লকডাউনের প্রভাব : কেন শ্রমজীবী নারীদের বৃত্তি পরিবর্তন করতে হল?
দিগন্ত শর্মা
(জীবন সংগ্রাম এক)
রাজপথে-ফুটপাথে-অলিগলিতে অন্য রূপে নারী
রাজপথের পাশে রাখা একটি রিকসার সাথে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহিলা। যাত্রীর
অপেক্ষায় নয়, বরং গ্রাহকের
অপেক্ষায়। রিকসাটিতে সাজিয়ে রাখা ছিল বিভিন্ন ধরনের ফলমূল। কয়েক রকমের কলা,
আনারস, আপেল, ডালিম ইত্যাদি ফল বিক্রির জন্য রিকসাটিকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল একটি
ভ্রাম্যমাণ দোকানে – যেখানে বিক্রেতা
একজন মহিলা। গুয়াহাটি মহানগরীর হাতিগাঁও অঞ্চলের রাজপথের পাশে এই ভ্রাম্যমাণ ফলের
দোকানের বিক্রেতা এই মহিলার নাম ভানুমতী রায়। কোচ রাজবংশী জনগোষ্ঠীর বছর ৪৭-এর এই
মহিলা যে রিকসাটিতে ফলমূল বিক্রি করছেন, সেটি চালাতেন তার স্বামী প্রফুল্ল রায়। ৫৫ বছর বয়সী প্রফুল্ল রায়ের জন্য
রিকসাটি ছিল জীবনের চালিকাশক্তি। প্রফুল্ল-ভানুমতীর মূল বাড়ি পশ্চিম অসমের ধুবড়ি
জেলার গোলকগঞ্জ অঞ্চলে। দুই সন্তান নিয়ে কোনো এক দিন তারা চলে এসেছিলেন
গুয়াহাটিতে। মহানগরীর হাতিগাঁও এলাকায় ভাড়া করা ঘরে থেকে প্রফুল্ল রায় চালাতেন
রিকসা আর ভানুমতী কয়েকটি পরিবারে গৃহশ্রমিকের কাজ করে দিনগুজরান করতেন। নিজের
রান্নাঘর থেকে শুরু করে অন্যের রান্নাঘর সামলানো, কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার করা – সব কাজই করেন ভানুমতী। নবম ও সপ্তম ক্লাসে পড়া
দুই সন্তানের জীবন গড়ে তোলার জন্য প্রফুল্ল রায় হাড়-ভাঙা খাটুনি খেটে রিকসায় দিনভর
যাত্রী টেনেছেন, ভানুমতী অন্যের
ঘরে গৃহপরিচারিকার কাজ করেছেন। এভাবেই অব্যাহত ছিল তাদের জীবন যুদ্ধ। কিন্তু গত
মার্চ মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধ করার নামে সরকার ঘোষিত দেশব্যাপী লকডাউনে স্তব্ধ
করে দিল প্রফুল্ল-ভানুমতীর জীবন। রিকসা বন্ধ করতে হল, ভানুমতীকেও কাজ থেকে অব্যাহতি দিল পরিবারগুলি।
হাতে জমা থাকা টাকা-কড়িও শেষ হল। ঘরভাড়াও জমতে থাকল। লকডাউনও দীর্ঘায়িত হতে থাকে।
রিকসা নিয়ে আর বেরোতে পারেন না প্রফুল্ল। বেরোলেও মানুষ ওঠেন না রিকসায়। একদিন
রিকসা বার করতেই লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে পুলিশ। সেদিন থেকেই রিকসার চাকা আর ঘুরল না।
এমতাবস্থায় ভানুমতী সিদ্ধান্ত নিলেন, লকডাউনের সময়ে রিকসায় ফলমূল নিয়ে বিক্রি করবেন পথের ধারে। যে সময় পুরুষ মানুষ
কেউ ব্যবসা করলে পুলিশ লাঠিপেটা করে, সে সময়ে ভানুমতী পথের ধারে রিকসা রেখে ফলের দোকান আরম্ভ করলেন। ভানুমতী আমাদের
বললেন, ‘আমার কর্তা
দোকানে থাকলে পুলিশ এসে বাধা দেয়, কিন্তু আমি থাকলে
ওরা কিছু বলে না। একদিন আমাকেও বাধা দিয়েছিল। কিন্তু আমি প্রতিবাদ করে বলি যে যদি
আমরা কিছু না করি তো আমাদের জীবন চলবে কী করে ? স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ম মেনে আমি দোকান করেছি,
মহিলা হিসেবে নিজের পরিবার
চালানোর জন্য কিছু একটা করতে হবে তো, আমাকে বাধা দেবেন না। বর্তমানে আমি ব্যবসা করে যা উপার্জন করি তাতেই আমাদের
সংসার চলছে। আমার স্বামী কাজহারা হবার পর থেকে আমিই সংসারের ভার সামলাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, লকডাউনের সময়ে
রাস্তাঘাটে বহু পুরুষ পুলিশি নির্যাতনের শিকার হওয়ায় এমন সাধারণ ক্ষুদ্র
ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে গিয়েও পিছু হটতে হয়েছিল তাদের। তাই এগিয়ে আসতে বাধ্য হতে
হয়েছিল বাড়ির মহিলাদের। মহিলা হওয়ার সুবাদেই কর্মরত পুলিশকর্মীদের নির্যাতন থেকে
নিজেকে রক্ষা করে গুয়াহাটি মহানগরীর রাস্তাঘাটে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম
হয়েছিলেন তারা। ভানুমতী রায়ও তেমন একজন মহিলা। লকডাউনে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে
যাবার পরও পুলিশি নির্যাতনকে উপেক্ষা করে স্বামীর রিকসাটিকে অবলম্বন করে চালিয়ে
নিয়ে গেলেন জীবন-জীবিকার চাকা। লকডাউনে প্রভাবিত করা ভানুমতী রায় এমনই একজন মহিলা
যিনি বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য চিহ্নিত গৃহশ্রমিকের কাজ হারিয়েও সাহসের সাথে এই
রাজপথের ধারে বিপদকে উপেক্ষা করে জটিল পরিস্থিতিতে অব্যাহত রেখেছেন আর্থিক
সংগ্রামের যাত্রা। অর্থাৎ লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতেই ভানুমতীকে পরিবর্তন করতে হয়েছিল
বৃত্তি।
একই রকমের গল্প গোলাপী দাসের, যিনি মূলত বড়পেটা
জেলার পাঠশালা অঞ্চলের লোক। লকডাউনের সময়ে যাকে দেখা গিয়েছিল গুয়াহাটি মহানগরীর
বিভিন্ন প্রান্তে একখানা তিন চাকার ঠেলাগাড়িতে শাক-সবজি বিক্রি করে ঘুরতে। ৫৭
বছরের গোলাপী দাসও ছিলেন একজন গৃহশ্রমিক। লকডাউন ঘোষণা করার পর গোলাপী দাসকে তার
নিয়োগকর্তা পরিবারগুলো কাজ থেকে অব্যাহতি দেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা এই মহিলা
শ্রমিক তার স্বামীর সাথে বাস করেন গুয়াহাটিতে একটি ভাড়া ঘর নিয়ে। দিনমজুর স্বামী
কাজহারা হলেন এবং লকডাউনের সময়েও কোনো কাজ পাননি। ক’দিন জমা পুঁজি দিয়ে ঘর চলল, কিন্তু ধীরে ধীরে খাওয়া ও ঘরভাড়া দেওয়ার জন্য
অর্থের অভাব দেখা দিল। গোলাপীর স্বামী একদিন দৈনিক একশো টাকায় একটি ঠেলা ভাড়া করে
পথের ধারে শাক-সবজির পসরা সাজিয়ে বসেন। পুলিশ তাকে বাধা দেয় ও পিঠে লাঠি দিয়ে
আঘাতও করে। দু’দিন পর সেই
ঠেলাটি নিয়ে গোলাপী দাস নেমে এলেন পথে। একজন সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে অল্প কম দামে
কিছু শাক-সবজি কিনে নিয়ে ঠেলা সাজিয়ে বিক্রি করতে বেরোলেন তিনি। পুলিশের লোকজন
বাধা দিতে এলে গোলাপী তাদের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন। এভাবে লড়াই করে পথে পথে
ঠেলা নিয়ে শাক-সবজি বিক্রির কাজ চালিয়ে গেলেন। গোলাপী দাসকে লকডাউনের জন্য শুধু
বৃত্তি পরিবর্তন করেতে বাধ্য হতেই হয়নি, তাকে লিপ্ত হতে হয়েছে এক আর্থিক সংগ্রামেও। ঠেলা টেনে টেনে ব্যবসা করাটা কেবল
পুরুষেরই কাজ বলে যে চিরায়ত ধারণা, তাকে নস্যাৎ করে
মহিলা হিসেবে গোলাপী দাস অন্য এক পথের দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। পথে ব্যবসা করাটা
লকডাউনের বিধি মোতাবেক নিষিদ্ধ ছিল যদিও, গোলাপী দাস এই প্রাশাসনিক বাধা অতিক্রম করে সক্ষম হয়েছিলেন পথের দখল নিতে। যে
কাজটি তার স্বামী করতে পারছেন না, সেই কাজটি
অব্যাহত রেখেছিলেন গোলাপী। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের ফলে আমার জীবিকা পরিবর্তন করতে হল। আগে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘরোয়া
কাম-কাজ করার চেয়ে এখন নিজেকে বেশি স্বাধীন বলে মনে হচ্ছে। নিজের মতো করে ব্যবসা
করছি, উপার্জন কম হচ্ছে কিন্তু
মানুষের সাথে কথাবার্তা হচ্ছে, পথচারীর সাথে
আলাপ হচ্ছে। মনের কথা খুলে বলতে পারছি। লকডাউনের জন্য রোজগার অনেকটাই কমে গেছে।
কিন্তু নিজের ঘর ও অন্যের ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকা মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট করে
দেওয়া ঘর মোছা, বাসন-কাপড় ধোয়া
ইত্যাদি কাজ থেকে বেরিয়ে অন্য এক খোলা জায়গা পেয়েছি। পুলিশ ব্যতিব্যস্ত করার
চেষ্টা করে যদিও মহিলা হবার জন্য বিশেষ কিছু বলে না। স্বামী সকালের দিকে এসে কাজে
সাহায্য করে চলে যান, আমি দিনভর ঠেলা
টেনে টেনে অলি-গলিতে শাক-সবজি বিক্রি করি।’
৫২ বছর বয়সী সবিতা গড়। মহানগরীর নারেঙ্গি-চন্দ্রপুর সংযোগী পথের খাংকর এলাকায়
এই মহিলাকে দেখা গেছে কচু, বাঁশ-কড়ুল,
কলার মোচা, কলমি ইত্যাদি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে আছেন।
লকডাউনের সময়ে এই রাস্তায় যদিও লোকজনের চলাচল খুব কমই ছিল, তবুও তিনি অপেক্ষায় বসে থাকতেন কেউ না কেউ এসে
তার সামগ্রীগুলো কিনে নেবে। এই শাক-সবজিগুলো বিক্রি করে যে যৎসামান্য উপার্জন হবে
তা এই পরিবারের একদিন বা দু’দিন বেঁচে থাকার
সম্বল। কামরূপ (মেট্রো) জেলার অন্তর্গত পুব-খাংকর গ্রামের বাসিন্দা সবিতা গড়কে
রাজপথের ধারে লকডাউনের সময়ে সামান্য কয়েক পদ বস্তু নিয়ে বসতে হয়েছিল কেন ? এর আগে নির্দিষ্ট এই স্থানে কোনো মহিলাকে দেখা
যায়নি শাক-সবজি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসতে। লকডাউনে পথের ধারে ছোটোখাটো ব্যবসাগুলো
বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও সবিতা গড় এলেন কোত্থেকে ? এই প্রসঙ্গে সবিতার বয়ান – ‘আমরা ছোটো একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করছিলাম।
লকডাউন ঘোষণার পর সেই কাজ আর থাকল না। কাজ নেই তাই স্বামীও মজুরি পান না। একদিন
আমার স্বামী রাজু গড় জঙ্গল থেকে কিছু বাঁশ-কড়ুল, কচু, কলার মোচা ইত্যাদি সংগ্রহ করে এনে রাজপথের ধারে বিক্রি করার জন্য নিয়ে
বসেছিলেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে তাড়িয়ে দিল, সবজিগুলো পথের ধারে পড়ে রইল। তারপর আমি এসে
এগুলো নিয়ে বসলাম। আমার সাথে আরও তিনজন মহিলাও এলেন। আমরা খুবই গরিব লোক, দিন আনি দিন খাই। দু’দিন উপার্জন না করলে উপোষ থাকতে হয়। তাই করোনায়
মরার চেয়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে মরাটাই ভালো মনে করে আমরা তিন মহিলা বনজ শাক-সবজি
নিয়ে বিক্রি করতে বসলাম। পুলিশ বাধা দিল, বুঝিয়ে বললাম, আমরা মেয়ে মানুষ
এখানে না বসলে বাচ্চা-কাচ্চাদের কী খাওয়াব, কী করে বাঁচব যদি দু’পয়সা উপার্জন না করি ? দেখলাম সঠিক পথেই এগোচ্ছি, মহিলা হওয়ার কারণে পুলিশ বিশেষ কিছু বলল না।
সেদিন থেকে আমরা তিন মহিলা এই পথের ধারে দোকান নিয়ে বসি। পুরুষরা জঙ্গল থেকে
বস্তুগুলো সংগ্রহ করে এনে দেয়। পুলিশের লাঠির ভয়ে ওরা ঘরে থাকে, আমরা মহিলারা বেরিয়ে এসেছি।’
এই খাংকর এলাকায় সবিতা গড়ের সাথে বছর ৫০-এর অন্য একজন মহিলা গীতা দর্জি একটি
শিশুকে নিয়ে বসেছিলেন পথের ধারে। একইভাবে কৌশল্যা গোয়ালা নামের এক ৭০ বছরের বিধবা
বৃদ্ধাকেও বনজ শাক-সবজি নিয়ে বসতে দেখা গেছে এই স্থানে। পুত্র-পুত্রবধূ থাকা
সত্ত্বেও স্বাধীনভাবে একাকী জীবন-যাপন করা কৌশল্যা অন্যের ঘরের কাম-কাজ করে
দিনগুজরান করতেন। লকডাউনে তিনিও কাজ হারিয়ে বৃত্তি পরিবর্তন করে পথের ধারে কচু
ইত্যাদি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। পাশের পাহাড়ে বনজ শাক-সবজি সংগ্রহ করতে গিয়ে
বাঘের আক্রমণের ভয়ে বেশিক্ষণ পাহাড়ে থাকতে পারেন না। তবুও বাঁচার তাগিদে রাজপথে
সরলভাবে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছেন এই বৃদ্ধা। পুত্র ও পুত্রবধূর উপর নির্ভর না
করে সত্তর বছর বয়সী এই বৃদ্ধা কঠোর লকডাউনের সময় প্রশাসনের কঠোরতাকে প্রত্যাহ্বান
জানিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বহু পুরুষই লকডাউনের সময়ে পথের ধারে
দোকান নিয়ে বসতে না পারলেও কৌশল্যা, গীতা, সবিতাদের মতো
নারীরা পথ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
একইভাবে গুয়াহাটির বোন্দা এলাকায় বেশ ক’জন মহিলা পথের ধারে অব্যাহত রেখেছেন বিকিকিনি।
চন্দ্রপুর-নারেঙ্গি বাইপাস হাইওয়ের হাজংবোরি এলাকায় দেখা হয় ৫৫ বছর বয়সী মইনা
উপাধ্যায়ের সাথে – যিনি লকডাউনের
সময় পথের ধারে শাক-সবজির ছোটো পসরা নিয়ে বসেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘এই সবজির দোকানটা চালাতেন আমার স্বামী কালীনাথ
উপাধ্যায়। কিন্তু লকডাউন হয়ে যাওয়ায় দোকানটি কিছুদিন বন্ধ রাখতে হল। আমাদের
উপার্জনের বিকল্প না থাকায় একদিন স্বামী এসে দোকান খোলেন। প্রশাসন বাধা দেয়। তারপর
থেকে দোকানটিতে আমি বসতে শুরু করলাম। পুলিশ আমাকে বিশেষ কিছু বলেনি । তখন থেকেই দোকানটা
আমি চালিয়ে যাচ্ছি। স্বামীকে ঘরেই থাকতে হচ্ছে। কখনও বা পাহাড়ে গরু চরাতে যান,
এছাড়া আর কিছু কাজ নেই
তার। তিন কন্যা সহ আমাদের পাঁচ জনের সংসার এখন আমার উপরই নির্ভরশীল।’
উল্লেখ্য, জীবিকার ক্ষেত্রে
এই লকডাউন লিঙ্গভিত্তিকভাবে যে প্রভাব ফেলেছে তার উদাহরণ শুধু মইনা, ভানুমতী, গীতা, সবিতা, গোলাপীরাই নন,
কামরূপ জেলার বিভিন্ন
প্রান্তে এমন বহু নারীদের দেখা যায় রাজপথে বা অলি-গলিতে ঠেলা-রিকসা করে ফলমূল,
শাক-সবজি, মাছ ইত্যাদি বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়েছেন। একদল
তিনচাকার ঠেলায় পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করছেন আরেকদল ফুটপাথে নিয়ে বসেছেন ঘরে তৈরি
বিভিন্ন রকমের সামগ্রী। ইতিপূর্বে এই মহিলাদের গুয়াহাটির রাজপথে কোনোদিনই রিকসা বা
ঠেলা টেনে নিয়ে যেতে দেখা যায়নি। কিন্তু লকডাউনের প্রভাবে যখন বাড়ির পুরুষদের ঘরে
বসে পড়তে হয়েছে বা শ্রমজীবী মহিলারা নিজেরাই ‘নির্দিষ্ট কাজ’ হারিয়ে বসেছেন, তখন এমন মহিলারাই বাধ্য হয়েছেন ঠেলা-রিকসা নিয়ে
বা ফুটপাথে বসে ব্যবসা শুরু করতে। লকডাউনের দিনগুলোতে চানমারি-বামুনিমৈদাম রোডে এক
মহিলা ডাব-নারকেল কেটে কোনো অভিজাত মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন, এই ছবিও দেখা গেছে। এই দৃশ্যগুলো প্রমাণ করে যে
পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট বা সমাজে স্বীকৃত কিছু কিছু কাজ লকডাউনের প্রভাবে মহিলারা
চালিয়ে যাচ্ছেন, যা এক অনন্য
নিদর্শন। দেখা গেছে এই কাজে স্বনিয়োজিত হওয়া মহিলাদের পাশে পুরুষরা সততই
অনুপস্থিত। যেভাবে কামরূপ (মেট্রো) জেলার পথে ও অলি-গলিতে মহিলা ব্যবসায়ীদের
আধিপত্য দেখা যাচ্ছে তার বিপরীতে পুরুষদের পশ্চাৎপসরণ লক্ষ করা গেছে। একই সময়ে
এইভাবে পথে-ঘাটে খোলামেলা ব্যবসাতে স্বনিয়োজিত হওয়া মহিলাদের অধিকাংশই লকডাউনের
ঠিক আগে পর্যন্ত ঘরের চারদেয়ালের গণ্ডিবদ্ধ জীবনে আবদ্ধ ছিলেন। যাদের বেশি অংশই
নিজের ও অন্যের ঘরে ব্যস্ত ছিলেন মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট কাজগুলো নিয়ে। এমনকি
গুয়াহাটির চানমারি এলাকায় একাংশ মহিলারা পথের ধারে শাক-সবজির দোকান চালানোর
পাশাপাশি মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে মন খুলে গল্পগুজব করার দৃশ্যও দেখা গেছে। অর্থাৎ
এই মহিলারা পথের ব্যবসাতে সামিল হয়ে পরিবারকে আর্থিক সুরাহা দেওয়া ছাড়াও নিজেদের
মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্যও একটি পরিসর তৈরি করতে পারছেন। পুরুষরা
বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়ে থাকার মধ্য দিয়ে যেভাবে একটি আড্ডার পরিবেশ তৈরি করে নেন,
তার বিপরীতে নিম্ন আয়ের
শ্রমজীবী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ভাবের আদান-প্রদানের পরিসর প্রায় দেখাই যায় না।
কিন্তু কামরূপ (মেট্রো) জেলায় বিশেষভাবে এই ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা গেছে। অর্থাৎ
মহিলাদের জন্য তৈরি হচ্ছে অন্তরঙ্গ ভাব বিনিময়ের বিশেষ পরিসর। এটি লকডাউনের এক
অনন্য প্রভাব।
অন্যদিকে দিন কয়েক আগে বেলতলা অঞ্চলে একাংশ মহিলা পুলিশের সাথে খণ্ডযুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন। ঘটনার মূলে ছিল মহিলা বিক্রেতাদের শাক-সবজি ফেলে দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার পুলিশি হুমকি। কিন্তু সেই মহিলারা যুক্তিপূর্ণভাবে পুলিশ প্রশাসনের কাছে মানুষের জীবন-জীবিকার সুরক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। অর্থাৎ, এই লকডাউন একাংশ নিম্ন আয়ের নারীদের জীবিকার অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়েও সচেতন করে তুলেছে। আমাদের চালানো এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে কামরূপ (মেট্রো) জেলায় লকডাউনের সময় যদিও বহু নারী জীবিকা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন, তার বিপরীতে তারা ঘরের আর্থিক সংকট মোকাবেলা করার জন্য পথের ধারে, ফুটপাথে বা শহরের অলি-গলিতে ভ্রাম্যমাণ বা অস্থায়ী দোকান করে বসেছেন। সাথে সাথে পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যবসাগুলোতে মহিলারা হাত দিয়েছেন। পুরুষদের উপর প্রশাসনের অত্যাচারের জন্য মহিলারা সংসারের বোঝা মাথা পেতে নিচ্ছেন, যেখানে পুরুষরা পশ্চাৎপদ অবস্থান নিয়েছেন।
(মূল অসমিয়া থেকে ভাষান্তর : শহিদুল হক)
কোন মন্তব্য নেই