Header Ads

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার কি আদতেই সবথেকে বড় কৌশলগত ভুল !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে একহাত নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালিবানদের হাতে চলে যাওয়ার জন্য দায় এড়াতে পারেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের কারণেই তালিবানরা আফগানিস্তান দখল করে নেয় বলেই মনে করছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের অধীনেই আগের প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের জন্য ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালিবানদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল এবং আফগান সরকারের (গনি) সঙ্গে শান্তি আলোচনার ওপর জোর দিয়েছিল। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিদেশী সৈন্যরা তাদের প্রত্যাহার চূড়ান্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই তালিবান যোদ্ধারা আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে এবং আশরাফ গনির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তালিবান গোষ্ঠীর এই বিরাট ধাক্কা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে এবং আমেরিকাসহ অনেক দেশ এখন আফগানিস্তান থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে চাইছে। বাইডেন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কাবুল বিমানবন্দরে পরিষেবা ব্যাহত করার কোনো প্রচেষ্টা হলে তার ফল ভালো হবে না। তিনি দ্রুত এবং জোরালো প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তালিবানদের সাবধান করে দেন।

বাইডেন বারবার তাঁর সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে যুক্তিযুক্ত বলে দাবি করেছেন। তাঁর দাবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশন ছিল আফগানিস্তানে আল কায়েদার সংগঠনগুলিকে নির্মূল করা, তা তাঁরা করতে সক্ষম হয়েছেন। আল কায়েদাকে ধ্বংস করার পর আফগানিস্তান নিয়ে আর বিশেষ কোনো মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। আফগানিস্তানকে আল কায়েদা মুক্ত করার পাশাপাশি ওসামা বিন লাদেনকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য আমরা আফগানিস্তানে গিয়েছিলাম। আমরা তা করতে সক্ষম হয়েছি এবং চিরকালের মতো যুদ্ধ শেষ হয়েছে !
আমেরিকার বক্তব্য কিন্তু খুবই সরল এবং গ্রহণযোগ্য বলে আমার মনে হয় না। পাকিস্তান যখন থেকে চিনের পদতলে নিজেদের সমর্পণ করেছে তখন থেকেই পাকিস্তান আমেরিকার প্রেমিকের তালিকা থেকে খারিজ হয়ে গেছে। ফলে পাকিস্তান বা চিনের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে আফগানিস্তানের মাটি এই দুই দেশের হাতে অনায়াসে তুলে দিয়ে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে পালাবে বা কেটে পড়বে এটা মেনে নেওয়া খুব সহজ হচ্ছে না। পাক-চিনের সঙ্গে তাদের বন্ধুরাও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার উপস্থিতির বিরুদ্ধে বহুদিন থেকেই জল ঘোলা করার চেষ্টা করে আসছে। আফগানিস্তানে 'মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মাতব্বরী' এইসব দেশগুলো বরদাস্ত করতে পারছিল না। রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে শুরু করে যে কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে এরা এই বিষয়টিকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এসেছে্। যদিও পাকিস্তান চিন এবং তাদের মিত্র দেশগুলো জানে--তালিবান আদতে সাংঘাতিক সব জঙ্গিবাদি আতঙ্কবাদী দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এবং বিশ্বের সিংহভাগ দেশই যখন আতঙ্কবাদীদের নির্মূল করার উপায় অনুসন্ধান করছে তখন তালিবানের পাশে থেকে তাদের সমর্থন জানানোর কথা যারা ভাবে বা ভাবতে অনুপ্রাণিত করে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক।
চারপাশ থেকে ভারতকে ঘিরে ফেলার মরিয়া চেষ্টায় ব্যস্ত চিন যখন পাকিস্তানের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে তালিবানের সমর্থনে এগিয়ে আসে তখন আমেরিকার প্রকৃত উদ্দেশ্যটা সফল হয়ে ওঠে। আমেরিকা বিশ্বকে দেখাতে চাইছিল পাকিস্তান তো বটেই--চিনও মধ্যযুগীয় বর্বর আতঙ্কবাদকে মদত দিতে একটুও বিব্রত বোধ করে না ! আমেরিকার মতো ভারতের হাতেও পাক-চিনের এই গভীর ষড়যন্ত্রের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে--ফলে ভারতের উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক। চিনের পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান স্পনসরড্ জঙ্গি তৎপরতা ভারতে--বিশেষ করে কাশ্মীরে যে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে তা ভারতের পক্ষে বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। সামরিক দিক থেকে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তানের মাটি এত সহজেই পাক-চিনের হাতে আমেরিকা ছেড়ে চলে যাবে--বিষয়টা অত সাধাসিধে নয়। বিশ্বের সামনে পাকিস্তান ও চিনকে আতঙ্কবাদীদের মদতদাতা হিসেবে প্রমাণ করাই অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার। আমেরিকা জানে--আফগানিস্তান ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। নৃশংস অমানবিক তালিবানী শাসনে গোটা দেশজুড়ে আগুন জ্বলতে থাকবে। নারী ও শিশুমেধ যজ্ঞের ভয়াবহতা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেবে। আক্রমণ নীতিতে ভারত বিশ্বাস করে না। আলোচনা ও শরণ-ই হল ভারতের বিদেশনীতি। তবে, তালিবানের সঙ্গে ভারতের পক্ষে আলোচনার টেবিলে বসা ভারতের পক্ষে শুধু কঠিন-ই নয় বলা যায় অসম্ভবও। তাই এখন ভারত 'শরণ নীতি'র কথাই ভাবছে। আক্রমণের কথা ভাবছে না। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই আফগানিস্তানের ছবিটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যাবে। নর্দার্ন এলায়েন্স আগামী ১৫-২০ দিন বেশ কিছু দেশের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা পাবে (বিশেষ করে ফ্রান্সের)। তালিবান ক্ষমতাসীন হবেই--এটা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলার সময় হয় নি। গৃহযুদ্ধে আফগানিস্তান ছন্নছাড়া হয়ে গেলে বিশ্বমানবতার ধ্বজা ধরে আমেরিকা ফের আফগানিস্তানকে 'বাঁচাতে' আসরে নেমে পড়বে। কারণ, তাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজেণ্ডা--আতঙ্কবাদীদের নির্মূল করা--সেটা এখনও হয় নি। ইতিমধ্যেই আরও অনেক ওসামার জন্ম হয়ে গেছে--তাদের তাণ্ডবও ভালমতোই টের পাচ্ছে গোটা দুনিয়া। ফলে কিছুদিন বিরতির পর আমেরিকা স্বমহিমায় আফগানিস্তানে উদয় হবে। আমেরিকা ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানে ১৮ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করেছে--৮ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে আফগান সেনাবাহিনীকে খাড়া করার জন্যে। এসব কিছু একেবারে বিস্মৃত হয়ে আমেরিকা সুবোধ বালকের মতো ঘরে ঢুকে যাবে--এটা আমার একেবারেই মনে হয় না। তালিবানকে পিছু হটতেই হবে--তার অন্যতম প্রধান কারণ হল--তালিবানের পাশে আফগানিস্তানের সিংহভাগ মানুষই নেই। তালিবানের নামে যে বকলমে পাকিস্তানই আফগানিস্তানকে কব্জা করতে চাইছে তা আফগানদের অজানা নয়। ইতিমধ্যেই পাক-আইএসআই প্রধান কান্দাহারে গুছিয়ে বসে পড়েছেন। যদিও পাকিস্তানের এবং চিনের এই মহাভোজের আয়োজন লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে শেষপর্যন্ত। একটাই চরম কথা--আমেরিকা আফগানিস্তানের তালিবান শাসনকে সাদ্দামের পরিণতি একদিন না একদিন দেবেই !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.