তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের সম্পত্তি বেদখল !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলায় কুমার নদের
পাশে ছোট্ট একটি গ্রাম,
নাম
বাগুটিয়া। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ জানে না তাদেরই গ্রামের একটি পরিবারে জন্মগ্রহন
করেছিলেন এমন একজন বিপ্লবী যাকে নিয়ে গর্ব করে সমগ্র ভারত উপমহাদেশ। যিনি অধিকার
বঞ্চিত গনমানুষের বিপ্লব ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস। যার পর্বপুরুষের বসত ভিটে
এখনো রয়েছে এই গ্রামে।
গ্রামের মানুষ শুধু জানেন বাড়িটি এক সংগ্রামী
মানুষের। তবে অধিকাংশ মানুষই জানে না বাড়িটির ইতিহাস।
গ্রামের একপ্রান্তে কাঁচা রাস্তার পাশে
চুন-সুড়কি দিয়ে গাঁথা ৯ রুমের পুরাতন একটি দ্বিতল বাড়ি। এলাকাবাসী জানেন বাড়িটি
হিন্দু সম্প্রদায়ের কারো ছিল, এখন কিয়াম উদ্দিনের ছেলেরা বসবাস করেন। তারা কিভাবে মালিক হয়েছেন তা কেউ বলতে
পারেন না।
সেই সংগ্রামী মানুষটি হচ্ছেন তেভাগা
আন্দোলনের নেত্রী,
সংগ্রামী
নারী,
নাচোলের
রানী ইলা মিত্র। আজ ১৩ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া
গ্রামে রয়েছে ইলা মিত্রের পৈত্রিক বাড়ি। ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আজো বাড়িটি দাঁড়িয়ে
থাকলেও রয়েছে বে-দখল। ভেঙে পড়তে শুরু করেছে ইটের গাথুনিগুলো। চওড়া দেওয়ালে ঘেরা
প্রাচীরের অনেক অংশ ভেঙে ফেলেছে দখলদাররা। শুধু বাড়ি নয়, দখল করা হয়েছে বাবা নগেন্দ্রনাথ
সেনের রেখে যাওয়া শত শত বিঘা জমি। সরকারের খাতায় এগুলো ভিপি তালিকাভুক্ত হলেও
বাস্তবে এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে।
ইলা মিত্র বাংলাদেশের কিংবদন্তী নারী। বাবা
নগেন্দ্রনাথ সেনের চাকরির সুবাদে ইলা সেনের জন্ম কলকাতায়। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর
তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বেঙ্গলের ডেপুটি
অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল। মা মনোরমা সেন গৃহিনী।
ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রাম তাদের পৈত্রিক
নিবাস। ইলা মিত্রের জন্ম কলকাতায় হলেও ছোট বেলায় তিনি বেশ কয়েকবার বাগুটিয়া গ্রামে
এসেছেন। ১৯৪৫ সালে চাপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার বাড়ির রমেন্দ্রনাথ মিত্র’র সঙ্গে ইলা সেনের বিয়ে হয়। বিয়ের
পর তার নাম হয় ইলা মিত্র।
ইলা মিত্রের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে যতটুকু
জানা যায়,
১৯৪৩ সাল
থেকে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত
চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোল অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনের সময় তার
ওপর পুলিশের অমানবিক নির্যাতন চলে।
১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগার থেকে প্যারোলে
মুক্তি পেয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর তিনি কলকাতার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গনতান্ত্রিক
আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি কলকাতার মানিকতলা নির্বাচনী এলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গ
বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। কর্মজীবনে তিনি কলকাতা সিটি কলেজের বাংলা সাহিত্যে
অধ্যাপিকা হিসেবে ১৯৮৯ সালে অবসর নেন।
ইলা মিত্রের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়
পুরাতন আমলেন নিদর্শন চুন-সুড়কির তৈরি দ্বিতল বাড়িতে বসবাস করছেন হাজি কিয়াম
উদ্দিনের তিন সন্তান।
বড় ছেলে আলী হোসেন জানান, তারা বাগুটিয়া ১১৬ নং মৌজার ২৩৪৫
দাগের জমির উপর বাড়িটিসহ ৮৪ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। বাবা হাজি কিয়াম উদ্দিন বহু আগে
ইলা মিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের শাশুড়ি সরদিনি সেনের কাছ থেকে এই জমি ক্রয় করেন।
সরদিনি সেন কিভাবে এই জামির মালিক হলেন তা
তিনি বলতে পারেন না বলে জানান। তিনি ছাড়াও তার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম, আব্দুর রশিদ ও রাশিদুল ইসলামের
পরিবার এখানে বসবাস করেন। মূল ঘরটির পাঁচটি রুম ব্যবহার করা যায়। সেগুলো ভায়েরা
ভাগ করে নিয়েছেন। বাকি রুমগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
কিংবদন্তী নারী ইলার শৈশব কৈশর সময় পার করা
বাগুটিয়া,
গোপালপুর, শেখরা, রঘুনন্দপুর, শাহাবাজপুরসহ কয়েকটি গ্রামে। তার
বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন,
মা মনোরমা
সেন,
দাদা
রাজমোহন সেনের নামে রয়েছে কয়েকশ’ বিঘা জমি। এসব ভিপি সম্পত্তি হিসাবে সরকারি খাতায় থাকলেও তার সবটুকুই এখন
বে-দখল। তবে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জানান এসব সম্পত্তির ব্যাপারে সেটেলমেন্ট
অফিসে আপত্তি ও দুই শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে।
ইলা মিত্রের পরিবার সম্পর্কে ওই গ্রামের
বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম জানান, তারা শুনেছেন নগেন্দ্রনাথ সেন নামে এক ব্যক্তি তাদের এলাকার ছোট-খাটো জমিদার
ছিলেন। বাগুটিয়াসহ পাশ্ববর্তী কয়েকটি মৌজায় বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের অঢেল
জমি-জিয়ারত ছিল। যা বর্তমানে এলাকার প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে।
কিয়াম উদ্দিন ছাড়াও আমিনুল ইসলামের দখলে
রয়েছে ওই নগেন্দ্রনাথ সেনের সিংহভাগ জমি। তবে তিনি যে ইলা মিত্রের বাবা ছিলেন এটা
তারা জানতেন না। তার দাবি বাড়িটি যদি ইলা মিত্রের হয় তাহলে এটি সংরক্ষণ করা জরুরি।
কারণ এটা রক্ষা হলে এক কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস রক্ষা হবে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী
সুলতানা জামান বলেন,
নতুন
প্রজন্মের মানুষের কাছে ইলা মিত্রের এই অঞ্চলের ইতিহাস তুলে ধরা উচিৎ এর জন্য
সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
সিপিবির ঝিনাইদহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক
স্বপন বাগচী জানান,
নির্যাতন
নিপিড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে আসা নারী নেত্রী ইলা মিত্রের শৈলকুপার পৈত্রিক
সম্পদ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও বাড়ি দর্শনীয় করে তোলা উচিৎ।
বাগুটিয়াসহ পাশবর্তী বেশ কয়েকটি মৌজায় জনৈক
নগেন্দ্রনাথ সেন,
তার স্ত্রী
মনোরমা সেন,
পুত্র
নৃপেন্দ্রনাথ সেন এর নামীয় বেশ কিছু জমি ১৯৬৫ সালের ভিপি তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে
পুরাতন ওই ভবনটিও রয়েছে।
শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ
আলী প্রিন্স জানান,
ইলা
মিত্রের পৈত্রিক সম্পদ সম্পত্তি কিভাবে আছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বিনিময় করে
একটি পরিবার মূলবাড়িতে থাকেন বলে শুনেছেন তবে তিনি বলেন অনেক সম্পদ বেদখল আছে এটাও
শুনেছেন। শৈলকুপা উপজেলা চেয়ারম্যান নায়েব আলী জোয়াদ্দার জানান, ইলামিত্রের পৈত্রিক ভিটাবাড়ি
সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর এই মহিয়সী নারী
কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ইলা মিত্রের অসাধারণ সাহসী ও সংগ্রামী জীবন বাংলাদেশ ও
পশ্চিম বাংলার প্রগতিশীল মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। তাই এখানকার মানুষের দাবি
ইলা মিত্রের পৈত্রিক ভিটাবাড়ি, সম্পদ সংরক্ষণ ও দর্শনীয় করে তোলা হোক।
কোন মন্তব্য নেই