লকডাউনে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে শ্রমজীবী গরিব মহিলারা
দিগন্ত শর্মা
(জীবন সংগ্রাম দুই)
শ্রমজীবী মহিলাদের জীবন জীবিকা অনিশ্চিত
আমাদের ক্ষেত্রভিত্তিক অধ্যয়নে দেখা গেছে আগের তুলনায় এই মহিলাদের উপার্জন কমেছে ঠিক, কিন্তু ব্যবসার জগতে এসে তারা স্বাধীনচেতা হচ্ছেন, অন্য মহিলাদের সাথে মত বিনিময়ের সুযোগ পাচ্ছেন, ঘরের চার দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসছেন। ঘরোয়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন ও নির্ণায়ক ভূমিকা নিচ্ছেন এবং বাস্তবতার কঠোর পরিস্থিতির সাথে মোকাবেলা করার জন্য মানসিক শক্তি পাচ্ছেন। লকডাউনের প্রভাবে কামরূপ মহানগরীর বহু মহিলার কাজকর্মে নারী ক্ষমতায়নের এক অন্য রূপ দেখা গেছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে অনেক মহিলাই যারা ইতিপূর্বে গৃহশ্রমিকের কাজ করতেন, তারা ব্যবসার কাজে স্বনিয়োজিত হবার পর পুনরায় ওই বৃত্তিতে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সমীক্ষায় এটা সামনে এসেছে যে গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করার সময়ে বহু মহিলারা তাদের নিয়োগকর্তা মালিকপক্ষের দ্বারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মালিক পক্ষের দ্বারা একাংশ মহিলারা যৌন নির্যাতন তথা অশ্লীল আচরণের সম্মুখীন হওয়ার কথাও জানিয়েছেন। অনেক সময় কাজের বিনিময়ে সময়মতো উপযুক্ত মজুরিও পেতেন না তারা। লকডাউনের সময় বহু মালিকেরা হঠাৎ কাজ থেকে বের করে দেন গৃহশ্রমিক মহিলাদের এবং তারা যে ক’টা দিন কাজ করেছেন সেই হিসেবে মজুরি দেন। যার ফলে এমন গৃহশ্রমিক মহিলারা আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হন। এই লকডাউন বহু শ্রমজীবী মহিলাদের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত করে দেয়। এর প্রভাব পড়েছিল তাদের সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর। সাথে ছিল জীবিকা হারানোর জন্য মানসিক অশান্তিও। কিন্তু এর মধ্য দিয়েও বহু সংখ্যক মহিলারা এই নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন। অতিক্রম করেছেন বহু বাধা।
এ প্রসঙ্গে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘যুবা’-র পরামর্শদাতা তথা সমাজকর্মী পুজা নিরালা বলেন, ‘এই লকডাউন জীবিকার উপর নানাভাবে সংকট নামিয়ে এনেছে। এমনকি এক শ্রেণির
মানুষ ভিক্ষাবৃত্তির পথও বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি সামনে আসার কারণ
হচ্ছে রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য এযাবৎ বিশেষ কোনো আইন প্রণয়ণ করা
হয়নি যার দ্বারা তাদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। এমন জটিল পরিস্থিতির
জন্যই মহিলারা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন ও বৃত্তি পরিবর্তন করতে বাধ্য
হচ্ছেন। সরকারের উচিৎ এই বিপন্ন মহিলাদের জন্য শীঘ্রই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
জীবন-জীবিকার প্রশ্নকে অবজ্ঞা করে যেহেতু সমাজ নির্মাণ সম্ভব নয়, তাই এই মহিলাদের অধিকারের জন্য সরকার বিশেষভাবে
কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।’
ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং অমিয় কুমার দাস সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন
প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন গবেষক ড. সোনালী শর্মা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কামরূপ (মেট্রো) জেলার বিভিন্ন স্থানে রোজগারের
জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এভাবে মহিলাদের বেরিয়ে আসা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এটি
লকডাউনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রভাব। বিশেষ করে পথগুলোতে মহিলারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা
আরম্ভ করে রাজ্যে এক সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। স্বনির্ভরতার জন্য এক
গতিশীলতা আমরা লক্ষ্য করছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি উপলব্ধি করছি, যদিও আর্থিক সংকট থেকে উৎরাতে বা জীবিকা
পরিবর্তন হওয়াতে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে প্রকৃতপক্ষে এমন ঘটনা প্রমাণ করছে যে নারী
ক্ষমতায়ন থেমে থেকেনি। বরং মহিলা হওয়ার জন্য যারা কাজ হারিয়েছেন, তারাই আবার মহিলা হওয়ার জন্যই প্রশাসনের বাধা
অতিক্রম করে পথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে জীবিকার নতুন ভিত্তি তৈরি করেছেন।’
আরেকজন সমাজকর্মী রিহান আলির বক্তব্য হচ্ছে – ‘লকডাউনের জন্য রাজ্যের মহিলারা কীভাবে প্রভাবিত
হচ্ছেন তার এক নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে কামরূপ (মেট্রো) জেলার ফুটপাথে, রাজপথে, অলিগলিতে। প্রকৃতপক্ষে এসব মহিলারা ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র ব্যবসা আরম্ভ করে দেখিয়েছেন যে জেলায় যেসব কাজ পুরুষরা করতে পারেননি সেসব
কাজ তারা সম্ভব করে তুলেছেন। লকডাউনে দুর্বল করে দেওয়া সমাজটিকে তারা পুনরায়
আর্থিকভাবে সুস্থির করে তোলার জন্য অগ্রগামী সেনানীর ভূমিকা নিচ্ছেন। এই দৃশ্য
কেবল কামরূপ (মেট্রো) জেলার অলি-গলিতেই নয়, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে লকডাউনের সময়ে
মহিলারা বেরিয়ে এসে পুরুষের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে চলতে দেখা যাচ্ছে। যে পুরুষ একেকটি
পরিবারের সকল দিক সামলে নিচ্ছিলেন, বিভিন্ন
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নিচ্ছিলেন, সেই পুরুষদের আজকের পরিস্থিতিতে পেছনের সারিতে
থাকতে হচ্ছে এবং মহিলাদের দেখা যাচ্ছে পরিবার পরিচালনায় সামনে থেকে নেতৃত্ব
দিচ্ছেন। এই পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ।’
তাৎপর্যপূর্ণভাবে অসমের রাজধানীতে অবস্থিত কামরূপ (মেট্রো) জেলার
ফুটপাথে-রাজপথে-অলিগলিতে ছোটো ছোটো ব্যবসায় মহিলারা যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করছেন,
তা সমাজের তথাকথিত
লিঙ্গভিত্তিক কর্মবিভাজনের বিধিকে নস্যাৎ করছে। রিকসায় করে ফল বিক্রি করা ভানুমতী
রায়, তিন চাকার ঠেলায়
ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রি করা গোলাপী দাস, রাস্তার পাশে শাক-সবজি নিয়ে বসা সবিতা গড়, কৌশল্যা গোয়ালা, গীতা দর্জি, মইনা উপাধ্যায়ের মতো মহিলাদের বাড়িতে পুরুষ
থাকা সত্ত্বেও সামনের সারি থেকে নিজের পরিবারের আর্থিক নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। অথচ
এইসব মহিলাদের নেই কোনো উচ্চশিক্ষা বা ব্যবসার মূলধন। তবুও লকডাউনের দিনগুলোতে
নিজেদের অধিকার সাব্যস্ত করে পথের দখল নিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, এই মহিলারা একদিন কর্মহীন হয়ে পড়লেও আবার সেই
মহিলা হওয়ার জন্যই স্বনিয়োজনের মাধ্যমে একেকটি পরিবারকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে
পারেন ও সংকটের সময়ে অর্থনৈতিক বিপ্লবের পথে এগিয়ে যেতে পারেন তারাই।
- [দিগন্ত শর্মা--
রাষ্ট্রসংঘের ‘জনসংখ্যানিধি ও
পপুলেশন ফার্স্ট’, মুম্বাইর ‘লাডলি মিডিয়া ফেলোশিপ’ প্রাপক সাংবাদিক। এই প্রতিবেদন সেই ফেলোশিপের
অংশ। প্রতিবেদনে প্রকাশিত মন্তব্য সাংবাদিকের নিজস্ব। মন্তব্যের সাথে উক্ত
প্রতিষ্ঠান জড়িত নয়।]
লেখকের ইমেইল : diganta.saadin@gmail.com
ফোন নং : 8638698450
কোন মন্তব্য নেই