Header Ads

অপ্রিয় শোনালেও কিছু কথা না বললেই নয় !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

গতকাল সারাদিন ধরে অনেকের অনেক কথা শুনেছি--তার মধ্যে বেশ কিছু জ্ঞানগর্ভ বাণীও যেমন ছিল তেমনই ছিল বেশ কিছু আপত্তিজনক ব্যক্তিগত ঝাঁঝমিশ্রিত কূটাভাষ। সকলের সব মন্তব্য বা কথাকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করি নি। তবে যারা আশা করেছিলেন আমি কোনো বিশেষ দলের বেতনভূক কর্মচারী বা উচ্ছিষ্টভোগী চামাচা বা দালালের রোল প্লে করবো কিন্তু করি নি তারা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে আক্রমণ করায় আমি তাদের যুক্তিবোধের অন্ধত্বের কারণে করুণা রাখলেও বন্ধুত্বের তালিকায় রাখতে পারি নি। না, কাউকে ব্লক করি নি--আনফ্রেণ্ড করে দিয়েছি--বন্ধুত্বের কিছু আবশ্যিক শর্ত থাকে যা না মানলে বন্ধু হিসেবে নিজেকে দাবি করা যায় না--আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা মানি ও বিশ্বাস করি।

আমার পূর্বাভাস নিঃসন্দেহে এবারে ফেল করেছে--কিন্তু আমার বিশ্লেষণে যেসব কারণ তৃণমূলের হারের সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করেছিল তার একটিও মিথ্যে এবং অন্তঃসারশূন্য ছিল না। প্রতিটি পয়েন্ট কঠোর বাস্তবসম্মত সত্য ছিল এবং থাকবেও। দুঃখের বিষয় হল এটাই যে, রাজ্যের মানুষ ভিক্ষাকে উন্নয়ন এবং ডোল-শ্রী-খেলা-মেলা-উৎসবকে সার্বিক উন্নয়ন হিসেবেই মেনে নিল। কাটমানি-সিণ্ডিকেটরাজ-তোলাবাজি-দুর্নীতিও কোনো ইস্যু হল না। অসীম সহিষ্ণু রাজ্যবাসী গত দশবছরে তাদের মেধাবী সন্তানদের কর্মহীনতার হাহাকারকেই অনিবার্য্য নিয়তি বলে গ্রহণ করে নিল। গত দশ বছরে যারা সরকারী চাকরির বয়সের মূল্যবান সীমারেখা অতিক্রম করে রাস্তায় এসে দাঁড়াল সেটাকেই ঈশ্বরের অভিপ্রায় বলে রাজ্যবাসী মেনে নিল। পরিচ্ছন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন রাজ্যবাসীর কাছে খুব একটা বিবেচনার বিষয় নয়--যা চলছে সেটাতেই তাদের স্বর্গলাভের আনন্দ ! আজ যদি প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিজেপি’র বদলে এই রাজ্যে বামফ্রন্ট ছবিতে থাকতো তাহলে আমার রাজনৈতিক বিশ্লেষণগুলো কতটা জ্বলন্ত সত্যি তা প্রমাণ হতো। বিজেপি রাজনৈতিক মেধায় সংগঠনে ও মননে এ রাজ্যে কোনোকালেই প্রাসঙ্গিক ছিল না--এবারেও ছিল না--হয়ে উঠলো শুধুমাত্র তৃণমূলের জন্যেই। কারণগুলো আমি বহুবার ব্যাখ্যা করেছি। এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের এই বিপুল প্রত্যাবর্তনকে বিন্দুমাত্র ছোট না করে--প্রায় একক লড়াইতে দলকে এই অভাবিত (হ্যাঁ, জেনে বুঝেই ‘অভাবিত’ বলছি--অনেকেই বলেছেন) জয় যিনি ছিনিয়ে এনেছেন সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে
অভিনন্দন
জানিয়েও বলছি--এ জয় সম্ভব হতো না যদি তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে বিজেপি’র বদলে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বাম-কংগ্রেস দাঁড়াতে পারতো। ২০১৬’র বাম-কংগ্রেসের ৭৭-টি আসন তৃণমূলের হাতে তুলে না দিলে--এ রাজ্যের মূলস্রোতের রাজনীতি থেকে তারা চিরকালের জন্যে মুছে যাবে--এই সতর্কবাণী তাঁদের কাছে না পৌঁছুলে বাম-কংগ্রেসশূন্য বিধানসভার নতুন ছবি ইতিহাসে বড়সড় জায়গা করে নিতে পারত না--বাম-কংগ্রেসের এই 'আত্মবলিদান' রাজ্যরাজনীতিতে কি তাৎপর্য্য বহন করে সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী আসনে থাকছেন না আব্দুল মান্নান, সুজন চক্রবর্তী সহ বহু পরিচিত মুখ। এ দৃশ্য নিশ্চয় মনোরম বোধ হবে রাজ্যবাসীর কাছে ! বাম-কংগ্রেসের আত্মবলিদানের ফলশ্রুতিতেই সুজন চক্রবর্তী, কান্তি গাঙ্গুলি, অশোক ভট্টাচার্য্য, আব্দুল মান্নান, মনোজ চক্রবর্তী, তন্ময় ভট্টাচার্যরা এখন মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে রাজপথ কাঁপানোর ন্যূনতম শক্তিটুকুও রাখলেন কিনা সেটাই এখন দেখার !
গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই উত্তরবঙ্গের--বিশেষ করে কোচবিহার-জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ার-দার্জিলিং সম্পর্কে আমার বিশ্লেষণগুলো নিয়ে কিন্তু একটি শব্দও কেউ উচ্চারণ করছেন না--পূর্বাভাস ১০০% মিলে গেছে বলে? এই সেদিনও আমি এই চার জেলার কেন্দ্র ধরে ধরে বিশ্লেষণ করেছিলাম--কোথাও কি এতটুকু ভুল ছিল? উত্তরবঙ্গ থেকেই যারা আজ রাতারাতি তৃণমূল হয়ে গিয়ে হাহা-হিহি করছেন--বড় বড় বাণী ঝাড়ছেন তারাই তো এই চার জেলায় সাদরে বিজেপিকে বরণ করে নিলেন ! এই চারজেলার মানুষকে মুর্খ বলবেন? অবোধ-অজ্ঞান-কাণ্ডজ্ঞানহীন সাম্প্রদায়িক শক্তির দালাল বলবেন? বলার হিম্মত থাকলে প্রকাশ্যে আমার মতো বলার কথাটা সপাটে উচ্চারণ করুন। গৌতমদেব, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, বিনয় বর্মণ, সৌরভ চক্রবর্তীর মতো নেতারা কাদের জন্যে কাদের ষড়যন্ত্রের কারণে হারলেন কেউ বিশ্লেষণ করবেন কি? এই চার জেলায় তৃণমূলের অস্তিত্ব ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে দাঁড়াতে চলেছে--এ কথা তো আমিই বলেছিলাম--কারণগুলোও ব্যাখ্যা করেছিলাম। এই কারণগুলো যত দক্ষিণমুখী হয়েছে তত দুর্বল হয়ে গেল কি তৃণমূলের কৃতিত্বে? একেবারেই নয়। বিজেপি’র কালিদাসী রাজনীতির কারণে। আমাকে লক্ষ্য করে যারা তির ছুঁড়ছেন তারাও বুঝবেন--বেশ একটু সময় লাগবে--এই যা ! আমি আমার বিশ্লেষণ বা পর্যবেক্ষণকে একেবারেই অন্তঃসারশূন্য বা আমার পুঞ্জিভূত রাগের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছি না। আমার রাগের কারণগুলো প্রকাশ্যে আনলে যারা আমাকে আক্রমণ করছেন তারাও সবিশেষ লজ্জা পাবেন--যদি লজ্জা পাওয়ার মতো বিবেকবোধ বলে কিছু থাকে। কিন্তু কথা সেটা নয়--আসল কথাটা হল বিজেপি’র আকাশস্পর্শী আত্মতুষ্টি--জেতার অনেক আগেই জিতে যাওয়ার হাস্যকর মানসিকতা।
বিজেপি ভয়ানক ভুল করেছে অরবিন্দ মেনন এবং অমিত মালব্যকে এ রাজ্যে বিজেপি’র গুরুঠাকুর করে নিয়ে এসে। পশ্চিমবঙ্গ একমুঠো ত্রিপুরা বা ঝাড়খণ্ড-ছত্তিশগড় নয়--নয় উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-গুজরাট। বাংলার সংস্কৃতি চালচলন চিন্তা চেতনার সঙ্গে মানানসই নয় এমন কাউকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলারই নেতা কর্মী এবং বিশেষ করে ভোটারদের গুরুত্ব না দিলে স্বপ্ন যে অধরাই থেকে যাবে এটা শীর্ষ নেতারা ভাবেন নি--এটা নিয়ে রিসার্চও করেন নি। যে মুকুলের হাত ধরে বিজেপি আক্ষরিক অর্থেই রাজ্যরাজনীতিতে পায়ের নিচে মাটি পেল সেই মুকুলকেই গত তিন বছর ধরে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতারা ‘রগড়ে’ গেলেন। নির্বাচনের মুহূর্তেও তাঁকে তাঁর টিমসহ একেবারে গোডাউনে পুরে রাখলেন ! ২৯৪ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতা বিজেপি’র ছিল না--তাই দলে নতুন যোগ দেওয়া ১৪৯ জনকে প্রার্থী করেও বিজেপি তাদের জিতিয়ে আনার জন্যে যার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা উচিত ছিল সেই মুকুল রায়ের ওপর নির্ভর না করে সঙ্ঘী মেনন-মালব্য জুটির ওপর নির্ভর করলেন। ঐ ১৪৯ জন প্রার্থী যে মানুষটির গাইডেন্সে লড়ার জায়গায় উঠে আসতে পারতেন তাঁর গাইডেন্সই তাঁরা পেলেন না। কে এই মেনন-মালব্য? রাজ্যরাজনীতিতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু? তাঁরা দলে নতুন যোগ দেওয়া একজনকেও কি করে জেতাবেন ভাবা দরকার ছিল না? ঝাঁকে ঝাঁকে গোবলয়ের নেতাদের উড়িয়ে এনে বিরক্তিকর বিশৃঙ্খলা তৈরির ফল তো ভুগতেই হবে। বহিরাগত আওয়াজ তাই দারুণভাবে ক্লিক্ করে গেল তৃণমূলের পক্ষে। তা ছাড়াও সবকিছু বেচে দেওয়ার সরকার হিসেবে মোদী সরকারের গায়ে যে ছাপটা পড়ে গিয়েছিল তার একটা আতঙ্কও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শান্তিনিকেতন, হাওড়া ব্রিজ-স্টেশন, মনুমেন্ট, সহ সবকিছুই বিজেপি বেচে দেবে এমন একটা জনরবও বিজেপিকে পথে বসিয়েছে। তৃণমূলের নির্বাচনী প্রচার স্টাইলের কাউন্টার দেওয়ার মতো নেতা বিজেপিতে কেউ নেই। কিন্তু নির্বাচনে কমবেশি সাফল্য এনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল যাঁর তাকে প্রথম থেকেই উপযুক্ত সম্মান দেয় নি বিজেপি। গোটা টিম সহ অন্তরালেই থেকে যেতে বাধ্য হলেন মুকুল রায়।
আর একটি মারাত্মক ভুল বিজেপি আজও করে চলেছে। সারদা-নারদা-রোজভ্যালি তদন্তের জুজু অনন্তকাল ধরে ঝুলিয়ে রেখে অনেককে ধরে রাখার বা কাউকে কাউকে ভয় দেখানোর খেলা খেলার মাধ্যমে বাংলা দখলের কথা ভেবে চলেছে তারা। এই তদন্তগুলো দ্রুত গুটিয়ে ফেলার কথা ভাবা উচিত থাকলেও বিজেপি তা ভাবছে না--ফলে প্রতিবারই সাজানো ঘুঁটি ভেস্তে যাচ্ছে--এ ভাবে এই পথে যে স্বপ্ন সফল হয় না এটা মেনন-মালব্যদের মাথায় ঢোকার কথা নয়। এখনও এই ফলাফলের সামনে দাঁড়িয়েও বিজেপি হয়তো বুঝে উঠতে পারবে না যে তারাই তৃণমূলকে তৃতীয়বারের জন্যে ক্ষমতায় সাড়ম্বরে অভিষিক্ত করল !
তৃণমূলের দলের ভেতরের ছবিটা যারা দেখতে পান বা পাচ্ছেন তারা জানেন--খাদের মুখ থেকে প্রায় অলৌকিকভাবে ফিরে আসার পরেও দলের শুদ্ধিকরণ সফল হবে না। এসএসসি, সেট, পিএসসি সহ যাবতীয় পরীক্ষা নিয়মিত হবে না, টাকার লেনদেন মুক্ত হবে না নিয়োগপ্রাপ্তির পদ্ধতি, মেধা যোগ্যতা অধিকার স্বীকৃতি পাবে না, এসএসসি’র উত্তরবঙ্গ জোন চালু হবে না, পিএসসি’র উত্তরবঙ্গ অফিস খোলা হবে না--তীব্র কেন্দ্র বিরোধিতার আবহে সার্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন গতি পবে না। জানি, গতকাল সকাল থেকেই যারা সুবজ রঙ মেখে সঙ সেজে তৃণমূল হয়ে উঠেছে কালাপাহাড়ের মতো তারাই রে-রে করে উঠবেন। দশ বছরের অভিজ্ঞতা কিছু কম নয়--জীবনের মূল্যবান সময়ের প্রায় সবটাই কেটে গেছে রাজ্যবাসীর--আরও পাঁচ বছর কেমন কাটবে বা কাটতে পারে তা যারা বোঝার তারা বুঝতে পারছেন। তবে বড় স্বস্তি এটাই যে, বিজেপি বাংলার ক্ষমতায় বসতে পারে নি। এ রাজ্যের মানুষ মেনন-মালব্যদের সংস্কৃতির সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করতে করতেই বেঘোরে মারা পড়ত। আমার লেখা যারা সত্যি সত্যি ফলো করেন (হঠাৎ হঠাৎ কোটর থেকে চঞ্চু বের করে কিছু না পড়ে বুঝে কিচিরমিচির করেন যারা তাদের বলছি না) তারা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন আমি বলেছিলাম--বিজেপি নয়, মুকুল-শুভেন্দু-রাজীব-সব্যসাচী-সৌমিত্র-শঙ্কুরা যদি পৃথক একটি মঞ্চ তৈরি করে বাম বা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে যান তাহলে রাজ্যরাজনীতিতে একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প তৈরি হতে পারে। সেটা যদি হতো তাহলে আজ এই ফলাফল হত না। তৃণমূল সরকার বা তাদের নেতানেত্রীদের অঢেল অনুগ্রহের সঙ্গে অনেককিছু করার লাইসেন্স যারা পেয়ে এসেছেন এবং ভবিষ্যতেও পাবেন তাদের অবস্থানের একটা মানে বুঝতে পারি--কিন্তু যারা কিছুই পান নি--উপেক্ষা হেনস্থা অপমান ছাড়া কিছু পাচ্ছেন না--যাদের মেধা যোগ্যতা অধিকার নিয়মিত ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে কিংবা কিছু কিঞ্চিৎ বিপুল টাকার বিনিময়ে কিনতে হচ্ছে তারা আমার বক্তব্যের বিরোধিতা করছেন না বা করবেন না আমি জানি। ভয়ঙ্কর অল্পবুদ্ধির দৌলতে যারা আমাকে বিজেপি’র দালাল বলে মনে করছেন তাদের বিচারবোধকে করুনা করা ছাড়া বা উপেক্ষা করা ছাড়া আমার কিছু করার নেই। তবে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের হিম্মত যদি কারুর থাকে তিনি বিজেপি’র সঙ্গে আমার ক্ষুদ্রতম কোনো যোগসূত্র সামনে এনে প্রমাণ করুন আমি বিজেপি’র কোনো নেতানেত্রীর বৈঠকখানার বাইরে এক সেকেণ্ডের জন্যেও হত্যে দিয়ে বসে থেকেছি ! রাগের বহিঃপ্রকাশ কাদের ঘটছে এবং কেন ঘটছে সেই সব নোংরা ঘাঁটায় আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। তাই সে সব কথায় গেলাম না। সবাই ভাল থাকুন--যারা আক্ষরিক অর্থেই বন্ধুত্বের মর্যাদা বুঝে বন্ধু থাকতে চান থাকুন--যারা তা চান না অসঙ্কোচে আমাকে তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলুন--আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকবে। কিন্তু বন্ধুও থাকবেন আবার কদর্য্য কলম চালিয়ে আক্রমণ চালাবেন--এ মানসিকতা হজম করার ক্ষমতা বা শিক্ষা আমার সত্যিই নেই !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.