আফগান পরিস্থিতি ও জো বাইডেন !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেলে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের তুমুল আলোচনা মাঝে মাঝেই শুনছিলাম। অনেকেই দাবি করছেন জো বাইডেনের মতো দুর্বল প্রেসিডেন্ট আমেরিকাতে এর আগে দেখা যায় নি। তালিবানী হুকুমের কাছে বাইডেন নতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন ! কেউ দাবি করছেন--তালিবানদের সঙ্গে বাইডেনের নাকি গোপন চুক্তি হয়েছে--কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সেই তালিবানের সঙ্গে গোপন চুক্তি করবেন যাদের সঙ্গে আল কায়েদার মৌলিক কোনো চারিত্রিক পার্থক্য নেই--যে তালিবান আফিগানিস্থানে গুছিয়ে বসার আগেই পাকিস্তান সরকার পোষিত আইএসআই ও খতরনাক জঙ্গি সংগঠন ছাড়াও আইসিস খোরেসান বিপুল বিক্রমে গোলাগুলি ছুঁড়ছে ও একের পর এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটাতে শুরু করে দিয়েছে এবং তাদের আক্রমণে ১৩ জন (বিশেষ সূত্র মতে) মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে তাদের সঙ্গে বাইডেন গোপন চুক্তি করে আমেরিকার কোন্ স্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছেন সে সম্পর্কে কিন্তু কেউ তেমন কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না--যা যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ পর্যন্ত শপথ নেওয়া রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে বাইডেন সিনিয়ারমোস্ট রাষ্ট্রপতি--সামরিক অভিজ্ঞতাও তার কিছু কম নয়--সর্বোপরি দীর্ঘ সংসদীয় রাজনৈতিক জীবন থেকে তিনি কিছুই শেখেন নি বা প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা ও সাহস সঞ্চয় করেন নি--এমনটা ভাবার বিশেষ কোনো কারণই নেই। আলকায়েদার কোমর ভাঙতে এবং লাদেনকে হাতের মুঠোয় পেতে আমেরিকা আফগানিস্থানে ঘাঁটি গেড়েছিল--এটা মিথ্যে নয়--কিন্তু এটাও সত্যি নয় যে আমেরিকা রাতারাতি ভয়ঙ্কর আতঙ্কবাদ সম্পৃক্ত তালিবান সম্পর্কে তাদের ধারণা এতটাই বদলে ফেলেছে যে তারা তালিবানের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে লালচিন ও রাশিয়ার আগ্রাসনকে ঠেকাবার কথা ভাববে। আমেরিকা অনেক আগে থেকেই জানে চিন আফগানিস্থানের মাটি মার্কিনসেনা মুক্ত করার তাগিদে তালিবানকে মদত দিয়ে আসছে--তালিবানের সঙ্গে পাকিস্তান এবং অন্যান্য অঞ্চলের আতঙ্কবাদী সংগঠনের সম্পর্ক রয়েছে জেনেই চিন পাকিস্তানের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত সখ্যতা তৈরি করে তালিবানকে মদত দিচ্ছে। একদা আমেরিকার মিত্র পাকিস্তান এখন আমেরিকার হাত ছেড়ে চিনের হাত ধরায় আমেরিকার আফগাননীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমেরিকা এক ঢিলে বেশ কিছু পাখি মারতে চেয়েই সেনা প্রত্যাহারের রাজনীতিতে তালিবানকে জড়িয়ে নিতেই তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়েছিল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গোটা দুনিয়ায় পাকিস্তান ও চিনের আতঙ্কবাদী সম্পৃক্ততা এক্সপোজ করা। পাশাপাশি আমেরিকার সেনা বাহিনী প্রত্যাহার করা নিয়ে যে টালবাহনা চলছিল তার প্রধান কারণই ছিল আমেরিকার একটি বিশেষ দাবি--তারা সেনা প্রত্যাহার করে নিলেই আফগানিস্থানে চরম নৈরাজ্য এবং গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে--প্রচুর ধ্বংস এবং হত্যাকাণ্ড ঘটবে। বাস্তবে ঠিক সেটাই ঘটেছে। আমেরিকা জানে এবং বিশ্বাস করে তালিবান আছে তালিবানেই। আফগানিস্থানের প্রকৃত আফগানীদের মধ্যে তালিবানের গ্রহণযোগ্যতা নেই। হাজারে হাজারে আফগান নাগরিক তাই তালিবানের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দেশ ছাড়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তালিবানের বিশ্বাস এবং শাসন ক্ষমতা গড়ে তোলার যোগ্যতা নেই। সেপ্টেম্বরের প্রথমার্দ্ধে তালিবান যদি প্রবল মতপার্থক্য সম্বল করে একটি সরকার গঠনও করে তাহলে তা খুব বেশি দিন টিকবে না। দেশের মানুষের কাছে যেমন তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই বিশ্বেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। চিন ও পাকিস্তান ছাড়া খুবই নগণ্য দু’একটি দেশ তাদের ক্ষণস্থায়ী সরকার গঠনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানালেও বৃহত্তর বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
১৩-জন মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা এবং ইচ্ছে কোনোটাই বাইডেনের যে নেই তা আজ তার কড়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। ঘটনার গতিপ্রকৃতি মার্কিন প্রশাসনের অনুমানকে সত্যি করেই এগিয়ে চলেছে। তালিবানকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার ব্যাপারে বাইডেন যদি সাহসের অভাব দেখান তাহলে আমেরিকার জনগণের মধ্যেই ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে যা সামলানো খুব সহজ হবে না। যে ভাবে শত শত মানুষকে গুলি করে বোমা মেরে হত্যা করা হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া খুব সাধারণ হওয়ার কথা নয়। তালিবান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের সেটা বুঝতে খুব দেরি হবে না। তালিবানী শাসন যদি বিশ্বের শক্তিধর তথা বৃহৎ প্রভাবশালী দেশগুলোর স্বীকৃতি না পায় তাহলে শুধু তালিবানই নয় চরম ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে পাকিস্তানকেও। মানবাধিকার গণতন্ত্র এবং সভ্য ভদ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাসহীন কোনো উগ্র আতঙ্কবাদী সরকারকে দুনিয়ার কোনো শক্তিশালী ও প্রভাবশালী দেশ মান্যতা দেবে না। রাশিয়াও পারবে না তালিবানী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে--যদি দেয় তাহলে অনেক দেশের সঙ্গেই তাদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হবে। রাশিয়া তালিবানের মতো একটা জঙ্গিপুষ্ট সরকারকে সমর্থন করে নিজেদের বড় ক্ষতি করবে বলে মনে হয় না।
এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা যদি ফের আফগানিস্তানে গণতন্ত্র মানবাধিকার ফেরাতে সসৈন্যে ফিরে আসে তাহলে অনেককেই মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হবে। আফগানিস্তানে ভারতের ২২ হাজার কোটি টাকার কাজকর্ম চালু রয়েছে। আমেরিকা ইতিমধ্যেই ১৮ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করে ফেলেছে এবং আফগান সেনাবাহিনীর পেছনেও ৮ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করেছে। সুতরাং আফগানিস্তান সম্পর্কে রাতারাতি নিস্পৃহ ও উদাসীন হওয়ার কোনো কারণই আমেরিকার নেই। যদি তাদের নিস্পৃহ বলে মনেও হয় তবে সেটা আমেরিকার একটা বিশেষ কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যাপারটা স্পষ্ট হতে খুব বেশি সময় লাগবে না ! বাইডেন কিন্তু রীতিমতো ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছেন !!
কোন মন্তব্য নেই