Header Ads

গুরু প্রতি রাজনৈতিক ভাবশিষ্যের শ্রদ্ধাঞ্জলি


কে এম বাহারুল ইসলাম

করোনা কাল থেকেই অনেক গুরুজন, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজনদের অনেকেকেই হারিয়েছি। সেই বেদনা অহরহ যাতনা দেয় । মনের ভেতরে নিষ্ফল এক গভীর যন্ত্রনা কুরে কুরে খায় | এক গভীর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যখন দিন কাটাচ্ছি , সম্প্রতি সরকারী সফরে দেরাদুনে ছিলাম তখনই মেসেজ এলো আসামের আসামের প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব আব্দুল মুহিব মজুমদার সাহেব মজুমদার সাহেব পরলোকগত হয়েছেন [ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন] । উনার মহাপ্রয়াণে সমাজের যে কতটুকু ক্ষতি হলো তা হয়তো আমরা ভাবতে পারবো না কিন্তু আসাম তথা বরাকের মানুষ এক আইনের দিকপালকে হারালেন । ব্যক্তিগতভাবে আমার উনি ছিলেন আমার পরম হিতাকাঙ্খী এবং আমাকে যারপরনাই ভালোবাসতেন ।

সেটা বোধহয় ১৯৯৮ সালের কথা - তখন শিলচর আর ই ছি (এখন যা এন আই টি) 'তে পড়াচ্ছি। কলেজে ক্লাস নেওয়া ছাড়া শিলচর শহরে আর বেশি করার কিছু ছিল না, হাতে অফুরন্ত সময়। সন্ধ্যাকালীন যে কলেজ গুলো হয় সেগুলো পাস করা হয়ে গেছে - এলএলবি, বিএড এগুলো করে তখন পি এইচ ডি গবেষণায় মন দিয়েছি। হঠাৎ একদিন কলেজের অধ্যক্ষ (ড: আবু আহমেদ শামসুল হক বড়ভূঁইয়া ) ডেকে পাঠালেন। অনেকটা রাগের সুরে বললেন - আজকাল কি রাজনীতি করা হচ্ছে? উনার সেই প্রশ্নের কি কারন সেটা বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করছিলাম, তখন উনি বললেন যে সার্কিট হাউস থেকে ফোন এসেছে, আসামের জলসিঞ্চন মন্ত্রী নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন! আমাকে পাঠানোর জন্য নাকি জেলাধিপতি অধ্যক্ষকে ফোন করে বলেছেন। রাগ হওয়ার কথা বৈকি।

আমি কিন্তু সেই মন্ত্রী মশাই কে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম না। কিন্তু সেই ছোটকাল থেকেই আমার বাবার কাছে উনার মেধা এবং আইনি পান্ডিত্যের কথা, উনার সম্মানের কথা শুনে আসছিলাম। যাইহোক সেদিন বিকেল বেলায় শিলচর সার্কিট হাউসে সেই মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেই মন্ত্রীই ছিলেন আবদুল মুহিব মজুমদার। অনেকক্ষণ বিভিন্ন কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বললেন - তা কি করা হচ্ছে অধ্যাপক তো সবাই হবেন, হতে পারেন কিন্তু এই দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সময় দেয়ার মানসিকতা কি আছে? আমাকে আমার বাবার (মরহুম অধ্যাপক ফখরুল ইসলাম) কথা স্মরণ করিয়ে বললেন যে - মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখ, মানুষের কাজ করার জন্য তৈরি হও। উনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে বললেন যে উনি অনেক বেশি বয়সে নাকি রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন কারণ উনার আব্বা মরহুম আবদুল মতলিব মজুমদার সাহেবও ছিলেন আসামের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও প্রবীণ মন্ত্রী। উনার বাবার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে নাকি নাকি উনি (মুহিব মজুমদার সাহেব) নিজে অনেকদিন রাজনীতিতে পা রাখতে পারেন নি।

তারপর উনার প্রতি আমি আকৃষ্ট হই, অনেকটা ভাবশিষ্যের মতো। মনে মনে উনাকে গুরু মানতে শুরু করি। উনার সঙ্গে অনেকদিন চলাফেরা করেছি। আমাকে খুবই কম বয়সেই আসাম রাজ্যিক গ্রামীণ প্রযুক্তি পরিষদের অধ্যক্ষ নিযুক্তি দিয়েছিলেন। আমাকে উনার জীবনের অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন । প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতা, প্রত্যেকটি গল্প জীবনের অনেক গভীর জ্ঞান আমাকে দিয়েছে। উনি খুবই অমায়িক, শান্তশিষ্ট ভাবে কথা বলতেন। অনেকদিন দেখেছি উনার এলাকার লোক এসে বিভিন্ন ব্যাপারে রাগান্বিত ভাবে ওনার সঙ্গে কথা বলছেন কিন্তু তাকে এক মুহুর্তের জন্য রেগে যেতে দেখি নি। বরং অনেক বড় অনুযোগ, অভিযোগ এলেও উনি শুধু মুচকি হাসির মাধ্যমে জবাব দিতে পারতেন। রাগে অগ্নিশর্মা ব্যক্তিকেও উনার চেম্বারে ঢুকে গলে জল হয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। আজ উনার সমস্ত কথা, জীবনের গল্প, সমস্ত জ্ঞানের কথা, সমস্ত উপদেশ কেবলই থেকে থেকে মনে পড়ছে। যতদিন চেম্বার এ বসতেন, গৌহাটিতে গেলেই ওনার সঙ্গে দেখা করতাম। অনেক লোকের ভিড় থাকলেও আলাদা করে ডেকে নিয়ে অনেক সময় ধরে গল্প করছেন, আমার কাজের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, আরো অনেক কাজের কথা বলেছেন। শেষ যেদিন দেখা হয় (দেশপ্রেম নিয়ে আলোচনার সময়)-টেবিলের উপর রাখা "বাবর নামা" বইটি দেখিয়ে পড়তে বলেছিলেন। বাবর যুদ্ধ জয় করে দিল্লীর অধিপতি হয়েও নাকি তার জন্মস্থান ফরগনার স্মৃতি আঁকড়ে ব্যাকুল থাকতেন। উনার বক্তব্য ছিল নিজের জন্মস্থান থেকে বড় আরামের জায়গা হয় না, হতে পারে না। উনার পরামর্শ মতো কিন্তু "বাবরনামা" বইটি পড়া হচ্ছিলো না, কিন্তু গতমাসেই বাবরের উপর নির্মিত এক টিভি সিরিয়াল নিয়ে ইদানিং উঠা বিতর্কের সূত্র ধরে, "বাবারনামা"র ইংরেজি/বাংলা দুটো সংস্করণই আমাজন থেকে আনিয়ে পড়লাম। বইটির প্রতিটি পাতা পড়ার সময় জনাব মুহিব মজুমদারকে স্মরণ করেছি, উনি হাসপাতালে আছেন - আর কথা বলছেন না। মন যেন কু গাইছিলো

কিছুদিন ধরেই শুনছিলাম উনি ভীষণ অসুস্থ। কারো সঙ্গে দেখা করছেন না বা ওনাকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। উনার সঙ্গে দেখা হয়নি যেন অনেকদিন, কেবল হাইকোর্টের বন্ধুদের মাধ্যমে খবর নিচ্ছিলাম। আজও কানে বাজে বিভিন্ন সময়ে কত কিছু বলে গেছেন আমাকে। মনের আয়নায় একেকটা ক্ষন ভেসে উঠে, উনার বলে দেয়া এক একটা কথা এখনো কানে বাজে। জীবনে চলার পথে উনার উপদেশ কত কাজে দিয়েছে কত জায়গায়, উনার কথা মনে করে নিজেকে ধন্য মনে করি। আজ উনার বলে যাওয়া কথা সব এখানে লেখা সম্ভব নয় তাই যদি সর্বশক্তিমান আমাকে সামর্থ্য দেন কোন একদিন হয়তো উনার কাছ থেকে শোনা সব কথাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লিখে রাখবো   হয়তো সেটাই হবে উনার বিদেহী আত্মার প্রতি আমার পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ।

আজকে কেবল উনার একটা গল্প বলে শেষ করব। ২০০৬ সালে যখন প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার আগ মুহূর্তে উনার সঙ্গে দেখা করে উনার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি তখন উনি হেসে হেসে আমাকে বলেছিলেন - খুব কম ভোটে যাতে না হারি, তাহলে নাকি অনেক কষ্ট কপালে আছে! এক বিশাল সংখ্যক মানুষের ভোট পেয়েও যখন বিধায়ক হতে পারবো না তখন নাকি সেই জনগনও আমাকে ছাড়বে না,আর না আমি সেরকম কিছু সাহায্য করতে পারবো। কারণ দুই নম্বর স্থানাধিকারীর জন্য "উপ-বিধায়ক" বলে কোন পদ নেই। সেইসঙ্গে হেসে হেসে বলেছিলেন হারলেও যাতে খুব বেশি সংখ্যক ভোটে হেরে যাই! তাহলে নাকি নিজের প্রফেশনাল জায়গায় মনের শান্তিতে কাজ করা যায়, কারণ বেশি ভোটে হারিয়ে দেওয়া প্রার্থীকে জনগণ আর বেশি তাড়া করে না! উনি নিজের উদাহরণ দিয়ে হেসে হেসে বলেছিলেন - "যখন ভোটে জিতি তখন রেকর্ড ভোটে জিতি, আর যখন হারি তখন দুই-আড়াই হাজার ভোট আমাকে জনগণ দেন। তাই মনের শান্তিতেই পরের পাঁচ বছর উকালতি করতে পারি। তারপর যখন আবার কিছু টাকা পয়সা জমে তখন আবার সেই জনগণই আমাকে আবার ডেকে নেন।" যাইহোক আমার দুটোই অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি মজুমদার সাহেবের সেই গল্পের মর্ম !

[লেখক উত্তরাখণ্ডের কাশীপুরস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট-এ গণনীতি এবং শাসনতত্বের এর প্রধান অধ্যাপক।]

 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.