Header Ads

পূর্ণেন্দু শেখর ভট্টাচার্য্য - এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব

শিলচর থেকে লিখেছেন নীহারেন্দু ধর

 দিনটা ছিল ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি  মাসের ১৭ তারিখ, উপলক্ষ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পঞ্জীয়ক (Register) পূর্ণেন্দু শেখর ভট্টাচার্য্য (পি. এস. ভট্টাচার্য্য নামে বেশি পরিচিত ছিলেন) মহাশয়ের বিদায় সভা (ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান)। শিলচর পলিটেকনিক ক্যাম্পাসের একটি অব্যবহৃত ছাত্রাবাসে, যা ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িকভাবে প্রশাসনিক ভবন হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি মিলেছিল। ওই বিদায় সভায় ভট্টাচার্য্য মহাশয় একটি গান গেয়েছিলেন।


আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা...
আর কতকাল আমি রব দিশাহারা রব দিশাহারা।
জবাব কিছুই তার দিতে পারি নাই, শুধু পথ খুজে কেটে গেল
এ জীবন সারা এ জীবন সারা।

বয়স কম থাকায় সে সময় গানটার মধ্যে যে গভীর ব্যঞ্জনা ছিল তা উপলব্ধি করতে পারি নাই, আর তাই এও বুঝতে পারি নাই যে আপাতদৃষ্টিতে শক্ত ও কড়া মনোভাবের এই দক্ষ প্রশাসকের মনে গভীরে একজন ভাব প্রবণ ও সংবেদনশীল ব্যক্তিও বিরাজ করছেন। দিন যত এগিয়েছে, মানুষটাকে আরও ভালোভাবে চিনতে পেরেছি, তখন তাঁকে একজন স্নেহশীল অভিভাবক হিসাবে ভাবতেই বেশি ভালো লেগেছে।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে শ্রী পি. এস. ভট্টাচার্য্য প্রথম পঞ্জীয়ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি একজন Assam Civil Service (ACS) অফিসার ছিলেন। ডেপুটেশনে (deputation)এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে আসাম সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কার্যকাল ছিল মাত্র তিন বছর। কিন্তু, ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন এবং বিস্তার পরিলক্ষিত হয়েছিল। যারা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন, তারা নিশ্চয় জানেন যে এক অভৃতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চলা শুরু হয়। গৌহাটী বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করে জানিয়ে দিল যে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজগুলির পরীক্ষা ওরা আর নেবে না। ওই পরীক্ষাগুলি আসাম বিশ্ববিদ্যালয়কে নিতে হবে। সময়ের স্বল্পতা, পরিকাঠামোর অভাব এবং অন্যান্য নানা প্রতিকুলতা কাটিয়ে পরীক্ষা করানো রীতিমতো এক চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রয়োজন ছিল বলিষ্ঠ এবং সাহসী নেতৃত্বের, যা ওই সময় ভট্টাচার্য্য মহাশয় দিয়েছিলেন এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মানসিকতা তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন।
একটি নতুন প্রতিষ্ঠান শুরু করতে হয়  একেবারে শূন্য থেকে, তাই প্রশাসকের দায়িত্ব অনেক গুণ বেড়ে যায়। অভিজ্ঞ এবং পোড় খাওয়া ব্যুরোক্র্যাট (bureaucrat) ভট্টাচার্য্য মহাশয় দায়িত্ব নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে পালন করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ, পঠন-পাঠন এবং অন্যান্য ব্যবস্থা চালু করা সব কিছুতেই শ্রী ভট্টাচার্য্য স্বচ্ছতা ও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পর্যায়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং support service চালু করার জন্য প্রথম উপাচার্য শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্য্য North East Hill University (NEHU) থেকে পাঁচ- ছয়জন অফিসারকে নিয়ে এসেছিলেন, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল আসাম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আরও ১০ থেকে ১২ জন অফিসার। যারা প্রথম পঞ্জীয়কের অনুরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রয়াত রাধাপদ দত্তের নাম যিনি শ্রম দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। পঞ্জীয়ক ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের নির্দেশে আমিও আমার মতো যারা শিক্ষাকর্মী হিসাবে যোগদান করেছিলেন তাদের হাতে খড়ি প্রয়াত দত্ত মহাশয় ও অন্যান্য অফিসারদের কাছে হয়েছিল।

 পূর্ণেন্দু শেখর ভট্টাচার্য্য শুধু দাপুটে প্রশাসক ছিলেন তা নয়, তিনি একজন বড় মনের মানুষ ছিলেন। অধস্তন সহকর্মীদের সব সময় উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার বিশেষ ক্ষমতা ও আগ্রহ ছিল তাঁর। ব্যক্তিগতভাবে, আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন অভিভাবক, শিক্ষক এবং গুরু, তাঁর স্নেহস্পর্শ, ভালবাসা এবং আশীর্বাদ আমার সারাজীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে।
অবসর জীবনেও ভট্টাচার্য্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য চিন্তা করতেন এবং সময় সময় সদ পরামর্শও দিয়ে গেছেন। তাঁর প্রয়ানে (২২/০৮/২০২০) আসাম বিশ্ববিদ্যালয় তথা বরাক উপত্যকার এক অপুরণীয় ক্ষতি হল। ঈশ্বরের কাছে এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।

(লেখক শিলচরের  আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ পঞ্জীয়ক। মতামত নিজস্ব।)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.