ভারতীয় রাজনীতির 'মৌসম বিজ্ঞানী'র পটভূমি ছাপানোর অনন্য কাহিনী
-রত্নজ্যোতি দত্ত-
জীবনে সবাই নিজের পটভূমিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। আর কারোর যদি জীবনের সামাজিক পটভূমি ভারতের অবহেলিত সমাজ হয়ে থাকে, তা হলে সেই পটভূমি জীবনদ্দশায় ছাপানো প্রায় অসম্ভব। এমনি এক পটভূমি ছাপানোর গল্পের নায়ক তিনি যাকে নিয়ে এ লেখাটি।
গত বছর, যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাম বিলাস পাসোয়ানের দুঃখজনক মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারি, তখন আমি তাঁর ব্যক্তিত্বের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খানিকটা আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ি। দু'দশক ধরে দেশের রাজধানীতে সাংবাদিক হিসাবে কাজ করার সময় অনেকবার পাসোয়ানকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাকে পিটিআই, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং রয়টার্সের সাংবাদিক হিসাবে বহুবার কভার করেছি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন প্রথম জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের মন্ত্রিসভায় পাসোয়ান দেশের খাদ্যমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তার সাথে দেখার কথা মনে পড়ছে। রয়টার্স সংবাদদাতা হয়ে সংসদে পাসোয়ানের চেম্বারে সাথে দেখা করার কথা আজও মনে পড়ে। সে সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী পাসোয়ান জানতে চেয়েছিলেন যে তাঁর মন্ত্রণালয়ের সমন্ধে আমার কিছু বলা আছে কিনা। তাকে বলেছিলাম খাদ্য মন্ত্রকের ওয়েবসাইটটি গুরুত্বপূর্ণ মাসিক খাদ্যশস্য স্টক ডেটা আপডেট করা হয়নি। কারণ সর্বশেষতম সংখ্যাগুলি বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের মুখ্য উপাদান ছিল। তিনি তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি একজন আইএএস অফিসারকে বিষয়টি সম্পর্কিত আমার সুনির্দিষ্ট ভাবনাগুলি জানানোর জন্য টেবিলে থাকা ইন্টারকমে সে মুহূর্তেই যোগাযোগ করেছিলেন। ওয়েবসাইট আপডেট করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়া বলার পর, পাসোয়ান পিএসকে প্রয়োজনীয় কাজটি তাড়াতাড়ি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
একজন সাংবাদিকের পরামর্শটি তিনি প্রকাশ্যে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা দেখে অবাক হয়েছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় শরদ পাওয়ারের মতো হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতা খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এক দশক ধরে খাদ্য মন্ত্রকের সম্পর্কে অভিজ্ঞতার কথাও তাকে জানিয়েছিলাম। তিনি খুব মনোযোগ সহকারে সে অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন।
এখানে একটা ছোট্ট ঘটনার কথাও উল্লেখ করবো যা আমার মনে হয় না খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে। পাসোয়ান মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে খাদ্য মন্ত্রনালয়ের বিট সংবাদদাতাদের আমন্ত্রিত করেছিলেন নিজের জনপথস্থিত সরকারি বাসভবনে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও সেদিন আমন্ত্রিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হোস্টের পরিবারের সাথে দেখা করে চলে যাওয়ার পর আমরা মন্ত্রীর বাসভবনে প্রবেশ করি। আমরা ড্রইং-রুমে বসে পাসোয়ানের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ গৃহকর্তা সাংসদ পুত্র চিরাগ পাসোয়ানকে নিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি ছেলের সাথে প্রবেশের সময় একটি দামি আর্টফেড মেঝেতে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ল। কারণ সৌজন্যতার চিহ্ন স্বরূপ আমরা বসার অবস্থান থেকে উঠতে তড়িঘড়ি করেছিলাম। আর, তখনই এক সাংবাদিক বন্ধুর পা লেগে আর্টফেডটি মেঝে পড়ে ভেঙে যায়।
আমাদের অবাক করে, হোস্ট বিন্দুমাত্র হতাশার লেশ ছাড়াই হাসতে থাকেন এ ঘটনাকে তুচ্ছ করে দিয়ে। বিব্রত সাংবাদিককে তিনি মোটেই অস্বস্তিবোধ করবেন না বলে অভয় দিয়েছিলেন। অপ্রতিকর ঘটনাটিকে একেবারেই গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ছেলের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
জাতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইতে এক কিংবদন্তি রয়েছে রাম বিলাস পাসোয়ানকে নিয়ে। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার জন্য পাসোয়ান ভারতীয় রাজনীতির আঙ্গনে 'মৌসম বৈজ্ঞানিক' বলে সমাদৃত ছিলেন। নিৰ্ভুল দূরদর্শিতা পাসোয়ানকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে প্রাসঙ্গিক রাখে। ভারতের প্রিমিয়ার নিউজ এজেন্সির প্রবীণ সাংবাদিকেরা বলতেন যখনই পাসোয়ান কোনও পিটিআইয়ের সাংবাদিককের সাথে আলাপচারিতা করতেন তখন তিনি একটি কথা প্রায়ই বলতেন - পিটিআইয়ের রিসেপশনে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমি রাজনীতিতে রাম বিলাস পাসোয়ান হয়েছি।
তিনি ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের এমন একজন রাজনৈতিক নেতা যিনি সাংবাদিকের যে কোনও সমস্যায় সহায়তা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। আমার এক সাংবাদিক সহকর্মীর এরূপ অভিজ্ঞতার কথাও মনে পড়ছে। তিনি একবার তাঁর স্ত্রীকে গাজিয়াবাদ জেলার ইন্দিরাপুরাম এলাকায় বাসভবনের নিকটবর্তী একটি শাখায় গুরগাঁও থেকে স্থানান্তর করার ব্যক্তিগত অনুরোধ নিয়ে পাসোয়ানের সাথে দেখ করেছিলেন। সাংবাদিক বন্ধু বিহারের দারভাঙ্গা জেলার বাসিন্দা এবং সমাজের উচ্চবর্ণের লোক।
সাংবাদিক বন্ধুবর যখন দেখা করার উদ্দেশ্যের কথা বলেন মন্ত্রীকে, তখন তিনি সাথে সাথে দেখা চলাকালীনই সংস্থার মালিককে ফোন যোগাযোগ করেছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে স্থানান্তরের জন্য অনুরোধ জানান। বলা নিস্প্রয়োজন যে মন্ত্রীর অনুরোধটি মেডিসিনের শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট হাউস রেখেছিলো। তৎকালীন সে নবদম্পতি দেড় দশক পরও মন্ত্রী পাসোয়ানের উপকারের কথা শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ করেন।
পাসোয়ান সবচেয়ে বেশি ভোটের মার্জিনে জয়ী হওয়ার জন্য গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লিখিয়েছিলেন। তার সার্থকতা তিন দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা নয়। বরং, সহজ সরলভাবে প্রতিটি মানুষের সাথে মনে দাগ কাটার মতো করে মেলামেশা করার সহজাত প্রবৃত্তিই পাসোয়ানকে অন্য রাজনীতিবিদের থেকে আলাদা করে। তিনি নিজের পটভূমিকে ছাপিয়ে নিজেকে এক বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হওয়ার নিদর্শন রেখে গেছেন।
পুত্র চিরাগ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা পশুপতি কুমার পারসের মধ্যে উত্তরাধিকারের লড়াই কিন্তু বিদেহী মহান আত্মার জীবিতকালের ব্যাক্তিত্ত্বের পরিপন্থী।
[লেখক দিল্লিতে কর্মরত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক।]
[সৌজন্য : নয়া ঠাহর পুজো সংখ্যা ২০২১]
কোন মন্তব্য নেই