কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শুনাই শোন
দীপক লোধ, আগরতলা
না,... রূপকথা নয় মোটেই। রক্তমাংসের মানুষের কথাই
বলব। কোনও এক গ্রামের নয়, ত্রিপুরা রাজ্যের
গান্ধীগ্রামের ........সংঘমিত্রা। গ্রামের বধূ। না- না, বলব তাকে ‘তারকা বধূ’। বলল ‘আমার আদুরে নাম রুমা’। বয়স তখন ১৫।
তখন নবম শ্রেণির পড়ুয়া। কৈশর। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তখনই বসে পড়তে হল বিয়ের আসরে।
তারিখটি ছিল ১০ অক্টোবর, ২০১৬। স্বামী
কেন্দ্রিয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনীর জোয়ান। রাজু ঘোষ। এলাকারই স্কুল টিলার বাসিন্দা
শংকর ঘোষ ও অমিতা ঘোষের ছেলে। সুদর্শন রাজুও মাত্র মহাবিদ্যালয়ে পা রেখেছে। তখনই
জুটে যায় চাকুরী। আর সেবছরই বিয়ে। বিয়েতে খুবই আপত্তি ছিল রুমার। কিন্তু সমাজে আজও
বাবা মায়েরা ভাবেন কন্যা সন্তান মানে বোঝা। দায়। তাই কন্যাকে তাড়াতাড়ি পাত্রস্থ
করা গেলেই বুঝি তিনি দায়মুক্ত! যথারীতি নিন্দনীয় সামাজিক পরম্পরার শিকার
সংঘমিত্রাও। বাবা সাধন দেব। মা মীরা দেবী। ক্ষুদ্র পান চাষীর পরিবার। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই গান্ধী
গ্রামের ব্রাহ্মন টিলার মায়ের আঁচল ছেড়ে পা রেখেছিল শ্বশুড় বাড়িতে। ‘শুধু বিয়ের সামান্য কয়েকটা দিন। আর এইটুকুনও
স্কুল কামাই করিনি। বিয়ের পর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অনেকের আপত্তি ছিল। তবে
শ্বশুড় ও শাশুড়ি মায়েরা কোনও আপত্তি করেননি। সবচেয়ে উৎসাহী ছিলেন স্বামী। কাছে
দূরের কিছু আত্মীয় পরিজন ও গ্রামের অনেকে বিয়ের পর স্কুলে যাওয়াটাকে তেমন ভালো
চোখে দেখেননি।তাদের অনেকের বক্তব্য ছিল স্বামী চাকুরি পেয়েছে। বৌ পড়াশোনায় ভালো
হলেওবা কি? গ্রামের একই
পরিবারের স্বামী স্ত্রী দুই জনের তো আর চাকুরী মিলবেনা! নিয়িমিত এমনই নানান কথা
সেদিন কানে আসত। হ্যাঁ, স্বশুড় শাশুরী মা
আমার প্রতি খুব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে লাগলেন। তবে সবচেয়ে সার্পোটিভ ছিল আমার
স্বামীই। হ্যাঁ, আজও সে তাই ই
চায়। বলল আমাকে সে নিয়মিত উৎসাহ দেয় যতদূর ইচ্ছে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। আমাকে ভীষণ
ভীষণ অনুপ্রানিত করে। বলল আমি চাইব সমাজের সব স্বামীরাই যেন তাদের স্ত্রীর প্রতি
এভাবেই বিভিন্ন কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
....আমার এক ভাইও রয়েছে। সেও
ভালো ফলাফল করেছে দ্বাদশে। ভাইও বরাবরই পড়াশোনায় খুবই আগ্রহী ছিল। গান্ধীগ্রাম
উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ভাই সিদ্ধার্থও এই বছর বিজ্ঞান বিভাগে মাত্র ৮
নম্বরের জন্য (৪৪৩) বিজ্ঞান বিভাগের মেধা তালিকায় উঠে আসতে পারেনি। ভাই আমার এক
বছরেরর ছোট। ছোট বেলায় আমার পিছু পিছু সেও ছুটে আসত স্কুলে। যদিও তখন তার ভর্তির
বয়স হয়নি। তাই ভাইয়ের নাম ছিলনা স্কুলের হাজিরা খাতায়। কিন্তু সেও রোজই আমার সঙ্গে
স্কুলে যাতায়ত করত। পড়াশোনায় ভালো বলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষা সেবার দ্বিতীয়
শ্রেণিতেই হাজিরা খাতায় ভাইয়ের নাম নথিভূক্ত করেন। ভাই এর ইচ্ছে ভবিষ্যতে চিকিৎসক
হবার। সে লক্ষ্যেই ভাইটি ২০২০-র মেডিকেলের সর্বভারতীয় ভর্তি পরীক্ষায় বসার
প্রস্তুতি নিচ্ছে।
…মাধ্যমিকের গন্ডি পার হবার আগেও একবার একটি বড় পরীক্ষার সন্মুখীন হয়েছিলাম।
মাধ্যমিক পরিক্ষায় যখন বসি তখন আমি দেড় বছরের অংকুশের মা। 'অন্কুশ' আমাদের নতুন স্বপ্ন৷ পরীক্ষার আগে প্রস্তুতির
স্বার্থে রোজই এক ঘন্টার পথ পারি দিতে হতো। প্রতিদিন ছুটে যেতাম আগরতলা শহরে। গৃহ শিক্ষকের বাড়িতে
পাঠ নেবার প্রয়োজনে। বাড়ির লোকজন সেদিন আমাকে খুব সহযোগিতা করেছেন। প্রসূতিকালীন
সময় কাল ও সদ্য মা হওয়া পরবর্তী কিছু জটিলতার জন্য মাধ্যমিকের ফল আশানুরূপ হয়নি।
দুই বিষয়ে লেটার মার্কস্ সহ মাধ্যমিকে আমার মোট নম্বর ছিল ৩৮৪( ৭৬.৮%)।,স্কুলের একাদশ শ্রেণির পরিক্ষায় প্রথম হয়ে আমার
মনোবল তথা আত্মবিশ্বাস যেন বহুগুন বেড়ে যায়। পড়াশোনার কোনও বাধা ধরা সময় বা রুটিন
ছিলনা আমার। সময় পেলেই পড়তে বসতাম। বাড়ির যেকোন জায়গাতেই বসে পড়তাম।বাড়ির উঠান
কিংবা ঘরের পিছনের গাছতলা- যেকোনও জায়গাতে বসেই পড়ার অভ্যেস রয়েছে আমার! রোজ ২-৮
ঘন্টা পড়েছি। তবে এই সময় বলতে চাইব পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য সবার প্রয়োজন পাঠ্য
বই খুঁটিয়ে পড়া। শুধু নোট বই নয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত গৃহ শিক্ষক নির্ভরতাও নয়।
নিজেই পড়তে হবে বেশি বেশি। তবেই ভালো ফলাফল সম্ভব বলে আমি মনে করি৷
ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মেধা
তালিকায় নাম উঠবে এই স্বপ্ন কোনও দিন দেখেনি। কিন্তু ভেবেছিলাম ফল ভালো হবে'। দ্বাদশের টেস্টের নম্বর ছিল ৪৪৯। চুড়ান্ত
পরিক্ষায় ৪৬৩ নম্বর পেয়ে পর্ষদের মেধাতালিকায় সপ্তম স্থানে নাম তুলতে সমর্থ হয়
পাড়া গাঁয়ের এই ব্যাতিক্রমী গৃহবধূ। বিষয় ভিত্তিক প্রাপ্ত নম্বর বাংলায়-৯০, ইংরেজিতে-৯০ ইতিহাসে-৯১ শিক্ষা বিজ্ঞানে-৯৬ এবং
ভূগোলে-৯৬। জানাল ইংরেজি নিয়ে সান্মানিক স্নাতক কোর্সে আগরতলার মহিলা মহাবিদ্যালয়ে
ভর্তি হতে ইচ্ছুক। মেধাবী সংঘমিত্রা জানাল ভবিষ্যতে সে কলেজ শিক্ষকতার কাজেই আসতে
চায়। গান্ধীগ্রামের এই স্কুল থেকে সংঘমিত্রাই প্রথম মেধা তালিকায় নাম তুলতে সমর্থ
হয়। আর তাতেও যারপরনাই খুশি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা থেকে গ্রামের মানুষের
মানুষ।গর্বিত সংঘমিত্রার নিজের বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্ট্যাট্ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার গান্ধীগ্রাম
শাখাও। তারা সম্বর্ধনা জানিয়েছেন সংঘমিত্রাকে৷
তুমি একজন গ্রাম্য গৃহবধূ। বলা যায়
নাবালিকা কন্যা সন্তান হয়েও বসেছিলে বিয়ের পিঁড়িতে। সেটা নাকি পারিবারিক চাপেই।
মানে নিজের আপত্তিতে! তো সমাজে নারীদের প্রকৃত অবস্থান নিয়ে তোমার কাছ থেকে যদি
কিছু জানতে চাওয়া হয়? বলল- ‘সামগ্রিকভাবে লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকা ও
পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের সমাজে নারীর এগিয়ে চলা তথা অগ্রগতির প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলে তো লাভ নেই। আজও সমাজের সিংহভাগ নারীদের তো
তা নেই। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তথা স্বনির্ভরতা নেই বলেই
সমাজে প্রতিদিন নারী নির্যাতন বধূহত্যার ঘটনা শোনা যায়’। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী জেদি অথচ নম্র স্বভাবের
গৃহবধূ সংঘমিত্রা যেতে যেতে শুনিয়ে গেল অসাধারণ একটি কথা। ‘আমি মোটেই কুসংস্কারে বিশ্বাস করিনা। আজও
জগদ্দল পাথরের মতোই সমাজের কোনে কোনে বাসা বেঁধে থাকা যেকোন সামাজিক কুসংস্কারকে
আমি মনে প্রানে ঘৃনা করি। আমি রক্তমাংসের দুর্গাকে বিশ্বাস করি’। তার ফলাফলের পিছনে কার অবদান বেশি বলতেই বলল
আমার স্বামীর অনুপ্রেরণা সব চেয়ে বেশি। তবে অবশ্যই মা বাবা বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক
শিক্ষিকা আমার শ্বশুড় শাশুড়ি সকলেই আমাকে ভীষণ সহযোগিতা করেছেন। বলল বিদ্যালয় থেকে
বিয়ের পর থেকেই বিশেষ সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষত যখন সন্তান সম্ভবা ছিলাম কিংবা মা
হবার পরও আমি প্রতিদিন স্কুলে যেতাম না। খুবই কম যেতাম। তারা সকলেই কিন্তু তখন
আমাকে দারুন ভাবে সহযোগিতা করেছেন। হ্যাঁ, আবারও বলব আমার স্বামীর কথা। 'স্বামী বছর দেড়েক হল আগরতলার রাজভবন থেকে বদলি
হয়ে কাশ্মীরে রয়েছে। লাডাকের কাছাকাছি কাশ্মীরের কলগাঁও জেলার বজুরে ২৪ নম্বর
সিআরপিএফ ব্যাটালিয়ানে। সাম্প্রতিক লাডাক সীমান্তের উত্তেজনা পূর্ণ পরিস্থিতিতে
ওকে নিয়ে তো কিছুটা দূর্ভাবনা রয়েছেই। তবু দেশের কথাও তো ভাবতে হবে। আবার এটাও তো
ঠিক যে, ওর রোজগারেই তো
আমাদের খাওয়া পড়া। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণের সব কিছুও। শুভকামনা রাখবেন ওর জন্য।
আমাদের দু’জনের পরম আদরের
অংকুশের জন্যেও। যেতে যেতে বলল আমার কৃতজ্ঞতা জানাবেন দুর্গা চৌধুরী পাড়া হেমন্ত
স্মৃতি বিদ্যালয়ের ইংরাজি শিক্ষিকা শ্রীমতি ইন্দ্রানী ভট্টাচার্যী মহোদয়াকে। যিনি
আমাকে পরবর্তী উচ্চ শিক্ষার পঠন পাঠনে সর্বতো ভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
হ্যাঁ, ইন্দ্রানীই সেদিন
সংঘমিত্রার কথাটা বলেছিল আমাকে। পরদিন সকাল তখন আটটা। সুদীর্ঘ কথা হল বার কয়েকই৷
মোবাইলে কথা বলতে বলতে বুঝতে পেরেছিলাম সত্যিই যে অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও সঠিক নিশানা
থাকলে মেয়েরাও অবলীলায় সাফল্য পেতে পারে। এমনকী কি এক লাজুকলতা গ্রামের বধূ,
এক সন্তানের জননী৷ এমনই
সংঘমিত্রারাও। দেখাল কিভাবে প্রবল
আত্মবিশ্বাসে একজন নারীও পৌঁছে যেতে পারে সফলতার মক ডালে। রাজ্য পর্ষদের দ্বাদশের
২০২০ এর মেধা তালিকায় চোখ রাখলেও বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। মেধার দৌড়ে এবার
মেয়েদেরই তো জয়জয়কার। যে জয়ের পরিসংখ্যানে সংঘমিত্রা এক উজ্জ্বল ব্যাতিক্রমী
নারী।মেধাবী মেয়ে। এক মা৷
সাবাস সংঘমিত্রা৷ তোমাকে অভিনন্দন৷
কোন মন্তব্য নেই