সংসদীয় বিতর্কের দ্রোণাচার্য
কে এম বাহারুল ইসলাম
গুরুচরণ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান শাখার ১৯৮৪-১৯৮৬ ব্যাচের প্রথম বর্ষের প্রথম সপ্তাহ প্রথম ক্লাস। ইংরেজির অধ্যাপক ক্লাসে ঢুকেই ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন - "আমরা কেন ইংরেজি পড়ছি?" সবাই যার যার মতো যুক্তি দিচ্ছি সবই ইংরেজি ভাষার সপক্ষে । সবার শেষে উনি বললেন - আমরা ঘটনাচক্রে ইংরেজি পড়ছি, এটা আমাদের পরাধীনতার ইতিহাস । পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যারা ইংরেজি ছাড়া নিজেদের ভাষাই ব্যবহার করে । উনি যে ইংরেজির ক্লাসে সেই ভাষারই উল্টো দিকে বলবেন আমাদের ধারণাই ছিল না । সেই সেদিন থেকেই যেকোনো বিষয়ে কেবল একদিক থেকে না দেখার, বা উল্টো দিক থেকে যুক্তি সাজানোর যে রাস্তা বাতলে দিয়েছিলেন - সেই বিতর্কের মূলসূত্র শিখিয়ে দেওয়া গুরুই ছিলেন অধ্যাপক পার্থ সারথি চন্দ । তারপর উনাকে দেখে, শুনে, পায়ের কাছে বসে বা একই মঞ্চে কতদিন বিতর্ক করেছি - এখনো মনে হয় অনেক কিছু শেখার বাকি ছিল । আমাদের ছেড়ে যেন হটাৎ চলে গেলেন, আর উনার কাছ থেকে কিছু নতুন যুক্তির জাল বোনা শেখা হবে না ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে । আমাদের প্রজন্মের জন্য সংসদীয়-বিতর্কের আদর্শ এক মহারথীকে আমরা আজ হারালাম ।
মনে পড়ছে - খুব সম্ভব ১৯৯৬-৯৭ - শিলচর জেলা গ্রন্থাগার ভবনে "জ্যোতি"র আয়োজিত উত্তর-পূর্ব আন্তঃরাজ্যিক বিতর্ক (NERICID) হচ্ছিল । দিনের ভাগে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিযোগিতামূলক বিতর্ক করেছে (আর আমার দল আর ই ছি, শিলচর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে)। সন্ধ্যায় ছিল জ্যেষ্ঠদের "প্রদর্শনী বিতর্ক" - বিষয় / প্রস্তাব বেশ গরম - "ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষনা করা উচিত" । তা বিতর্ক শুরু করতে গিয়ে উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত ! কারন আমন্ত্রিত বক্তাদের সবাই বিষয়ের বিপক্ষে - পক্ষে কেবল পার্থ চন্দ স্যার ! অনুষ্টান শেষে বাতিল না হয়ে যায় কারন পক্ষে একজন আর বিপক্ষে ৭/৮ জন নিয়ে তো আর "প্রদর্শনী বিতর্ক" করা যায় না । শেষে উদ্যোক্তাদের মধ্যে বন্ধুস্থানীয় রবি পাটোয়া এবং অন্যান্যরা আমাকেই ধরে বসলেন স্যারের সঙ্গে, বিষয়ের পক্ষে বলতে হবে । শেষ পর্যন্ত আমরা গুরু-চেলা একদিকে প্রস্তাবের পক্ষে (না, বোধহয় আরো একজন ছিলেন?) আর অন্যদিকে ৭/৮ জন তুখোড় তার্কিক, ওদের দলনেতা আমার আরেক গুরু অধ্যাপক কমলেন্দু ভট্টাচার্য্য ! আমরা বেশ জোরাল বক্তব্য রেখেছিলাম । সেদিন স্যার আমাকে এই প্রস্তাবের পক্ষে দেখে হয়তো একটু অবাক হয়েছিলেন । বলেছিলাম স্যার, আপনারই শিষ্য - উল্টো দিক থেকে যুক্তি। দেওয়া আপনার কাছ থেকে শিখেছি । সেদিন খুব জমেছিলো আমাদের বিতর্ক - সত্যিকারের প্রদর্শনী । পার্থ চন্দ স্যার তার অল টাইম বেস্ট - ইতিহাস, যুক্তি, সংস্কৃতি, আর যুক্তির জালে একাই একশো। আর, আমার যুক্তি ছিল নাম কিছু আসে যায় না - দেশ হিন্দু/ক্রিস্টান/মুসলিম যাই হোক না কেন দেশের মানুষ যদি উদার হয় তাহলেই শান্তি।
আবার, মনে পড়ে অক্টোবর, ২০০৬, যখন বিবিসি ওয়ার্ল্ড ডিবেটে ইতালিতে ডাক পাই - স্টিফেন স্যাকুর এর সঙ্গে লাইভ শুটিংয়ের জন্য রোমে যেতে হবে । সময় কম, ঠিক তৈরী হতে পারছিলাম না । শেষ মুহূর্তে সেই সুদূর আফ্রিকা থেকেও ফোন করে উনার কাছ থেকে বিমানে উঠার আগে কিছু টিপস নিয়েছিলাম । মহাদেশীয় সময়ের ব্যবধানে সেটা ছিল শিলচরে মধ্যরাত, কিন্তু স্যার মোটেও বিরক্ত হন নি - বরং শিক্ষক হিসাবে খুশি হয়েছিলেন, আশীর্বাদ দিয়েছিলেন । সময়ে, অসময়ে পরমর্শ আর টিপস নেবার এক বিরাট জায়গা আমার জন্য আজ থেকে শূন্য হয়ে গেলো ।
আমরা অনেকেই আশা করেছিলাম সংসদীয় বিতর্কের এই দ্রোণাচার্যের কণ্ঠ বিধানসভা বা সংসদে একদিন গমগম করবে - সারা দেশ শুনবে, রাজনৈতিক টানাপোড়নে উনার জীবদ্দশায় সেটা আর হয়ে উঠলো না সেই আফসোস থেকেই গেলো ।
[লেখক উত্তরাখণ্ডের কাশীপুরস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট-এ গণনীতি এবং শাসনতত্বের এর প্রধান অধ্যাপক।]
কোন মন্তব্য নেই