বিশ্বদেব
চট্টোপাধ্যায়
গতকাল এবং আজ--এই দু’দিন ধরে নন্দীগ্রাম থেকে দুনিয়া কাঁপানো যেসব মন্তব্য ভাইরাল হয়ে গেল তার পরিপ্রেক্ষিতে আমার পূর্বাভাস যে বেশ খানিকটা বদলে যাবে তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ থাকছে না। অসুস্থ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য যে এই দিনগুলোর জন্যে অধীর অপেক্ষায় ছিলেন তা তাঁর কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। ১৪ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তাঁর বিশ্বাস ছিল ‘কুটিল চক্রান্ত’ একদিন প্রকাশ্যে উঠে আসবে ! ইতিমধ্যেই বুদ্ধবাবুর প্রতিক্রিয়া সবাই দেখেছেন।
বাংলার অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে ঘরের মধ্যে ঢুকে যেভাবে মারা হয়েছিল তা দেখে আমার মনের মধ্যে একটা বিবমিষা ভাব তৈরি হয়েছিল--কয়েকদিন গলা দিয়ে কিছু নামাতে পারছিলাম না। বাংলার এক মাকে মেরে মুখ-চোখ ফাটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দিয়ে
যখন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল তখন অন্যদিকে বাংলার এক মেয়ে নিজের চাহিদার পরিমাপ করতে রাজ্য চষে বেড়াচ্ছিলেন। আজ সেই মায়ের মৃত্যু হল--তাঁকে নির্মম প্রহার কারা করেছিল--তাদের পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি কি আমার তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই--প্রশ্ন হল যেসব নৌটঙ্কিবাজরা হাথরস নিয়ে প্রতিবাদে রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছিল তারা আজ কোথায়? অশীতিপর এই বৃদ্ধা মায়ের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মহাজ্ঞানী সাংসদ যেভাবে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের মতামত দিয়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক নির্লজ্জতার পরিচয় রাখলেন তার সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণের রুচি আমার নেই। আমার শুধু জানতে ইচ্ছে করছে--যেসব সাইকো ঐ বৃদ্ধাকে মেরেছে তাদের কি ঠাকুমা-দিদিমা-মা-মাসী-পিসী বলতে কি গুষ্টিতে কেউ নেই--তাদের কারুর মুখ একবারের জন্যেও মনে পড়েনি বেধড়ক প্রহার করার সময়ে? অশীতিপর বৃদ্ধার ঐ বীভৎস মুখের ছবি কি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে সেটা বোঝার ক্ষমতা বর্বর সাইকোদের থাকার কথা নয়। তিনি এক বিজেপি কর্মীর মা হওয়ায় বিজেপি এই নির্বাচনের মধ্যে এই মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেই--কোনো অস্বাভাবিকতা নেই এর মধ্যে--যে কোনো দলই করবে। এইরকম জ্বলন্ত ইস্যু যদি বিজেপি’র হাতে তুলে দেওয়া হয় তাহলে তার সদ্ব্যবহারের সুযোগ বিজেপি কেন নেবে না?
আমার পূর্বাভাস প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম--শেষ ভোট পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত অনেক ঘটনা ঘটবে এবং তার প্রভাব পড়বে ফলাফলের ওপরে। ঘটনা ঘটছেই--বলতে কি প্রতিদিন ঘটনার ঘনঘটায় পিলে চমকে যাচ্ছে মানুষের। সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ঘটছে নন্দীগ্রামে। শেষপর্যন্ত নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে তৃণমূলনেত্রী বলেই দিলেন তাঁর পায়ে বহিরাগতদের দিয়ে আঘাত করিয়েছেন শুভেন্দুই ! এই চূড়ান্ত অভিযোগটা তিনি তুলে রেখেছিলেন নন্দীগ্রামেই শুভেন্দুর বিরুদ্ধে শেষমুহূর্তে ব্যবহার করবেন বলে। কিন্তু ইতিমধ্যেই এই চোট নিয়ে একেক দিন একেক রকমের ভাষ্যের দৌলতে এই অভিযোগ একেবারেই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে--বিশেষ কোনো রাজনৈতিক ফায়দা নন্দীগ্রামের নির্বাচনে মিলবে বলে মনে করছেন না কেউ।
নেত্রী কখনো দাবি করছেন--নন্দীগ্রাম কাণ্ডে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন--যা কিছু হয়েছে তা তাঁর নেতৃত্বেই হয়েছে। শিশির অধিকারী বা শুভেন্দু অধিকারীর কোনো ভূমিকাই ছিল না। নন্দীগ্রামের মানুষ তাদের কাউকে দেখে নি। আবার কখনো বলছেন--পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য শুভেন্দু অধিকারির অনুমতি নিয়েই নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠিয়েছিলেন--অর্থাৎ সিপিএমের ডাকসাইটে নেতা লক্ষণ শেঠ বা পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেবেরও নন্দীগ্রামে কোনো কিছু করার ক্ষমতা ছিল না যদি না শুভেন্দু’র নির্দেশ তাঁরা পেতেন। এসব অভিযোগ নন্দীগ্রামের মানুষ গিলছে কিনা তা বোঝা যাবে ২-রা মে। গত দু’দিন ধরে নন্দীগ্রাম নিয়ে যেসব পিলে চমকানো অভিযোগ তথা ‘সত্য উদ্ঘাটন’ হয়ে চলেছে তা নিয়ে আমি বিশেষ কিছু বলতে চাই না। কারণ, ইতিমধ্যেই নন্দীগ্রাম যে আর কখনো তৃণমূলকে এক পয়সারও ডিভিডেণ্ড দেবে না তা নিশ্চিত হয়ে গেছে।
খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বরকর্ড স্থাপনের দাবিদার এক লেখিকা তাঁর অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে ‘নন্দীমা’ নামে একটি ‘নির্ভেজাল’ সংগ্রামের ইতিহাস নির্ভর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। অনেকেই পড়ে থাকবেন--আমিও পড়েছি। সেই গ্রন্থটিকে যদি সত্যনির্ভর ইতিহাস বলে মানতে হয় তাহলে এই দু’দিন ধরে নন্দীগ্রাম নিয়ে যেসব হুঙ্কার শুনতে হচ্ছে তা পুরোপুরি অসত্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মানতে হয়। আজকের বক্তব্যগুলোকে সত্য বলে মনে করতে হলে ‘নন্দীমা’ গ্রন্থটিকে চুপি চুপি পুড়িয়ে ফেলতে হয়। নন্দীমা গ্রন্থটিকে সত্যউন্মোচনের দলিল হিসেবে মান্যতা দিতে হলে আজকের ‘সত্য উচ্চারণ’কে মিথ্যে বলে খারিজ করে দিতে হয়। যদিও নন্দীগ্রামের মানুষই জানেন প্রকৃত ইতিহাস। অন্যের মুখে ঝাল সাধারণতঃ খেতে চায় না লোকজন। নন্দীগ্রামের ঘটনায় যদি সত্যি সত্যি অধিকারী বাপ-ছেলের কোনো ভূমিকাই না থেকে থাকে তাহলে অধিকারী পরিবারের লোকজন এত মন্ত্রীত্ব সাংসদ বিধায়ক-চেয়ারম্যান সহ আরও অনেক পদ গত দশ বছর ধরে পেল কেন? ভূমি উচ্ছেদ আন্দোলন কারীদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও শুভেন্দু’র বিরুদ্ধে কেন মামলা হয় নি--এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা পুলিশের। কিন্তু বুদ্ধবাবু নন্দীগ্রামে সূর্য্যােদয় ঘটাতে যে তিনজন পুলিশ অফিসারকে পাঠিয়েছিলেন এবং যারা গুলি চালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের তিনজনেরই নাম চার্জশিটে থাকলেও তৃণমূল সরকারে বসেই তাদের দু’জনের পদোন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি সত্যজিৎ বানার্জ্জীকে গলায় মালা দিয়ে দলের সম্পদ করে নিল কেন এই প্রশ্নর উত্তরও তো মানুষ চাইছে ! এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সুবিখ্যাত ‘নন্দীমা’ গ্রন্থটিতে পাওয়া যাবে না। তবু যারা এখনো এই গ্রন্থটি পড়েন নি--তারা পড়ে ফেলুন। বহু বিভ্রান্তি দূর হয়ে যেতে পারে।
নন্দীগ্রামের মাটিতে শুভেন্দুকে হারাতে ‘নন্দীগ্রাম’কে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে সর্বনাশের আর কিছুই বাকি থাকল না। পাকে পাকে জড়িয়ে যাচ্ছে সন্দেহ চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের জালে দলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। যে ভাষায় যে ভঙ্গিতে নন্দীগ্রাম সংগ্রামকে বাজি ধরার মরিয়া চেষ্টা করতে হল তাতে রাজনৈতিক ফায়দা কতটুকু হতে যাচ্ছে তা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সময়ও আর হাতে নেই। হাতের সব ঢিল বেরিয়ে গেছে--আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এইসব কথা যদি মাস ছয়েক আগে বেরিয়ে আসতো তাহলে মূল লড়াইটা হতো সিপিএম তথা বামফ্রন্টের সঙ্গে বিজেপি’র। তারা বেশ খানিকটা গুছিয়ে মাঠে নামতে পারতো--এখন আর তত সময় নেই হাতে। তবু, বাম জোট প্রত্যাশার চেয়ে খানিকটা হলেও বেশি করেই তৃণমূলের মাটি কেটে নেবে বলেই আমার ধারণা। শুধুমাত্র শুভেন্দুকে হারাতে--বলা ভাল প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে নন্দীগ্রামকে মারাত্মকভাবেই বাজি রাখা হল। এর ফলে যে ক্ষতির মুখে তৃণমূলকে দাঁড়াতে হবে তা পূরণ করা এই মুহূর্তে সম্ভব হবে না !!
কোন মন্তব্য নেই