নানা রূপে মহামায়া !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
দেবী দুর্গা প্রাচীনকাল থেকেই ভক্তদের মাঝে নানারূপে পূজিতা হয়ে আসছেন। বঙ্গদেশে মৃন্ময়ী দশভুজা দেবী দুর্গার পূজা ঠিক কবে থেকে বা কে শুরু করেন, তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বহু মতভেদ আছে। অনেকের মতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে বাংলাদেশে দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে সত্যযুগে রাজা সুরথ তাঁর রাজধানী বলিপুরে প্রথম দেবী দুর্গার পুজো প্রারম্ভ করেন। এ সময়ে দেবীর দশভুজা মূর্তি প্রচলিত ছিল না, চতুর্ভুজা বা অষ্টভুজারূপেই দেবী পূজিতা ছিলেন। সে পুজো বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে এই পুজোকে ‘বাসন্তী পুজো’ বলা হয়ে থাকে। কোনো কোনো পণ্ডিত বলিপুরকে বর্তমান বীরভুম জেলার বোলপুর বলে অনুমান করে থাকেন। যদিও এই অনুমানের ভিত্তি খুব জোরালো নয়।
শারদীয় দুর্গোৎসবের সূত্রকার হিসেবে সত্যযুগের পর ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্রের নাম সর্বজনবিদিত। রাবণকে বধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে লঙ্কা যাওয়ার আগে সৌরাশ্বিন মাসে ব্রহ্মার দ্বারা দেবী দুর্গার বোধন করিয়ে তিনি দুর্গাপুজো করেন। পৌরাণিক মান্যতা অনুসারে শরৎকালে দেবদেবীরা নিদ্রিত থাকেন। শ্রীরামচন্দ্র অসময়ে দেবীকে জাগ্রত করে পুজো করেছিলেন বলে এই পুজোকে ‘অকালবোধন’ বলা হয়। রাবণ বধের জন্য রামচন্দ্রের মহেশ্বরী পুজোর উল্লেখ কৃত্তিবাসের রামায়ণেও রয়েছে।
বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা মূল রামায়ণ থেকে যখন বঙ্গানুবাদ করলেন তখন তা বাল্মীকি-রামায়ণের অনুসারী হলেও তাতে বহু পরিবর্তন ঘটল। কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাংলার প্রকৃতি-পরিবেশ, মানসিকতা ও সংস্কৃতির সমাবেশ ঘটল--সৃষ্টি হলো এক নতুন রামায়ণ ; যাকে বাঙালি সর্বান্তঃকরণে তাদের পুরাণ হিসেবে গ্রহণ করল। তাই বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে দুর্গা তার অসুরদলনী রূপ ছাপিয়ে কন্যারূপেই অধিকতর প্রতিষ্ঠিত। এই কন্যা বৎসরে একবার সপরিবারে আসেন পৃথিবীতে তাঁর পিতামাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। চারদিন থেকে পঞ্চম দিন ফিরে যান নিজগৃহে। ঠিক যেভাবে আসে বাঙালি গৃহস্থ বাড়ির কন্যা তার পিতামাতার বাড়িতে।
প্রাচীন পৌরাণিক সাহিত্যে পুত্র-কন্যাসহ দুর্গাপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায় না। সেখানে পাওয়া যায়, আর্য সাধকরা মহাশক্তিরূপে দেবী ভগবতীর দর্শনলাভের সাধনা করছেন। কোন মহাশক্তির বলে জগৎ এত মোহময়ী? তার উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা বুঝলেন, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের যা শক্তি সেই সমষ্টিশক্তিই দশভুজা দুর্গা। বেদে ‘দুর্গা’ অর্থে এই মহাশক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ভগবতী অথর্ববেদে দুর্গারূপে চিহ্নিত। উপনিষদে ও শুক্লযজুঃ সংহিতায় দেবী অর্থে ‘দুর্গি’ শব্দ এবং ‘অম্বিকা’ শব্দ দেখতে পাওয়া যায়।
শুধু পুরাণেই নয়, ভারতের ইতিহাসেও এই শক্তি-পুজোর উল্লেখ রয়েছে। প্রয়াগ নগরীর লাট-প্রস্তরলিপি থেকে জানা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর আগে গুপ্তবংশীয় রাজাদের মধ্যে কেউ কেউ শক্তি-উপাসক ছিলেন। কান্যকুব্জের রাজা মহেন্দ্রপালদেব ও তার পুত্র বিনায়কপালের তাম্রলিপিতে কান্যকুব্জের রাজারা যে প্রায় সকলেই শক্তি-উপাসক ছিলেন তার পরিচয় রয়েছে। গৌড়েশ্বর মহারাজ লক্ষণ সেনের তাম্রলিপিতেও দেবী দাক্ষায়ণীর প্রতিমূর্তি থেকে ইতিহাসকাররা অনুমান করে থাকেন যে, এই দেবী সেন রাজাদের কুলদেবী ছিলেন। বর্তমানে দুর্গাপুজো বাঙালি সমাজে বহুল জনপ্রিয় হলেও মধ্যযুগের আগে পর্যন্ত বাংলায় দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীতে অবিভক্ত বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে প্রথম এই পুজো হয়েছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে পুজোর প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বড়িশাতে রায়চৌধুরী পরিবারে এবং ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে আসামের রংপুর অঞ্চলে। এরপর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের উদ্যোগে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়।
এই সময় পর্যন্ত দুর্গাপুজো শুধুমাত্র উচ্চ সমাজে অর্থাৎ রাজ পরিবার এবং জমিদার শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষের তাতে কোনো অধিকার ছিল না। কিন্তু মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। তারা চায় মনের সঙ্গে মনের রং মেশাতে। আনন্দকে তারা সকলে মিলে একত্রে ভোগ করতে চায়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই প্রায় সমকালে উড়িষ্যার রামেশ্বরপুর নামক অঞ্চলে গ্রামবাসীরা মিলিত হয়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। এই পুজোর মধ্যেই সার্বজনীন দুর্গাপুজোর পূর্বাভাস লক্ষ করা যায়। এরপর ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় ১২ জন ব্রাহ্মণ মিলিত হয়ে সর্বপ্রথম একচালা মূর্তিতে ‘বারোয়ারি’ দুর্গাপুজো করেন। ১২ জন বন্ধু (ইয়ার) মিলে পুজোটি সুসম্পন্ন করায় এর নাম বার-ইয়ারি বা বারোয়ারি হয়েছে বলে জানা যায়। সেকালের ‘বারোয়ারি’ আজকের সাধুভাষায় বহুজনের মিলিতি প্রয়াসে ‘সার্বজনীন’ বা ‘সর্বজনীন’ পুজোর রূপ নিয়েছে।
বিশ্বের সমস্ত শক্তির মিলিত রূপ শ্রীশ্রী দুর্গা। শিব, দুর্গা বা কালী সব একই শক্তি। ঈশ্বরের মাতৃরূপ শ্রী দুর্গার মধ্যেই প্রকৃত রূপে বিদ্যমান। এই মহাশক্তির আরাধনায় আমরা দেবীকে বিভিন্ন রূপে বন্দনা করি। আমরা শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে দেখতে পাই তার একেকটি রূপ যা নবদুর্গা নামে আখ্যায়িত হয়েছে। এই নবদুর্গার নয়টি রূপ আছে। রূপগুলো হচ্ছে—শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রী, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী। এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথি থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত তিন দিন শ্রীশ্রী দুর্গা দেবীর অর্চনা হয়ে থাকে। সপ্তমী তিথিতে দুর্গাপূজার অন্যতম অনুষ্ঠান হচ্ছে নবপত্রিকা। অনেকে মনে করেন যে, দুর্গা আসলে শস্যদেবী। নবপত্রিকা কৃষি সম্পদের প্রতীক। সত্যিকার অর্থে নব পত্রিকায় যে নয়টি উদ্ভিদ আছে তার সবগুলোকে শস্য বলা চলে না। যেমন—মান, বিল্ব, কচু ও দাড়িম্ব শস্য হিসেবে গণ্য নয়। শস্য হিসেবে ধানের সঙ্গে গম, যব, কলাই, ইক্ষু ও তিল ইত্যাদিকে বুঝায়। নবপত্রিকা কিন্তু নয়টি গাছের পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ। এই নয়টি উদ্ভিদ হচ্ছে—কদলী, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, দাড়িম্ব, অশোক, মান ও ধান। একটি সপত্র কদলী বৃক্ষ বাকি আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ অথবা সপত্র শাখা একত্রিত করে একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর লাল পাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর মতো সাজিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দেবীর দক্ষিণে গণেশের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এটির লোকজ প্রচলিত নাম কলা বউ। তবে এটি গণেশ ও কার্তিকের বউ নয়, স্বয়ং দুর্গারই আরেক মূর্তি বা প্রতীক। নব পত্রিকায় যে নয়টি বৃক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তারমধ্যে প্রত্যেকটি বৃক্ষকে দেবীর একেকটি রূপ কল্পনা করা হয়েছে। যেমন—কলা গাছকে ব্রহ্মাণী, কচু গাছকে কালিকা, হরিদ্রা গাছকে উমা, জয়ন্তী গাছকে কার্তিকী, বিল্ব বৃক্ষকে শিবা, দাড়িম্ব গাছকে রক্তদন্তিকা, অশোক গাছকে শোকরহিতা, মান কচুকে চামুণ্ডা, ধান গাছকে লক্ষ্মীরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
দুর্গাপূজার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কুমারী পুজো। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিন দেবী পুজো শেষে কুমারী পূজো করা হয়। সাধারণতঃ কুমারী বলতে বোঝানো হয় অবিবাহিত কন্যাকে। কিন্তু দেবীপূরাণ মতে, এক বছর বয়স থেকে ষোল বছর বয়সের বালিকারা ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত কুমারীরূপে পূজিতা হওয়ার যোগ্য। একেক বর্ষীয়া কুমারীদের একেক নাম আছে। এক থেকে ষোড়শ বর্ষীয়া কুমারীদের নাম যথাক্রমে—সন্ধ্যা, সরস্বতী, ত্রিধামূর্তি, কালিকা, সুভগা, উমা, মালিনী, কুজিকা, কাল সন্দর্ভা, অপরাজিতা, রুদ্রাণী, ভৈরবী, মহালক্ষী, পীঠনায়িকা, ক্ষেত্রজ্ঞা, অম্বিকা। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা সমাপনান্তে প্রতিদিন কুমারী বালিকাকে অভ্যর্থনা করে এনে নতুন বস্ত্র পরিধান করিয়ে দেবীজ্ঞানে পুজো করা হয়। দেবীপুরাণ মতে, দেবীপুজোর পর উপযুক্ত উপাচারে কুমারীকে ভোজন করানো হয়। তান্ত্রিক মতে, কুমারী হলো দেবীর প্রতীক। কুমারী পুজো ছাড়া হোম প্রভৃতি সকল কর্ম পরিপূর্ণতা লাভ করে না। কুমারী পুজো করলে সেই ফল অবশ্যই লাভ হয় বলে বিশ্বাস। সেজন্যই দুর্গাপুজোয় কুমারী পুজো অপরিহার্য অঙ্গরূপে স্বীকৃত হয়েছে। দুর্গাপুজোর উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সন্ধিপুজো। দু-টি তিথি পরস্পর খুবই কাছাকাছি হলে দুই তিথির মিলনকে সন্ধি বলে এবং ওই সময়ের পুজোকে সন্ধিপুজো বলা হয়। তাই দুর্গাপুজোর অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিস্থলে দেবীর বিশেষ পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই বিশেষ পুজো সন্ধিপুজো নামে প্রসিদ্ধ।
যেকোনো পুজোর মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মশুদ্ধি, আত্মনিবেদন, মনের পশুশক্তি দমন, জগতের কল্যাণ আর প্রিয়পরমের সান্নিধ্য লাভ করা। পুজোর মূল উদ্দেশ্য অক্ষুণ্ণ রেখে আনুষঙ্গিক আনন্দ-উল্লাস চলতে পারে। দুর্গোৎসবের একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ ও আনন্দদায়ক কাজ হলো দুর্গাপুঁথি বা দুর্গাজাগরণ গাওয়া। আজকাল পুজো মণ্ডপের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও বাড়েনি দুর্গাজাগরণের প্রসার। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আগে যেসব গায়ক বা মাতৃভক্ত দুর্গাপুঁথি পাঠ করতে জানতেন তারা সেই বিদ্যা নতুন প্রজন্মকে যথাযথভাবে শিখিয়ে যেতে পারেননি। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু পূজামণ্ডপ ছাড়া আর কোথাও দুর্গাপুঁথি শোনাই যায় না। তবে পুঁথি পাঠকদের উৎসাহমূলক পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারলে দুর্গোৎসবের পূর্ণতা দানকারী এই পুঁথি শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। অবশ্য দুর্গাপুঁথির বদলে এখন মণ্ডপে মণ্ডপে প্রায়ই চণ্ডীপাঠ শোনা যায়। তবে নির্ভুল চণ্ডী-পাঠকের সংখ্যাও দ্রুত কমে আসছে--রেকর্ড ছাড়া চণ্ডীপাঠ অল্পস্বল্প আরও কিছুদিন হয়তো শোনা যেতে পারে !
কোন মন্তব্য নেই