কাল্পনিক ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার 'জিহাদ'কে ত্বরান্বিত করেছিল
- আজকের এই লেখাটি আমি অমূল্য বরুয়ার কবিসত্তার নামে উৎসর্গ করছি -
অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী
১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট। কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। 'স্টেটসম্যান পত্রিকা' যার নাম দিয়েছিল "গ্রেট ক্যালকাটা
কিলিং"। "গ্রেট" !!!! বৃহৎ অর্থে গ্রেট। 'মহান' অর্থে তো হতেই পারে না। যদিও যারা এই রাজনৈতিক
দাঙ্গার ষড়যন্ত্র করেছিলসেই মুসলিম লিগ আর মৌলবাদীদের কাছে এটা
"গ্রেট"ই ছিল। কেননাতারা ওটাকে "জিহাদ" বা তথাকথিত
"ধর্মযুদ্ধ" হিসেবেই ডাক দিয়েছিল, সেটাকে
"পবিত্র কর্তব্য" বলে এরা মনে করত। কুড়ি হাজারের ওপর মানুষ মারা গেছিল।
হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি জানিয়েছিলেন~এদের মধ্যে ৯০ শতাংশই নিরীহ ও নিরপরাধ।
২৯
জুলাই ১৯৪৬। মুম্বাইয়ে মুসলিম লিগের সভায় জিন্নার নেতৃত্বে একটি প্রস্তাব গ্রহণ
করে। সেটি হলো"এ বার আর শত্রুদের কোনও রেয়াত করা হবে না "। শত্রু কারা?! সরাসরি বলা হয়নি। কিন্তু ওই অন্ধ ধর্মীয় দর্শনের নিরিখে বোঝানো
হয়েছিল"বিধর্মী"রা। মুম্বাইয়ে তখন প্রবল বৃষ্টি। মুষলধারে। তা সত্ত্বেও
কাইজারবাগের সভায় লাখো মানুষ। উত্তেজনায় থরোথরো। জিন্না বলেছিলেন~"What we have done today is the most
historic act in our history"!
ওই
সভা থেকেই জিহাদ বা "Direct
Action" বা প্রত্যক্ষ
ধর্মযুদ্ধের ডাক দেয়া হয়। মুসলিম লিগের নেতারা এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায়
"ধর্মযুদ্ধ আসন্ন"এমন সব উত্তেজক বক্তৃতা করতে থাকেন। সমাগত এই
"যুদ্ধ" নিয়ে "দি মর্নিং
নিউজ", "দি স্টার অব ইন্ডিয়া" ইত্যাদিতে উত্তেজক
খবর বেরোতে থাকে। বিশেষ করে "আজাদ" বলে মৌলবাদীদের পত্রিকায়। (এই যে
কাশ্মীরের আজাদির ধারণাএটা কিন্তু নতুন নয়। ওই রসুনের কোয়ার মতোই, ওই নিজেদের কল্পিত ধর্মরাষ্ট্র স্থাপনের জন্য "আজাদি")।
কুখ্যাত মৌলবাদী হোসেন সুরাবর্দি তখন অবিভক্ত বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। মুসলিম
লিগ নেতা। এই লোকটির নেতৃত্বেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য কলকাতা গড়ের মাঠে সভা
ডাকা হয়। মুসলিম লিগের কলকাতা জেলা সমিতির নামে একটি আহ্বানপত্র প্রচার করা হয়েছিল
(সূত্র : Star of India, 13 Aug Issue, 1946)। প্রত্যেক মসজিদে তিনজন করে 'ইমানদার'কে নিযুক্ত করা
হয়, লোক সংগ্রহ করার জন্য। ১৬ আগস্ট ছিল জুমাবার।
তাই জুমার "বিশেষ প্রার্থনা"র আগেই এই কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো
হয়। ৮ নং জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের 'মুসলিম ভাই'দের উদ্দেশে বলা হয়~
"We are in midst of the rainy season and the month of Ramjan fasting.
But this is a month of real Jehad of God's grace and blessings. It is a supreme
occassion of our trial. Let Muslims brave the rains and all difficulties and
make the DIRECT ACTION DAY meeting a historic mass mobilization of the
Millat."
বাংলা ভাষায় "মুগুর" নামে একটি প্যামপ্লেট তখন প্রকাশ করা হয়।
যার ওপর তরোয়াল হাতে জিন্নার ছবি। ছবির নীচে লেখা~"ইসলামের তরবারি
স্বর্গকে উজ্জ্বল করে তুলেছে এবং সব খারাপ জিনিসকে অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে।"
সুরাবর্দির গ্রিন সিগনাল ছিল পুরো ব্যাপারটায়। প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটির ঘন
ঘন মিটিং। "মুসলিম লিগ সমর্থক গুন্ডাদের ব্যবহার করার জন্য পর্যাপ্ত
যানবাহনের ব্যবস্থা করা হল। ...বিশেষ কুপনের মাধ্যমে পেট্রোল সমস্যার সমাধান করা
হল প্রশাসনিক সহায়তায়।" (ইস!পিশি থাকলে আয়োজনে নির্ঘাৎ "ডিম্ভাত"ও
থাকত। শরীরে বল থাকলে ধর্মযুদ্ধে হত্যা সহজ হবে!)ড. শ্যামাপ্রসাদ দাঙ্গার পর
বিধানসভায় "The great
Calcutta Killing--Who is responsible?" নামে একটি অবিস্মরণীয় বক্তৃতা করেন। এর পূর্ণ
বাংলা পাঠ আমাদের হাতে আছে। সেখানে শ্যামাপ্রসাদ তথ্য দিয়ে জানিয়েছিলেন~
"স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর(অর্থাৎ সুরাবর্দির) নামেই ১০০ গ্যালন পেট্রোলের
কুপন দেওয়া হয়। প্রামাণ্য সাক্ষ্য আছে যার দ্বারা প্রমাণিত হবে যে, এইসব কুপনের দ্বারাই লরিওয়ালা পেট্রোল সংগ্রগ করে এবং ওই লরির সবগুলিই ওই
ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে কলিকাতার পথে পথে ভ্রাম্যমান ছিল।"
ড.
শ্যামাপ্রসাদ বিধানসভায় আরও জানিয়েছিলেন~দাঙ্গার দুদিন পর
পার্ক স্ট্রিট থানার ইউরোপীয়ান পুলিশ ইন্সপেক্টর সাতজন গুন্ডাকে ধরে নিয়ে আসেন।
এবং দশ মিনিটের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দি স্বয়ং ওই পার্ক স্ট্রিট থানায় আসেন ও
গুন্ডাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান। পার্ক স্ট্রিট থানায় নথিভুক্ত ছিল এই ঘটনা। একজন
মুখ্যমন্ত্রী দাঙ্গাবাজদের ছাড়াতে থানায় গেছেন!! ভাবা যায়?!
শ্যামাপ্রসাদের এই তথ্য শুনে সুরাবর্দি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। শ্যামাপ্রসাদকে
বলেন~"আমি দুঃখিত, কিন্তু আমি বলতে
বাধ্য হচ্ছি যে, আপনিও একজন গুন্ডা।...কোনো মুসলিম ভদ্রলোককে
গুন্ডা বলে অভিহিত করাকে আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি।"
ড.
শ্যামাপ্রসাদ বলেন"...ধৃত ব্যক্তিদের কাছে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি পাওয়া গিয়েছিল।
যদি জনাব সুরাবর্দির বক্তব্য এই এই হয় যে মুসলিম ভদ্রলোকেরা লুণ্ঠিত জিনিসপত্র
নিয়ে যাচ্ছিল তবে অবনত মস্তকে সেই বক্তব্য আমি মেনে নেব। কিন্তু তিনি যদি বলেন যে, আমি গুন্ডা তবে আমি বলবশুধু এই প্রদেশে নয়, এই পৃথিবীর মধ্যে
সর্বোত্তম গুন্ডা হচ্ছেন তিনিই।"
সুরাবর্দি মহা ধূর্ত। ওই 'জিহাদ'কে শুধু
মুসলমানের সভা না-দেখানোর জন্য "represntatives of minority supressed and oppressed people and
anti-Fascist partis"কেও আমন্ত্রণ
জানানো হয়েছিল।
দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। তিনি লিখেছেন~ "মুসলিম লিগ বেশ কয়েকটি মিছিল বের করেছিল এবং এই
মিছিল থেকেই লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ আরম্ভ হয়।" মিছিলগুলো কেমন ছিল?! আনন্দবাজার-এর সাংবাদিক প্রত্যক্ষদর্শী শংকর ঘোষ লিখেছেন~ "...মাঝরাতে মসজিদটি যেন হঠাৎ জেগে উঠেছে। মসজিদের
সামনে একটি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকভর্তি মানুষ। তাদের সকলেই প্রায় সশস্ত্র।
হাতে সড়কি, নিদেন পক্ষে লাঠি। গোটা ট্রাকটাই মুসলিম লিগের
পতাকায় সজ্জিত। ট্রাক থেকে মাঝে মাঝেই 'পাকিস্তান
জিন্দাবাদ', 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' শ্লোগান দেওয়া হচ্ছিল। দৃশ্যটা অনেকটা মহরমের তাজিয়া মিছিলের মতো।"(সূত্র
: "হস্তান্তর", শংকর ঘোষ, আনন্দ
পাবলিশার্স)
ডা.
বিধান রায়ের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল লিগ সমর্থকরা। কং নেতা কিরণশংকর রায়ের
ছেলেকে ছুরি মেরেছিল। আনন্দবাজার,
হিন্দুস্তান
স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদি পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে দেবার চেষ্টাও হয়।
•••
অসমের
তরুণ প্রতিভাবান অমূল্য বরুয়া (১৯২২-৪৬)তখন কলকাতায় এমএ পড়তে গেছিলেন। 'বেশ্যা', 'বিপ্লবী', 'কুকুর' ইত্যাদি কবিতা লিখে তিনি আধুনিক অসমিয়া কবিতায় হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। কলকাতায়
থাকতেন রাজা রামনারায়ণ স্ট্রিটের মেসবাড়িতে। "ধর্মযোদ্ধা"রা তাঁকে ও
তাঁর সহপাঠীদের সকলকেই ওই বাড়িতে নির্মমভাবে কেটে রেখে কাল্পনিক ধর্মরাষ্ট্র
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার 'জিহাদ'কে ত্বরান্বিত
করেছিল।
•••
লেখক -
কটন বিশ্ববিদ্যালয়, গুয়াহাটি
কটন বিশ্ববিদ্যালয়, গুয়াহাটি
১৬-৮-১৯
•••
ঋণ। তথ্যসূত্র :
"কলকাতা ও নোয়াখালি দাঙ্গা"
সংকলন সম্পাদনা : অর্জুন গোস্বামী। গাঙচিল।
২০১৬।
কোন মন্তব্য নেই