ফ্রেঞ্চ পারফিউম নয়, সুগন্ধ ছড়াচ্ছে নির্ভেজাল চোখের জলে ও শ্রদ্ধায়
মেঘমালা দে মহন্ত
আমার বাবা মা যে কলেজে পড়াতেন সেই কলেজে তাঁদের সমস্ত সহকর্মীরা ছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো। আমি তখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি, ঠিক মনে নেই। কলেজে এক নতুন প্রফেসর জয়েন করেন। সদ্য এম এ পাশ করে আসা, লম্বা ফর্সা সুন্দর দেখতে। মায়ের কাছে জানলাম কলেজের ইংরেজির নতুন শিক্ষক, দীপক সোম নাম। কিন্তু মা ডাকছিল পিকু বলে। মা বলল, মায়ের ছোটোবোন মানে আমার ছোটোমাসির বন্ধুর ছোটো ভাই তিনি। বাড়ির নাম পিকু। সেই থেকে দীপক সোম স্যারকে চেনা জানার শুরু। আমার বাবাকে দাদা আর মা কে দিদি বলে ডাকতেন। তাই স্কুলজীবনে কখনও মামা কখনও কাকু ডাকতাম তাঁকে। পরবর্তীতে অবশ্য সেই ডাক 'স্যার'-এ স্থায়ী হয়।
স্কুল শেষে কলেজ জীবনে আমি আর ভাই কিছুদিন ইংরেজি পড়তে যেতাম তাঁর কাছে। খুব স্নেহ করতেন। রাগ হলে বকতেনও। মনে আছে একদিন রাগ করে আমাকে বলেছিলেন, আমি তো মাথায় কিছু দিতে চাই, না কি? তো মগজের ঘটিটা যদি সবসময় উল্টানো থাকে তাহলে মাথায় কিছু নিবি কী করে? আরেকদিন ভাই কে এমন বকছিলেন যে স্যারের মা শুনতে শুনতে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন , কাকে বকছিস রে অত? উত্তর দিয়েছিলেন আমার ছেলেকে । এই স্নেহের শাসন আমাদের ওপর চিরকাল ছিল তাঁর।
ছাত্রী থেকে পরবর্তীকালে তাঁর সহকর্মী হয়েছি। কিন্তু আমার সেই উলটানোঘটি মগজ নিয়ে তাঁর কাছে শেখার, বকা খাওয়ার পাট বন্ধ হয়নি কখনও। সঙ্গে যোগ হয়েছে কলেজে এসে দিনের প্রথম চা একসঙ্গে খাওয়া, দুপুরে বাচ্চাদের মতো ভাগ করে টিফিন খাওয়া। স্যারের সামনে পান মুখে দিতাম না প্রথম প্রথম। একদিন ডেকে সামনে বসিয়ে পানের বক্স দিয়ে বললেন, খা। তুই এখন আমার কলিগ। পান খেলে কিচ্ছু হয় না। ইচ্ছে হলে সিগারেটও খেতে পারিস।
কখনও বলতেন তুই আমার মেয়ে, আবার মাঝে মাঝে মা ডাকতেন।
গতবছর ডিসেম্বর মাসে সোমস্যার অবসর নিয়েছেন কলেজ থেকে। তার আগে পর্যন্ত আমার জন্য তিনি ছিলেন কলেজে একটা মরুদ্যানের মতো। বিশেষত নতুন কোনো বই পড়লে, ভালো কোনো গান শুনলে তিনি ছিলেন আমার ভালো লাগা ব্যক্ত করার, আলোচনা করার একনিষ্ঠ শ্রোতা। মন দিয়ে শুনতেন তারপর ব্যক্ত করতেন নিজের মতামত। বই পড়া প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, একদিন সন্তোষ কুমার ঘোষের " "শেষ নমস্কার শ্রী চরণেষু মা কে" বইটা কিনে পরদিন কলেজে নিয়ে আসেন আমাকে দেখাবেন বলে। হাতে নিয়ে বললাম, স্যার এই বইটা বহুদিন থেকে পড়ার ইচ্ছে, খুব শুনেছি বইটার কথা, পড়া হয়নি। আমাকে পড়তে দেবেন? বললেন, পেনটা দে। খসখস করে লিখে দিলেন আমার নাম। বললেন এটা এখন তোর বই। শুধু এই বই না, প্রচুর বই স্যার পড়িয়েছেন আমাকে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন অসাধারণ। পূজা পর্যায়ের গান গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলতেন প্রায় সময়৷
এমনিতে ছটফটে স্বভাবের বিশাল মানুষটা সমাহিত শান্ত হয়ে যেন অন্য এক জগতে চেলে যেতেন তখন।
কলেজে শিক্ষক জীবনের পাশাপাশি তাঁর ভেতরের একটা বাউন্ডুলে খ্যাপাটে মানুষকে সযত্নে আসকারা দিয়ে জিইয়ে রেখেছিলেন সোমস্যার ।নিজেদের মন্দ দিকগুলোকে ঢেকে রাখার যে আপ্রাণ চেষ্টা,আমাদের সবার মধ্যেই থাকে সোমস্যার ছিলেন সেসবের প্রতি দারুণ বেপরোয়া। ভালো-মন্দ, দোষ-গুণ মিলিয়ে যে জীবন সেই জীবন চুটিয়ে বেঁচেছেন আপোসহীন। তুচ্ছ বৈষয়িক হিসেব নিকেশকে শখ আহ্লাদের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেননি কখনও। অবসর নেবার বছর ঘুরতে চলছে, পেনশন পেয়েছিলেন মাত্র দু'দিন আগে। অনেক দুশ্চিন্তা, টেনশন পেরিয়ে নিশ্চিন্তে নির্ঝঞ্ঝাট অবসর জীবন ঘুরে বেড়িয়ে কাটানোর প্ল্যান সবে শুরু করেছিলে কিন্তু শরীর মন বোধহয় আর চাপ নিতে পারছিলনা। নীরবে বিদ্রোহ করে বসে। একটা দামী ফ্রেঞ্চ পারফিউম কিনবেন ভাবছিলেন, সময় পেলেন না। গায়ে সুগন্ধি ছড়িয়ে প্রিয় মোহরদির সুরের মৌতাতে বুঁদ হবার আগেই পাড়ি জমাতে হল দূরে কোথাও দূরে... দূরে...
থাক স্যার, ফ্রেঞ্চ পারফিউম না ই বা হল, আপনি কবে আর এসব তুচ্ছ জিনিসের জন্য হা হুতাশ করেছেন!যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আপনি আপনার ছাত্রছাত্রী, প্রিয়জনদের মনে সঞ্চিত করে গেছেন সেই সঞ্চয় আজ সুগন্ধ ছড়াচ্ছে নির্ভেজাল চোখের জলে।
এই অমূল্য তুচ্ছতায় আপনি খুশি হতে জানেন, আমি জানি।
কোন মন্তব্য নেই