Header Ads

কর্মীদের মনোবল চাগিয়ে রাখতে গেলে বলতেই হয় ‘আমি জিতছি’!!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

ত্রিমুখী লড়াইয়ে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নন্দীগ্রাম। ভোটপর্ব সাঙ্গ হওয়ার আগে থেকেই একদিকে শুভেন্দু যখন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন--চিন্তার কোনো কারণ নেই--আমি জিতছি। তখন চুপচাপ বসে নেই মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। তাঁরও দাবি--মা-মাটি-মানুষের আশীর্বাদে আমি-ই জিতছি। উভয়পক্ষের এই দাবি রাজনৈতিক বিচারে একটুও অস্বাভাবিক নয়। এ দাবি অত্যন্ত স্মার্টলি না করতে পারলে কর্মীদের মনোবল ধরে রাখা যাবে না। সুতরাং এই দাবি ও পাল্টাদাবির যৌক্তিকতা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মাথা ঘামান না--তারা ভোটের গতিপ্রকৃতি ও ভাবগতিক বিশ্লেষণ করেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুনোর চেষ্টা করেন।

আমি আমার আগের দু’একটি পোস্টে মন্দিরময় নন্দীগ্রামের ভোট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলাম এই কেন্দ্রটি বিভাজনের রাজনীতির অন্যতম প্রধান একটি কেন্দ্র হতে চলেছে। শুভেন্দু এই কেন্দ্রের বিদায়ি বিধায়ক। নন্দীগ্রামের প্রতিটি মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রতিটি জনবসতিতে নিজের প্রভাব আগের চেয়ে বেশ খানিকটা বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর। এ ব্যাপারে তিনি যা করেছেন তা হাতে খাতা-পেন্সিল নিয়ে অঙ্ক কষে কষেই করেছেন। কতটা প্রভাব তৈরি করতে পেরেছেন তা বোঝা যাবে ২-রা মে। তাঁর এই রাজনৈতিক অঙ্কের দিকে তাকিয়েই মমতাও নন্দীগ্রামের প্রতিটি মন্দির চষে বেড়িয়েছেন। পুজোপাঠ করেছেন--নিজের হিন্দুত্বের প্রতি তাঁর আস্থা ও বিশ্বাসকে নানাভাবে প্রোজেক্ট করার চেষ্টায় খামতি রাখেন নি। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টাকে সন্দেহাতীত দৃষ্টিতে সবাই নিতে পেরেছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে--কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে তোষণ রাজনীতির অভিযোগ সব সময়েই থেকেছে। নন্দীগ্রামের বয়ালের একটি বুথে মমতা ঢোকা মাত্র সেখানে প্রচুর মহিলা দুভাগে মুখোমুখি রণং দেহি মূর্তিতে পজিশন নিয়ে শ্লোগান পাল্টা শ্লোগানে মুখর হন। এলাকাটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হলেও সেখানে বিজেপি মহিলা ভোটারদের সংখ্যাও যে নগণ্য নয় তা বোঝা গেছে। তৃণমূলের দাবি অনুযায়ী নন্দীগ্রামের মহিলারা ঢেলে মমতাকে ভোট দিয়েছেন--ব্যাপারটা ঠিক তেমন হয় নি।
আমার মতো অনেকেই দেখে থাকবেন--এক সংখ্যালঘু মহিলা সুলিখিত স্ক্রিপ্ট যেন মুখস্থ করেই গড় গড় করে আউড়ে গেলেন--তাঁর হিন্দি ও কিঞ্চিৎ উর্দু মিশ্রিত সংলাপে (বাংলাহীন শব্দের) অভিযোগ উঠে এসেছিল তাঁরা যখন কোরান পাঠ করছিলেন তখন কেন্দ্রীয়বাহিনী জবরদস্তি তাঁর ঘরে ঢুকে লাঠিপেটা করেছে--ভোট দিতেও দেয় নি ! তাঁর চোস্ত বাংলাহীন হিন্দি সংলাপ শুনে তাঁকে যদি কেউ বহিরাগত বলে এবং এই অভিযোগ করে যে, এই ধরণের স্পর্শকাতর অভিযোগ তুলে তিনি গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করছিলেন তাহলে খুব একটা অপরাধ হওয়ার কথা নয়। এরকম ছবি ইতস্ততঃ ছিলই। ছিল কেশপুরেও কিছু তাণ্ডবের চিত্রকলার মধ্যেও !
আসলে নন্দীগ্রামের ৬২ থেকে ৬৫ হাজার সংখ্যালঘু ভোটের ভরসাতেই মমতা এই কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বাকি ভোটের সিংহভাগই যে এবারে শুভেন্দুর নার্সিংয়ে বিজেপির দিকে ঝুঁকে গিয়েছে এটা কিন্তু অনেকেরই চোখে এবং হিসেবে ধরা পড়ে নি। ঘটনাক্রমে শুভেন্দু এবং মমতা--এই দু’জনেই ব্রাহ্মণ, ফলে আ্ইএসএফ চেয়েছিল এখানে একজন সংখ্যালঘু প্রার্থী দিতে--কিন্তু উচ্চমার্গীয় সেকুলর তথা ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থী বৌদ্ধিক নেতারা হিসেব কষে দেখলেন--নন্দীগ্রামে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিলে তৃণমূলের মহা ক্ষতি হয়ে যাবে এবং হিন্দুভোটেও থাবা বসানো সহজ হবে না। সুতরাং আসানসোলের এক ব্রাহ্মণকন্যাকে তাঁরা তুলে এনে সেখানে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মিনাক্ষী মুখার্জ্জীরা এ কালের শিক্ষিত তাত্ত্বিক মতাদর্শী তরুণ সমাজের প্রতিনিধি। কথায়বার্তায় বেশ চৌকষ হলেও তাদের কথাবার্তা মাথায় ধারণ করে হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার মতো শিক্ষিত অনুভূতিপ্রবণ সমাজ এখনও তৈরি হয় নি--তাদের অগ্রজ নেতারা প্রায় সাড়ে তিন দশকের রাজত্বকালেও সেরকম সমাজ গঠন তৈরি তো দূরের কথা--গড়ে তোলার কথা ভাবেন নি বা সময় পান নি। ফলে মিনাক্ষী তাঁর নির্ভেজাল মতাদর্শ নিয়ে নন্দীগ্রাম চষে বেড়াতে গিয়ে দেখলেন তিনি হেনস্থার শিকার হচ্ছেন তৃণমূলী অশিক্ষিত চ্যাংড়াদের হাতে ! লোকে তার চোখে জলও দেখেছে। তবু তিনি তিন নম্বরেই থাকবেন। থাকলেও তিনি বেশ কিছুটা ক্ষতি করে দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসেরই--যেটা তার রাজনৈতিক অভিভাবকদের কাছে কাক্সিক্ষত ছিল না। তাঁরা সংখ্যালঘু ভোটারদের কাছে মুষ্টিভিক্ষার বেশি কিছু চান নি--চেয়েছিলেন হিন্দু ভোটে বড়সড় থাবা বসাতে--সেটা হলেই বিজেপি’র পরাজয় সম্ভব হতো। এখন দেখার--সেরকম কিছু হল কিনা।
না, মহিলাদের একতরফা ভোট মমতা বা মিনাক্ষীর দিকে যায় নি। আমাদের দেশে ৯৯% শতাংশেরও বেশি মহিলাভোট পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অনুসারী হয়ে থাকে। পুরুষদের বিপরীত চিন্তাধারায় মহিলাদের ভোট ধাবিত হয় না। যে টুকু হয় তা সাধরণ নয়--ব্যতিক্রম। নন্দীগ্রামে সকাল থেকেই বুথে বুথে মহিলাদের লাইনে (বিশেষ করে হিন্দুভোটারদের মধ্যে) ভিড় দেখে এবং বুথে বুথে শুভেন্দু প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখেচোখের হাবভাবে বেশ কিছুটা বোঝাই যাচ্ছিল তাদের ওপর শুভেন্দুর রাজনৈতিক প্রভাব ছিল কি ছিল না। ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লে যে শুভেন্দুর হাসি চওড়া হবে সেটা আমার জানা ছিল। শেষপর্যন্ত হয়েছেও তাই। কখনো গাড়িতে কখনো বাইকের পিছনে শুভেন্দু বুথের পর বুথ চষে বেড়িয়েছেন। বুথে বুথে ভোটারদের সামিল করানোর জন্যে শুভেন্দুর কর্মীর অভাব ছিল না। ফলে বিজেপি’র মনে হতেই পারে নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর বিপুল জয় এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র ! অন্যদিকে ৩৫৫ বুথের মধ্যে শ’খানেক বুথে নাকি তৃণমূলের এজেন্টই ছিল না। সত্যিমিথ্যে জানি না--যদি এটাই হয়ে থাকে তাহলে গভীর দুশ্চিন্তায় থাকার কথা তৃণমূলের। কিন্তু তারা বলছে--দিদিই জিতছেন। বাস্তব ছবি এবং যাবতীয় হিসেব উল্টে দিয়ে যদি সত্যি সত্যি মমতা জিতে যান তাহলে এবারের নির্বাচনেও মমতা সরকার গঠনের জায়গায় চলে যেতে পারেন বলে অনেকেই মনে করতে পারেন।
নন্দীগ্রাম নির্বাচনে মিনাক্ষী অবশ্যই দাগ রেখে যাবেন। হিসেবের কিছু গোলমাল হবেই। তবে আমার ধারণা, এই হিসেবের গোলমালে কমবেশি বেকায়দায় পড়বে তৃণমূল।
আমি আগেই বলেছি--অবিভক্ত মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার মোট ৫৬-টি আসনের মধ্যে বিজেপি ৩৮-টি আসন পেতে পারে। দ্বিতীয় দফার নির্বাচন শেষে আমি এখনও তাই বলছি। গতকালের নির্বাচনে সদর খড়গপুর, চণ্ডীপুর এবং বাঁকুড়া কেন্দ্রে তৃণমূলের পরিস্থিতি ভাল নয়--আশঙ্কায় থাকছে ডেবরা-ও। ইতিমধ্যেই যে ৬০-টি আসনে ভোট হয়ে গেল তার এক্সিট পোলও নিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন চ্যানেল ও সমীক্ষক সংস্থা। একটা জোরালো পূর্বাভাস ইতিমধ্যেই কাগজবন্দি হয়ে আছে। শেষ ভোটের দিন তা জানা যেতে পারে। এখনও ছয় দফা ভোট বাকি। এখনও নানা ঘটনার ঘনঘটায় রাজনৈতিক সমীকরণ এদিক ওদিক হবেই। কে সরকার গঠনের জায়গায় আসবে তা নির্ধারিত হবে আগামী ভোটপর্বগুলির মধ্যেই। সুতরাং সকলের চোখ থাকবে পরবর্তী দফাগুলির দিকেই !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.