Header Ads

এখনই বিজেপি ছাড়বেন না মুকুল রায় !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১-এর জুন--এই দীর্ঘ প্রায় চার বছর ধরে মুকুল রায় বঙ্গ বিজেপিতে রয়েছেন। রাজ্য রাজনীতিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক বঙ্গ বিজেপিকে তিনি পর পর দুটি নির্বাচনে (২০১৮'র পঞ্চায়েত, ২০১৯'র লোকসভা) কতটা প্রাসঙ্গিক করতে পেরেছেন তা রাজ্যবাসী মাত্রেই জানেন। তথাকথিত বিজেপি'র কিছু আদি নেতাকর্মী মুকুলের অবদানকে নস্যাৎ করে দিয়ে নিজেদের কেরামতি'র প্রসঙ্গেই মশগুল থাকবেন এবং থাকছেনও। রাজ্য রাজনীতিতে পঞ্চাশের দশক থেকেই বঙ্গ বিজেপি নেতাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কেরামতির ইতিহাসও কারুর অজানা নয়। এমন কী ২০১৪ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রে বিপুল শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় বসার পর দু'দুটি বছর সময় পেলেও মোদী-শাহ'রা বাংলায় দাঁত ফোটাতে পারেন নি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মুকুল ছিলেন তৃণমূলের ভোট ম্যানেজার--বিজেপিকে মাত্র তিনটির বেশি আসনে দাঁত ফোটাতে দেন নি মুকুল রায়। সেই মুকুল রায় তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে আসার পর রাজ্যরাজনীতির ছবিটাই প্রায় আমূল বদলে গেল। রাজ্যরাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল বাম তথা সিপিএম এবং কংগ্রেস। তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলো বিজেপি--শুধু তাই নয়--২০১৯-এর নির্বাচনে বিজেপি ১৮-টি আসন দখল করে গোটা দেশকে চমকে দিল। এই চমকের প্রধান কারিগর ছিলেন মুকুল রায়।

কিন্তু কী পেলেন মুকুল রায়? মাথা ঘুরে গেল বিজেপি'র--তাদের মনে হল--মুকুল রায় নয় তাদের রাজনৈতিক সাফল্য এসেছে দিলীপ ঘোষ-স্বপন দাশগুপ্ত-রাহুল সিনহা-সায়ন্তন বসু-রাজু ব্যানার্জ্জী-প্রতাপ ব্যানার্জ্জী-মোহিত রায়দের কেরামতিতেই। ফলে মুকুলকে কোণঠাসা করে বাংলা দখলের কৃতিত্ব লুফে নেওয়ার উৎকট আগ্রহে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘাশ্রিত লবি মুকুলকে নিষ্ক্রিয় রাখার জন্যে বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থী করে একটি কেন্দ্রে আটকে দিল। এতে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি শিকারও হয়ে গেল। মুকুলকে রাজ্যসভায় পাঠাবার দরকার থাকল না--কেন্দ্রে মন্ত্রী করার দায় থাকল না--সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মুকুলের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেও রুখে দেওয়া গেল ! এসবই মুকুলের বুঝতে অসুবিধে হয় নি। তাঁকে অপ্রাসঙ্গিক করে যারা ঢোল বাজিয়ে তুর্কীনাচন নাচবে বলে অধীর অপেক্ষায় ছিলেন তাদের কী হাল হতে চলেছে সেটা মুকুল জানতেন--কারণ, তাঁর মতো রাজনৈতিক অঙ্ক বোঝার মতো এক পিস নেতাও বঙ্গ বিজেপিতে তো বটেই--কেন্দ্রেও নেই--না, মুকুলের রাজনৈতিক অঙ্কের মেধাকে স্পর্শ করার ক্ষমতা মোদী-শাহ'রও যে নেই তা সশব্দে প্রমাণিত হয়ে গেল এই নির্বাচনেই। মুকুলকে বাদ দিয়ে ২০০ পারের স্বপ্ন যে এভাবেই তছনছ হয়ে যাবে এটা বোঝার ক্ষমতা বঙ্গ বিজেপি'র নেতাদের ছিল না। যে কাজ মুকুলের পক্ষে অনেক সহজ ছিল সেই কাজের দায়িত্ব দিয়ে যেসব সঙ্ঘীনেতাদের আনা হল তারা সকলেই মুখ থুবড়ে পড়লেন। অথচ এতটা করুণ অবস্থা কিন্তু বিজেপি'র হওয়ার কথা ছিল না !
তাই একুশের ভোটপর্ব মেটার পর থেকেই মুকুল রায়কে নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। তিনি বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন--এই জল্পনাকে কেন্দ্র করে মাঝেমধ্যেই গুঞ্জন ওঠে। কিন্তু তিনি কি এখন সত্যিই বিজেপি ছাড়বেন বা তিনি বিজেপি ছাড়তে পারেন, এমন কোনও সম্ভাবনা রয়েছে? কিন্তু যে যাই বলুন, মুকুল রায় এখন বিজেপি ছাড়বেন না। কারণ, মুকুল রায় এত কাঁচা কাজ করবেন না। তিনি পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ, ভাবনা-চিন্তা করেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। মুকুলের বিজেপি ত্যাগের জল্পনার মধ্যে এমনটাই ধারণা আমার। আমার বিশ্বাস, তিনি এখনই বিজেপি ছাড়বেন না। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে--তিনি বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলছেন কেন? কোথায় সমস্যা তাঁর।
আসলে মুকুল রায় বিজেপিতে স্বস্তিতে নেই। বিজেপি তাঁকে সঠিকভাবে ব্যবহার করেনি সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে। তাই বিজেপিরও ভরাডুবি হয়েছে, আর মুকুল রায়ও বিজেপির থেকে দূরত্ব রেখে চলতে শুরু করেছেন।
মুকুল রায়কে বাংলার রাজনীতির চাণক্য বলা হয়। তাঁর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। তাই তিনি বালখিল্য সিদ্ধান্ত যে নেবেন না, তা বলতে কোনও বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। মুকুল রায় জানেন, কখন কী করতে হয়, এখন তাঁর দল ছাড়ার সময় নয়।
মুকুল রায় বলেই স্পষ্ট করে বলে দেওয়া যায়, তিনি বিজেপি ছাড়ছেন না। যতই বৈঠক করুন, যতই তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি দিন, তিনি জল্পনা বাড়ালেও বিজেপিতেই থাকবেন নীরবে। তাঁর ঘনিষ্ঠমহলও একথা বলছে। তাঁরা বলছেন--মুকুল রায় বিজেপিতে স্বস্তিতে নেই। কিন্তু তবু তিনি এখন বিজেপি ছাড়ছেন না। তিনি বিজেপিতে রয়েছেন, বিজেপিতেই থাকবেন।
মুকুল রায় বিজেপিতে আসার পরই গেরুয়া শিবিরের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয় বাংলায়। ২০১৭ সালের পর থেকেই ধীরে ধীরে পসার জমাতে শুরু করে বিজেপি। তারপর দু-দুটি নির্বাচনে তিনি বিজেপিকে সাফল্যও এনে দেন। বিজেপি তখন তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিল, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আস্থার প্রতি সুবিচার করেই তিনি পঞ্চায়েত ও লোকসভায় মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো সাফল্য এনে দেন।
মুকুল রায় বিজেপির হয়ে সাফল্য এনে দেওয়ার পরও যোগ্য সম্মান দেয়নি দল। তাঁকে সর্বভারতীয় সহ সভাপতি করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটাও দীর্ঘ সময় নেওয়ার পর। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। মুকুল রায়ের মতো দক্ষ সংগঠককে কাজে লাগাতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। সংগঠক হিসেবে কোনও মর্যাদাই পাননি মুকুল রায়। স্বাধীনভাবে কোনও কাজই তিনি করতে পারেননি। তাঁকে একটি আসনে প্রার্থী করে ভোট সংগঠনের যাবতীয় প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছিল।
মুকুল রায় বিজেপিতে গিয়ে বিজেপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। তবু তৃণমূল বিরোধিতায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিজেপিকেই। আর যে দল তিনি নিজের হাতে তৈরি করছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, তার প্রতি তো দুর্বলতা থাকবেই। ফলে ইদানীং ব্যক্তিগত স্তরে মমতা, অভিষেক ও তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই তাঁর পরিবারের প্রতি যে মনোযোগ দেখিয়েছে, তাতে তিনি অভিভূত হতেই পারেন।
মুকুল রায় এখন বিজেপির বিধায়ক। তাই তিনি দলবদল করে নিজের সমস্যা কেন বাড়াবেন? মুকুল রায় বিজেপি ছাড়বেন না, কারণ তিনি যদি দলবদল করেন, তবে দলত্যাগ বিরোধী আইনে তাঁর বিধায়ক পদ চলে যাবে। আর বিজেপি ছেড়ে গেলে ফের তাঁর উপর জাঁকিয়ে বসতে পারে সারদা-নারদ মামলার বিড়ম্বনা।
কঠিন সময়ে তিনি যদি বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যান, তবে সেটা বিরাট ঝুঁকি হয়ে যাবে। সিবিআই-ইডি সক্রিয় রয়েছে। এখন বিজেপি ছাড়লে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর পিছনেও লাগিয়ে দিতে পারে তদন্তকারী সংস্থাকে। তাই এখন ঝুঁকি না নিয়ে মুকুল রায মুখ চুপচাপ বিজেপিতেই রয়ে যাবেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বা অনুগামীরা দল ছাড়লেও তিনি এখনই বিজেপি ছাড়বেন না।
মুকুল রায় কখনই তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নেন না। সাড়ে তিন বছর আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগেও তিনি অনেক সময় নিয়েছিলেন। তারপর এতদিনেও বিজেপির সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি মানিয়ে নিতে পারেননি। রাজ্যস্তরে তাঁর দিলীপ ঘোষের সঙ্গেও বনিবনা হয়নি। তা সত্ত্বেও এখন বিজেপি ছাড়তে চাইলেও মুকুল রায় তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না!
কিছুদিন ধরে মুকুল রায়কে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনা চলছে। বিশেষ করে শুভ্রাংশু ফেসবুক পোস্টে সমালোচনা বন্ধ করে আত্মসমালোচনার বার্তা দেওয়ার পর যে ঘটনা পরম্পরা দেখা গিয়েছে, তাতে মুকুল রায়ের তৃণমূলে ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি আবার বৈঠকে যোগদান নিয়ে দিলীপ ও মুকুলের ভিন্নমত পোযণও বাড়িয়ে দিয়েছে জল্পনা।
কিন্তু মুকুল রায় তৃণমূলে ফেরার কথা ভাবতে পারছেন না এখনই--কারণ, তৃণমূলে তাঁর জন্যে এই মুহূর্তে উপযুক্ত আসন নেই। তৃণমূলে অযাচিত হয়ে--বিনা আমন্ত্রণে গেলে তাঁকে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের পদে যেতে হবে--অর্থাৎ খুব বেশি হলে সহসভাপতির পদ পেলেও তিনি পেতে পারেন। যে জায়গা তিনি ছেড়ে এসেছেন তার চেয়ে নিম্নস্তরের কোনো আসনে তিনি বসবেন বলে আমার অন্ততঃ মনে হচ্ছে না। প্রাক্তন কোনো রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী যেমন মন্ত্রী হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরতে পারেন না--তেমনই মুকুলের পক্ষেও এই পরিণত বয়সে সাধারণ কর্মচারী হিসেবে রাজনীতিতে কোনোমতো টিকে থাকার কথা ভাবতে পারেন বলে মনে হয় না !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.