প্রথম যৌবনের স্বপ্নের রাজপুত্র...
প্রশান্ত চক্রবর্তী
বাবার পেলে। আমার মারাদোনা। দুই স্বপ্নপুরুষ ফুটবলের। বাবা যৌবনে ফুটবল
খেলতেন। ডিস্ট্রিক্টেও খেলেছেন। আমিও ছোটবেলায় খেলতাম। প্রথমে জাম্বুরা বা বাতাবি।
পাঁচ নম্রি সাইজ। এরপর খড়-পলিথিন-কাপড়~যা জোটে সেটা দিয়ে কোনোরকম একটা গোলাকার কিছু হলেই হলো। স্কুল থেকে এসে গোরু
নিয়ে মাঠে যেতাম। আশপাশের গাঁয়ের যত গোরখিয়া-রাখাল এসে জুটত। কম আলের জমিই ছিল
মাঠ। গাছের ডাল দিয়ে, বা বাঁশের গোল
পোস্ট। খালি পা। ধান কাটার পর নাড়া শুকিয়ে এলেই খেলাধুলার ধুম পড়ে যেত। আর শেষ
হতো প্রথম বিষ্টির সিজনে কাদা-টাদা মেখে, পা পিছলে আলুর দম হওয়ার সময়।
সেই গণ্ডগ্রামে রাখালিয়া জীবনেও এক
স্বপ্নের খিলাড়িমারাদোনা। সবার মুখে মুখে। তবে, ফুটবলের গপ্প উঠলেইবাবা শুরু করতেনপেলের গল্প।
আমাদের নেশা মারাদোনায়। কী করে সম্ভব! টিভি? সে তো দুর্লভ। রেডিও ছিল একমাত্র ভরসা। টিভি তো
দু-চার দশ গ্রাম মিলে একটা। গঞ্জের বাজারে একটা কি দুটো। চুরাশি সালে আমি প্রথম
টিভি দেখি। ইন্দিরা গান্ধির দাহ। মধ্য অসমের লংকা বাজার। নাইনে পড়ি। গান শিখতে
যেতাম লংকায়। লামডিং থেকে আসতেন গানের মাস্টারমশাই মতিলাল মজুমদার। একদিন সারেগামা
আরোহ অবরোহ সেরে ফিরছিলস্করপাথার রোডের কোনায় 'রেডিও হাউস', ছোড়দা ওখানে রেডিও মেকানিকের কাজ শেখেপথের
ধারে ওরা টিভি বসিয়েছে। লম্বা অ্যান্টেনাতিনখানা বাঁশ জোড়া দিয়ে। চারদিকে রশি।
যেন হীরক রাজার মূর্তি। তিনচারজন মিলে অ্যান্টেনা ঘোরায়। সাদা কালো টিভিতে
ঝিরিঝিরিকিলবিল করছে বিন্দুবিন্দু স্ক্রিন। অকস্মাৎ একটুখানি পিকচার বা সাউন্ড
এলেই'আইছে আইছে' রব। এবং ছবি একটু পরিষ্কার হলেই~'অইব অইব' সমবেত চিৎকার।
গ্রামে একটু ধনাঢ্য বাড়িতে একখানা
টিভি। ফলে উপচে পড়া ভিড়। শয়ে শয়ে লোক। ১৯৮৬। সালটা মনে থাকার কারণসে-বছর
মাধ্যমিক দিয়েছি। পরীক্ষা দিতে না দিতেই ফুটবলের মহারণবিশ্বকাপ।
"মারাদোনা" এই নামটি বুকের ভেতর ছলাৎ করে ওঠে। মনে হয়যেন কল্পলোকের কোনো
রাজকুমার। দিনরাত একাকার। টিভি কেনার ধুম পড়ে। লোকে জমি বন্ধক দিয়ে টিভি
কিনেছেএমনও হয়েছে। এত্ত ভিড় যেভালোরকম দেখা যায় না। উঠান ভরা। গাছতলাএমনকি গাছের
ডালও বাদ যায় না। মুড়া, বস্তা, চট, খড়, পাটি, ধাড়ি, গাছের ঠ্যাংগাযা জোটে, তাতেই লোকে
লোকারণ্য। সামনে জায়গা না-জুটলে কপাল মন্দ। অগুনতি মাথার মধ্য দিয়ে চোখ ফেলার অতি
কষ্টকর প্রচেষ্টা। ফুটবল মানেই উন্মাদনা। তাতে বিশ্বকাপ। একে নাচুনি বুড়িতাতে
পড়ছে ঢোলকের বাড়ি। আমাদের আর পায় কে! বাঁদরামো ছেড়ে দিনরাত মারাদোনা মারাদোনা
করি। বাবা বা দাদারা রেডিও কানে লাগিয়ে বসা। ধারাবিবরণী। সেটা ভিন্ন স্বাদের আরাম।
কল্পনায় দেখা। গোল হতেই~সারা গ্রাম জুড়ে
'গৌল গৌল' চিৎকার। নাচনকোদন। বেশির ভাগই আর্জেন্টিনার
সমর্থক। ব্রাজিলেরও আছে কয়েকজন। কিন্তু আর্জেন্টিনা মানেই মারাদোনা, মারাদোনা মানেই আর্জেন্টিনা। একটা দেশ একজন
ফুটবলারের দ্বারা পরিচিত হচ্ছে বিশ্বে। ভাবা যায়!!!
মনে আছে'শুকতারা' আসত। হোজাই বা লংকা স্টেশনের হুইলার থেকে নিয়ে
আসত দাদা ছোড়দা কেউ। কিংবা পপুলার বুকস্টল। বিশেষ মারাদোনা-সংখ্যা। মাতব্বর গোছের
কেউ হঠাৎ শঙ্খ বিড়ি, বা মাদার ইন্ডিয়া
বা নাসির বিড়িতে টান দিয়ে বলতেন"যেতাই কও ভাই, পেলে কিন্তু পেলেই। হের কুনু তুলনা অয় না।
" চারপাশে লোকজনের চোখ কটমট করত। তাদের মারাদোনার এমন অপমান! এই মারে তো সেই
মারে। ইমোশনের তুলা আশি 'টেকা'।
সেই মাসুম-চেহারার মারাদোনা শেষমেশ
ফাইনালে বিশ্বকাপ জয়ী হলেনই। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভিতে সোনালি বিশ্বকাপটির রং
বোঝা গেল না। না যাক, তাও রাত জেগে
গঞ্জ গ্রামের মানুষ তাঁর বীরত্ব দেখল। চার পাঁচজন প্রতিপক্ষ খিলাড়িকে ডানে বাঁয়ে
পাশ কাটিয়ে কী অবলীলায় দুপায়ে অলীক মায়া মেখে, অলৌকিক যাদু দেখিয়ে গোল করছেন...মাই গড!!
ফাইনালে নাকি তাঁর হাতে লেগে গোল হয়েছে। এমন অপমানকর অভিযোগে রাগেদুঃখে টিভি ভাঙার
উপক্রম। তাঁর কোনো দোষ হতে পারে!!? সম্ভব?!
হ্যাঁ, তিনিও মানুষ। রক্তমাংসে মানুষ। তাও মন মানে না।
মনে হয় অতিমানব। কিন্তু না~তিনিও ভুলেশুদ্ধে
হাড়েমজ্জায় মানুষ। বিশ্বসেলিব্রেটির মর্যাদায় উঠেছিলেন। ওইটুকুন বেঁটে ছোটখাটো
টানটান বাঁটুল শরীর। তার কী অপরিসীম জাদু! কী মহিমাময়, আলোকময় উত্থান।
কিন্তু ধরে রাখতে পারলেন না।
বিচিত্র বদভ্যাস, বদমেজাজবেপরোয়া
জীবনতাঁকে অদ্ভুত অন্ধকারে ঠেলে দিল। ফুটবলের রাজপুত্র হয়ে উঠলেনউচ্ছৃঙ্খল এক
আইকন। পরিণাম অনিবার্য। বেঢপ শরীর জন্ম নিল। এ কী করে সম্ভব?! বিশাল পেট। বিরাট ওজন। মনে হচ্ছিলথাইরয়েড আর
সুগারের পিণ্ড। তাল তাল মাংস। মদ্যপানজনিত ঝোলা চেহারা, ঝুলে পড়া গাল, চোয়াল। উদরদেশে চর্বির স্তূপ। একজন বিশ্বসেরা
ফুটবলারের শরীর কী করে এমন হলো!!!
এই অকালমৃত্যু বড় কষ্টের। এই বছরটা বড্ড কুফার। 'একে-একে নিভিছে দেউটি'।
আমার প্রথম যৌবনের স্বপ্নের রাজপুত্রের এই অকালপ্রয়াণ মেনে নিতে পারছি না।
কোন মন্তব্য নেই