Header Ads

হিংস্রতা আমাদের ভিত্তি অন্ধকার আমাদের ভবিষ্যৎ !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়


তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণপর্ব আজ শেষ হল রক্তাক্ত হানাহানির মধ্য দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে কেন নির্বাচন কমিশন আট দফায় ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিয়ে যারা ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাদের বেশরমীকে ধিক্কার জানাবার ভাষা বাংলায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এত বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো নিয়েও কম সমালোচনা হয় নি। প্রসঙ্গতঃ যারা ভুলে গেছেন তাদের একটি কথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। ২০০৬ সালে মিডিয়া এমন একটা বাতাবরণ তৈরি করেছিল যাতে মনে হচ্ছিল বুদ্ধদেবকে সরিয়ে বাংলায় তৃণমূলের সরকার গড়াটা স্রেফ কয়েকদিনের সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তৃণমূল কংগ্রেসও আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছিল। তৃণমূল নেত্রী ২০০৬ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের বিপুল সংখ্যাক কেন্দ্রীয় বাহিনী নামিয়ে ৬ দফায় ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্তকে সোচ্চারে স্বাগত জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী তথা বামফ্রন্ট সরকার বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং ৬ দফা ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে নি। তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। যদিও সেই নির্বাচনে বুদ্ধদেববাবুকে তো বটেই বামফ্রন্টকে হারানো যায় নি। তার মানে অবশ্য আমি এটা বলতে চাইছি না যে এবারেও সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ঘটবে না--কারণ, সেবারে এবারের মতো কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষকে নানান কৌশলে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার হঠকারিতা দেখা যায় নি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্ররোচনামূলক উস্কানি ছিল না। যেটা এবারে দেখা যাচ্ছে। এবারে কেন্দ্রীয়বাহিনীকে আক্রান্তও হতে হচ্ছে। এই প্রবণতা যদি বাড়তে থাকে এবং চলতেই থাকে তাহলে তা মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। আক্রান্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী দু'চার মিনিটেই নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে--তারা ইউনাইটেড হয়ে পলিটিক্যাল মোটিভেটেড হয়ে যেতে পারে--যা নির্বাচনের মতো একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে আদৌ সুখকর হবে না। কিন্তু এটা কোনো কোনো রাজ্যনৈতিক দল একেবারেই ভাবছে না। উল্টে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে চরম কষ্টকল্পিত এমন সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে যার প্রকৃতপক্ষে বিশেষ কোনো ভিত্তিই নেই। এ ধরণের অভিযোগ বামফ্রন্ট আমলে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যত উঠতো বিরোধী দলগুলোর ভেতর থেকে তেমন একটা উঠতো না। এবারেও দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিদিন প্রতি মিনিটে অদ্ভূত সব বিস্ময়কর অভিযোগ উঠে আসছে ক্ষমতাসীন দলের ভেতর থেকেই। বিরোধী দলগুলো কিন্তু এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করছে না। ফলে ভোট গ্রহণপর্বে যা কিছু অশান্তি হানাহানি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখতে হচ্ছে তার সিংহভাগ দায় দায়িত্ব বর্তাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ওপরেই। এবারের নির্বাচনে তাই প্রার্থীরাও ধোলাই খাওয়ার হাত থেকে নিস্তার পেলেন না। চূড়ান্ত হেনস্তা অপমান শারীরিক লাঞ্ছনা--কিছুই বাদ গেল না।
আরামবাগ কেন্দ্রের টিএমসি প্রার্থী সুজাতা মণ্ডলের তৃতীয় শ্রেণীর মারদাঙ্গা হিন্দিছবির হিরোইনের ভূমিকা খুব সঙ্গতভাবেই মানুষ মেনে নিতে পারে নি। ফলে তাঁকেও একদার মানস ভুঞ্যা'র মতো জলজঙ্গল না হলেও ধানক্ষেতের দিকে দৌড়ুতে হয়েছে। তাঁর মাথায় ডাণ্ডা পড়েছে--ইট-পাটকেলও ছুটে এসেছে--এ দৃশ্য মোটেও কাঙ্ক্ষিত ছিল না। অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং গভীর দুশ্চিন্তারও বটে ! পাশাপাশি তিনি কতদূর রাজনীতির যোগ্য নেত্রী তা তিনি ঘোষণা করে দিলেন আজ--২-রা মে তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারবেন। মার খেয়েছেন বিজেপি প্রার্থী পাপিয়া অধিকারীও। অনভিপ্রেত ছিল এইসব ঘটনা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভিমুখ এখন এটাই--হিংস্রতা। এই হিংস্রতাই আমাদের ভিত্তি হয়ে উঠেছে--সুতরাং সঙ্গত কারণেই অনতিক্রম্য অন্ধকারই আমাদের ভবিষ্যৎ ! এর মধ্যেই এক পলকের আলোর ঝলকানির মতো সামনে উঠে এলেন এক মহিলা ভোটার--ভয়ঙ্কর পরিণামের হুমকি উপেক্ষা করেও তিনি তাঁর নিজের ভোট নিজে দিয়ে প্রমাণ করলেন--আক্ষরিক অর্থে তিনিই বাংলার মেয়ে ! অন্য আর কারুরই অধিকার নেই নিজেকে বাংলার মেয়ে বলে দাবি করার।
সারাদিন কী সব দেখলাম আমরা? দেশ তো বটেই বহির্বিশ্বেও কি বাঙালির রাজনৈতিক মেধার ছিটেফোঁটাও প্রদর্শনযোগ্য থাকলো? বাংলার রাজনীতি বাঙালির মুখপোড়া চেহারাটাকেই বার বার তুলে ধরছে বিশ্বের সামনে।
গত ২১ মার্চ আমি যে জেলাওয়ারি পূর্বাভাস দিয়েছিলাম--তিন দফা ভোটগ্রহণ পর্ব শেষ হওয়ার পরেও আমার বিশ্বাস--সে দিকেই ফলাফল এগিয়ে চলেছে। এই তিনদফা নির্বাচনের পর আমার মনে হচ্ছে আমফান দুর্গত এলাকাগুলোর ভোট কিছুটা হলেও স্যুইং করতে চলেছে। যার ফলে দুই মেদিনীপুর, দুই চব্বিশ-পরগণাতে ক্ষমতাসীন দলকে বেশ কিছু নিশ্চিত আসন হারাতে হবে। দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত জেলাগুলোতেও অপ্রত্যাশিত ফলাফল হতে চলেছে। বিশেষ করে হুগলী হাওড়া নদিয়াতেও। কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের লোকজন লকডাউনের সময়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল তারও প্রভাব অনেকটাই পড়তে চলেছে নির্বাচনে। এখনও বাকি পাঁচ দফার নির্বাচন--পরিস্থিতি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন !
আগে দেখে আসছিলাম--হানাহানি রক্তপাতে যাদের প্রাণ যায় রক্ত ঝরে তাদের সকলেই প্রায় দিন আনা দিন খাওয়া শ্রেণীর লোকজন। সংসারে এদের একজনেরও না থাকা মানে সেই সংসারের সর্বনাশ--তবু সেটাই ঘটে। নেতা-নেত্রীদের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগে না। এবারে দেখলাম কাণ্ডজ্ঞানহীন হিংস্রতা এবারে ছুঁয়ে ফেলেছে প্রার্থীদেরও--এটাই নাকি গণতান্ত্রিক উৎসবের চেহারা !
আমরা এখন সত্যি সত্যি দল বেঁধে ছুটে চলেছি অন্ধকার গুহার দিকে--আমাদের হাতে আলো নেই--মেধা বিবেক নিষ্পেষিত আমাদের চেতনা এখন আর চকমকি পাথর নয়--আগুনের ফুলকির অধিকারও আমরা হারাচ্ছি ক্রমশঃ বড্ড দ্রুত গতিতে !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.