Header Ads

ঘড়িকাকুর জীবনের ঘড়িটা সত্যিই থমকে গেল

অপ্রতিম নাগ

৩১শে অক্টোবর, ২০২১ ইংরেজি সকাল দশটা নাগাদ কলকাতা থেকে বরাকের সুসন্তান মনোতোষ চক্রবর্তী, যাকে আমি মান্তুকাকু বলে ডাকি, আমায় ফোন করে ধরা গলায় বললেন - "বাবুন, বরুণদা আধঘন্টা আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।" শুনেই মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে গেল । উনাকে ঘিরে অনেক স্মৃতি মনে উঁকি দিতে লাগল। 

আমার বাবা সাংবাদিক অমিত কুমার নাগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বরুণ দাসগুপ্ত। গত শতকের সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমার শৈশবকালে আমাদের গুয়াহাটির বাড়িতে উনি প্রায়ই আসতেন। এলেই উনার হাতের ঘড়িটা খুলে আমাকে খেলার জন্য দিতেন। সেই কারণেই আমি উনাকে 'ঘড়িকাকু' বলে ডাকতাম। ঘড়িকাকু সেই সময় 'দ্য পেট্রিয়ট' পত্রিকার গুয়াহাটি প্রতিনিধি ছিলেন। দেশে সেই সময় জরুরীকালীন অবস্থা চলছে। সাংবাদিকদের জন্য সেই সময়টা খুবই কঠিন ছিল। সংবাদ পাঠিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হত। আমার মায়ের মুখে শুনেছি যে প্রায় রোজদিনই ঘড়িকাকুর বৃদ্ধ বাবা ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন যে বাবা বাড়ি ফিরেছেন কিনা বা উনারা কোথায় আছেন সেই বিষয়ে মা কিছু জানেন কিনা।

বাবার মুখে সেই সময়ই শুনতাম যে ঘড়িকাকু শৈশবে মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্য ও আদর লাভ করেছিলেন। উনার কাকু সতীশ চন্দ্র দাসগুপ্ত গান্ধীজির অনুগামী ছিলেন এবং সোদপুরে একটি আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন। সেই আশ্রমেই ঘড়িকাকুর শৈশব অতিবাহিত হয়।

প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার কোন ডিগ্রী ঘড়িকাকুর ঝুলিতে ছিলনা, কিন্তু উনার জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অপরিসীম। আমার ছোটবেলায় মান্তুকাকুকে বলতে শুনেছি - "বরুণদা তথাকথিত শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্গত সামান্যতম মাধ্যমিক পাশও না।  কিন্তূ উনার ইংরেজি ও বাংলার ওপর যে দখল, তা পি.এইচ.ডি ডিগ্রিধারীদেরও হার মানাবে।"

আমাদের বাড়িতে যখন উনি আসতেন তখন বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষ করে আসামের নানা সমস্যা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করতেন। এই আলোচনার মাঝখানে একটু পরপরই আমার মা বিভিন্ন জলখাবার পরিবেশন করতেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে আমার মার্ তৈরী বিভিন্ন জলখাবার ও হাতের রান্না ঘড়িকাকুর খুব প্রিয় ছিল।

গত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে ঘড়িকাকু কলকাতা চলে যান এবং "আজকাল" পত্রিকায় যোগদান করেন। সেখানেই শিলচরের বিখ্যাত শ্যাম পরিবারের কন্যা প্রথিতযশা কবি রুচিরা শ্যামের সাথে উনার ঘনিষ্টতা হয় এবং উনারা একসাথে ঘর বাঁধার সিদ্ধান্ত নেন।

কলকাতা চলে গেলেও আসামের সঙ্গে উনার সম্পর্ক অটুট ছিল। প্রায়ই উনি আসামে আসতেন বিয়ের পর যখন তিনি প্রথমবার গুয়াহাটি আসেন,  সেই সময়ের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। একদিন দুপরবেলা বিশিষ্ট সাংবাদিক রবিজিৎ চৌধুরী, যাকে আমি 'ভালকাকু' বলে সম্বোধন করতাম, ঘড়িকাকুকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত। দূর থেকেই ভালকাকু প্রায় চিৎকার করে আমার মাকে ডেকে বললেন - "বৌদি, দরজা খুলুন। নতুন জামাইকে নিয়ে এসেছি।"

গত শতকের নব্বই দশকের শেষদিকে ঘড়িকাকু আবার 'দ্য হিন্দু' পত্রিকার উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়ে গুয়াহাটিতে ফিরে আসেন। তখন উনি চাঁদমারি অঞ্চলে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতেন। সেই সময় আমি মাঝে মাঝে উনার বাড়িতে যেতাম। রুচিরা কাকিমনিও প্রায়ই কলকাতা থেকে এসে বেশ কিছুদিন থাকতেন। তখন গিরীন নামের একজন অসমীয়া ছেলে উনাদের ঘরে সবসময় থাকতেন ও কাজ করতেন। গিরিনকে ঘড়িকাকু ও কাকিমনি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। কম্পিউটার সেই সময় সবেমাত্র আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি কিভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঘড়িকাকু স্ব-চেষ্টায় কম্পিউটার শিখে পুরো দক্ষ হয়ে গিয়েছিলেন।

এই শতাব্দীর শুরুতেই ঘড়িকাকু আবার কলকাতায় ফিরে যান। তার কারণ ছিল যে উনার কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং রুচিরা কাকিমনির পক্ষেও বারবার গুয়াহাটিতে আসা-যাওয়া  করতে অসুবিধা হচ্ছিল।

অত্যন্ত সৎভাবে জীবনযাপন করা ঘড়িকাকু  ও কাকিমনির  স্ব-সম্পত্তি বলতে তেমন কিছুই ছিলনা। শুধু ছিল সল্টলেক অঞ্চলের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট । ২০০৬ ইংরেজির নভেম্বর মাসে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিফ্রেশার কোর্সে অংশগ্রহণ করি। ঘড়িকাকুকে ফোন করলে উনি নিজে এসে আমাকে উনার ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। সেই সন্ধ্যায় ঘড়িকাকু ও কাকিমনির আথিতেয়তা আমি কোনদিন ভুলব না। খাওয়া- দাওয়া শেষ করে যখন হোস্টেলে ফিরে আসব, সেই সময় ঘড়িকাকু উনার নিজস্ব লাইব্রেরি থেকে আমার পছন্দমত কিছু বই নিয়ে যাবার জন্য আমাকে বললেন। উনার নির্দেশমত আমি কিছু বই বেছে নিয়ে আসি, যেগুলো খুব সযত্নে আমার কাছে রাখা আছে।

ফোনে আমি উনার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। এবার দূর্গা পুজোর পর বিজয়ার প্রণাম জানাতে উনাকে বেশ কয়েকবার ফোনে করি কিন্তূ উনি ধরেন নি। তখনই আমার মনে হয় যে উনার শরীর বোধহয় ভাল না। ২৮শে অক্টোবর মান্তুকাকু জানালেন যে ঘড়িকাকু মৃত্যুশয্যায়। তার তিনদিনের মাথায় এই চরম দুঃসংবাদ। ঘড়িকাকুর জীবনের ঘড়িটা সত্যিই থমকে গেল।

(লেখক শিলচরের গুরুচরণ কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয়  প্রধান)

 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.