজীবন শেষ করে আজ অবসর গ্রহণ করছি।হ্যাঁ,একথা ঠিক বাপ-মা মরা এই সনাতন যদি ঝড়জল,শীতে সাত বছর বয়স পর্যন্ত না বাঁচত,তাহলে কি আর আজকের রিটায়ারমেন্টের হিরো হতে পারত?"
এতক্ষণ বলে উনি একটু থামলেন,তারপর বললেন;-"তবে কি জানেন ঈশ্বর দেখিনি, কিন্তু আজ অনুভব করি ওই কথাটা সত্যি-'রাখে হরি মারে কে!''
সবাই নিশ্চুপ হয়ে বোধহয় এই কথাই ভাবছিল•••এ ভাবেও উত্তরণ সম্ভব!!. .. True story
কোন মন্তব্য নেই