Header Ads

হারালাম প্রজ্ঞাসম্পন্ন এক আপোষহীন সাংবাদিকতার প্রতিমূর্তিকে

রত্নজ্যোতি দত্ত

'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা হবে' - এ কথাটি ছোটবেলা থেকে শুনছি। বড় হওয়ার পর বুঝেছি, জন্ম আর মৃত্যু মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ, অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু কিছু লোক নিজেরদের জীবনকে এমনভাবে চালিত করেন যে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও লোকে মনে রাখে। বা, তাদের সম্পর্কে লিখে শ্রদ্ধা জানায়। আজ যার সম্পর্কে লিখছি তিনি এমনই এক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিকতার জগতে। 

প্রখ্যাত সাংবাদিক বরুণ দাসগুপ্তের সাম্প্রতিক প্রয়াণ আরো একবার ক্ষয়িষ্ণু আপোষহীন সাংবাদিকদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সাংবাদিকতায় তারা কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে, সাফল্যতার শিখরে পৌঁছেছেন। আর, সাংবাদিকতার জগতে ছেড়ে গেছেন নিজেদের ছাপ যা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।

প্রবীণ সাংবাদিকের প্রয়াণ সংবাদ আমার সাংবাদিকতার প্রারম্ভিক দিনের কিছু পুরনো স্মৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে তুলে। গুয়াহাটির সাংবাদিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন এক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সে সময়ের নৈতিক সাংবাদিকতার এক জীবন্ত প্রতীক। সবাই তাঁকে বরুণদা বলেই সম্বোধন করতেন।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে গুয়াহাটিতে বরুণদার সাথে অনেক অনুষ্ঠান যোগদান করার সুযোগ হয়েছিল। তখন আমার সাংবাদিকতার কর্মজীবনের সবেমাত্র শুরু।

এক অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে পরিচয় করে রিপোর্টিং সম্পর্কে টিপস নেওয়ার সাহস করি। তাঁর সাথে আলাপ করে রিপোর্টিংয়ের টিপস নেওয়ার জন্য বহুদিন ধরেই খুব আগ্রহী ছিলাম।  জানতে পেরেছিলাম যে সাংবাদিক হওয়ার জন্য বরুণদার কোনও প্রথাগত ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি ছিল না। আমিও কোন ডিপ্লোমা বা ডিগ্রী ছাড়াই রিপোর্টিং-এর আঙিনায় নেমেছিলাম। সে দিন সাহস জুটিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি কিভাবে একটি স্পট ইভেন্ট রিপোর্ট করেন। তিনি স্নেহশীলভাবে জানান সংবাদ প্রতিবেদনের ভূমিকাসহ প্রথম দুটি অনুচ্ছেদ অনুষ্ঠান বা ঘটনাস্থাল থেকে ফিরে আসার পথেই মাথায় ফ্রেমবন্দি করে রাখতেন। যখন তিনি কর্মস্থলে পৌঁছতেন, সে ঘটনা বা অনুষ্ঠানের খসড়া প্রায় তৈরি হয়ে যেত। তারপর, বাকি লেখাটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়ে যেত। পুরো প্রতিবেদনটি অতি সহজেই নিউজ ডেস্ককে পাঠিয়ে দিতেন অযথা সময় নষ্ট না করে।

বরুণদার পত্নী নামি লেখিকা রুচিরা শ্যাম আমার মায়ের স্কুলের সহপাঠী ছিলেন। সে পরিচয়সূত্রটি কিন্তু কোনো দিনই বলার সাহস জুটাতে পারিনি সম্ভ্রমে ও তার রাশভারী ব্যাক্তিত্বের কারণে। 

তিনি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে ৮৭ বছর বয়সে ৩১শে অক্টোবর কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বরুণদা বহু বছর ধরে গুয়াহাটিতে 'দ্য হিন্দু'র বিশেষ সংবাদদাতা ছিলেন। আরও টিপস নেওয়ার জন্য একদিন তাঁর চাঁদমারিস্থিত বাসভবনেও গেছিলাম। তিনি সেদিন একটি অমূল্য উপদেশ দিয়েছিলেন যা আজও শ্রদ্ধা সহকারে স্মৃতিচারণ করি। সাংবাদিক জীবনের প্রারম্ভিক দিনগুলিতে, অর্থনৈতিক বিষয়ক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হাত পাকানোর চেষ্টা করছিলাম। বরুণদা প্রথমে সাধারণ রিপোর্টিং-এ এক্সপোজার নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর, এর পরবর্তীতে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে বা বিষয়ে হাত পাকানোর উপদেশ দেন। "এই পথ চয়ন করলে তুমি ভবিষ্যতে আরও ভালো সাংবাদিক হতে পারবে"- বরুণদার এই আশীর্বাদ স্বরূপ কথাগুলো আজও কানে বাজে। গুয়াহাটি ছেড়ে দিল্লিতে আসার পর, সাংবাদিকতায় আমার আসল গ্রুমিং শুরু হয় প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া বা পি টি আই-এ যোগদানের পর। 

পিটিআই-এ নতুন যোগদানকারীদের সাধারণ সংবাদ সংগ্রহ ও প্রতিবেদন করানোর এক ড্রিল করানো হত। একবার সাধারণ সংবাদ সংগ্রহের কৌশল ও প্রতিবেদন লেখাশৈলীর সাথে পরিচিত ঘটলে, তাদের একটি নির্দিষ্ট বীট বা বিষয় কভার করার সুযোগ দেওয়া হত। এই অভিনব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন প্রশিক্ষণার্থী সাংবাদিককে ধীরে ধীরে একজন বিশেষ সংবাদাতারূপে তৈরি করা হতো । 

রয়টার্সডাও জোন্স নিউজওয়্যারস-দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সহ বিশ্ব বিখ্যাত সংবাদ সংস্থাগুলির সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে দু-দশকব্যাপী সাংবাদিকতার জীবনে। আজও এক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত আছি। তবে, আজ এখানে স্বীকার করতে হবে যে সাংবাদিকতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের যে কথাগুলো বরুণদা থেকে সংগ্রহ করেছিলাম তা পরবর্তী কর্মজীবনের পর্যায়ে সহায়ক হয়েছে। বিশেষ করে স্পট ইভেন্টগুলিকে কভার করার সময়।

বরুণদার শেষ লেখাটি নয়া ঠাহরের এবারের পুজোর সংখ্যায় ছেপেছে। প্রধান সম্পাদক অমল গুপ্তকে বরুণদা নিজের হাতের লেখায় পাণ্ডুলিপিটি পাঠান। অমলদা সে পাণ্ডুলিপিটি যা কিনা বরুণদার শেষ লেখা সযত্নে রেখেছেন। আর, আমিও সে পুজো সংখ্যাটিকে যত্ন করে রাখবো কারণ  অমলদা  সে সংখ্যায় আমারও একটি লেখা ও কবিতা প্রকাশিত করেছেন।

নব্বইয়ের দশকে উত্তর-পূর্বে অনেক উদীয়মান সাংবাদিক বরুণদার প্রজ্ঞা ও আপসহীন মানসিকতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। আর, আমিও তাদের মধ্যে একজন। 

[লেখক দিল্লি-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও নয়া ঠাহরের রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতা সম্পাদক।]

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.