Header Ads

অমরেশ দত্ত স্মরণে


মনোজমোহন চক্রবর্তী

প্রায় একশ' দুই বৎসর বয়েসে আমাদের শিক্ষাগুরু অমরেশ দত্ত প্রয়াণ করলেন । অসম সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করলো । রাজ্য জুড়ে সকলেই শোকার্ত । একজন শিক্ষক যে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এত মানুষের মন জুড়ে বসে থাকতে পারেন, এ একটি অভূতপূর্ব ঘটনা । আর কোন শিক্ষক এত সম্মান পেয়েছেন বলে আমি জানি না ।
অমরেশ দত্ত অতুলনীয় স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন । আমাকে একবার বলেছিলেন, জানো, আমার রোগটোগ হয় না । রাত ঠিক বারোটায়  বালিশে মাথা রাখি, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি । ঠিক ছ'টায় ঘুম ভাঙে । সারাদিন কাজ করি । ক্লান্ত হই না কখনও ।
             তিনি আমার পিতৃসম ছিলেন । আমার যেন মহাগুরুনিপাত হ'ল । এই বয়সে কোন ব্যাকুল করা শোক অনুভব করলাম না,  কেবল মনের কোন একটা জায়গা যেন হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল, কেবল একটা কথা বারবার ঘুরতে লাগলো মনে, তিনি নেই । তিনি নেই । তাঁর পায়ে প্রণাম করলে তাঁর সস্নেহ কল্যাণ হস্তটি আর স্পর্শ  করবে না আমার মস্তক, তাঁর স্মিত হাসি মুখটি আর দেখতে পাবো না ।
     তাঁর কথা আমি বিশেষ জানি না কারণ তিনি নিজের কথা বলেন নি কোন দিন; আমারও মনে হয়নি জিগ্যেস করে করে জেনে নিই।  অথচ জেনে নেয়াটা জরুরী ছিল । আমার বাবার সঙ্গে পরিচয় ছিল, পত্রালাপ ছিল । সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলে তাঁর স্ত্রীকে কাকিমা ডাকতাম । আমার বাবাকে জিগ্যেস করলেও তাঁর সম্পর্কে জানা যেত । ভাবিনি কোন দিন যে জিগ্যেস করি । 
অবশ্য  তাঁর জীবন-বৃত্তান্ত না জানলেও চিনেছি তাঁকে ।  বিদ্যোৎসাহী, পরিশ্রমী গবেষক সুশান্ত করের অনুরোধ ঠেলতে না পেরে সেই চিনতে পারার কথাটাই লিখছি ।
তাঁর জন্ম করিমগঞ্জের ঈশ্বরশ্রীর সেই বাড়িতে যে বাড়ির মানুষ ছিলেন ICS ও ব্রতচারীর প্রবর্তক গুরুসদয় দত্ত । বোধ হয় ১৯১৮ সালে ।  আমার মাস্টারমশায়ের পড়াশোনা কোথায় সম্পন্ন হয়েছিল জানি না । ১৯৫০ সালে তিনি মধ্যপ্রদেশের সগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক নিযুক্ত হন । উনিশ শ' ষাট অবধি সেখানেই ছিলেন । উনিশ শ' ষাট সালের শেষে আসেন গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে । তখন তিনি নাম করা ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক  । কবিও । তাঁর ইংরেজি কবিতার বই  Captive Moments প্ৰকাশিত হয়েছে, পেয়েছে   পুরস্কার । একটি আন্তর্জাতিক প্যানেল হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে । এই প্যানেলে ছিলেন  ইয়েল, হার্ভার্ড, উপসালা প্রভৃতি  বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপকরা । তাঁরা তাঁদের  রিপোর্টে স্যার সম্পর্কে বলেছিলেন :  He is one of the finest teachers of English literature ......as good as the best in our Universities.  সম্ভবত এই সময়েই বেরোয় তাঁর  Shakespeare's Tragic Vision and Art. বইটি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন  উইলসন নাইট, টিলিয়ার্ডের মত বিশেষজ্ঞরা ।
   আমার মাস্টারমশাই বেশি বই লেখেননি । লিখে থাকলেও আমার জানা নেই । শেক্সপিয়ারের কমেডি নিয়ে পরে একটি বই লিখেছিলেন ।  বইটিতে পাঁচটি প্ৰবন্ধ । যখন লিখছিলেন তখন আমাকে পড়তে দিতেন । আমি তিনটি নিবন্ধ পড়েছিলাম । বাকি দুটো যখন লিখেছেন তখন তিনি ডিব্রুগড় চলে গিয়েছেন । ম্যাকমিলান বইটি  প্রকাশ করেছিল ।  নাম  Comedy : A Rhetorical Fiction. টিভিতে যখন মহাভারত সিরিয়ালটা চলছিল, তখন স্যারের আবার মহাভারত পড়ার ইচ্ছে হ'ল । সেসময় প্রতিদিন আমাদের ডেকে পাঠাতেন, বিশেষ করে সাতকড়ি মুখোপাধ্যায় ও সুধা গোপালকৃষ্ণনকে । এঁরা দু'জন সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ । আমার এই প্রণম্য সাতকড়িদাদাটি যে সে লোক ছিলেন না । আঠেরোটি ভাষা জানতেন । একসময় বারানসির চৌখাম্বা সংস্কৃত সিরিজের চিফ এডিটর ছিলেন । এর পরে তিনি রামায়ণ গবেষণায় উপদেষ্টা হয়ে কিছুকাল কাজ করার পর  Indira Gandhi Centre for the Arts Manuscript Consultant হয়ে  চলে যান । এ কাজে তাঁর চেয়ে যোগ্য লোক কেউ ছিল বলে জানি না । তিনি ছিলেন সত্য অর্থে চলন্ত বিশ্বকোষ । স্যারকে তিনি অপরিসীম শ্রদ্ধা করতেন । সুধা ছিল নামবুদ্রিপাদের নাতনী । যেমন ইংরেজি সাহিত্য, তেমনি তার স্বচ্ছন্দ চলাচল সংস্কৃত ও মালায়ালাম সাহিত্যে । সে তখন কুটিয়াট্টাম  নৃত্যের "নলদময়ন্তী"  অনুবাদ করছে । তো স্যার অনেকক্ষণ মহাভারতের একেকটা দিক আলোচনা করতেন । আলোচনার শেষে একটু লজ্জিত মুখে বলতেন, আমি একটা কবিতা লিখেছি । শোনো । এভাবে যেদিন লিখতেন তার পরদিনই শোনাতেন । তিনি সরস্বতীর বরপুত্র ছিলেন । আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম । মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনা নিয়ে কবিতাগুলো । পরে বোধ হয় Seagull এই কবিতাগুলো প্রকাশ করে Time's Harvest নামে । তারও পরে স্যার একটি ইংরেজি কাব্য-নাটক লিখেছিলেন । ওটা ট্রিলজি । নাম Lotus and the Cross.  আমার সেটি পড়া হয়নি ।  বাংলায় একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন নাম ছিল "বানপ্রস্থ" । একটি বৃদ্ধাবাসের কাহিনি
এবার তাঁকে যেমন চিনেছিলাম, সেইটে বলি ।
          আমি তাঁকে প্রথম দেখি যখন তিনি আমার কলেজে এসেছিলেন কোন কাজে । তাঁর সঙ্গে আমাদের ইংরেজির ছাত্রদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল । লম্বা গড়ন, শ্যামবর্ণ, স্বাস্থ্যে সৌন্দর্য ব্যক্তিত্বে দশের মধ্যে তাঁর উপরই প্রথম চোখটা পড়ে ।
তারপর আমাদের কলেজের কয়জন গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম । স্যারের প্রথম ক্লাসে একেবারে বিমোহিত হলাম । চসারের Canterbury Tales এর Prologue পড়াবেন প্রথম, তারপর Nunnes Priestes Tale. প্রথমে আবহ তৈরি করলেন । নানা জীবিকা, নানা স্তর, নানা জায়গা থেকে একদল লোক ট্যাবার্ড পান্থশালায়  এসে পৌঁছেছে । । তারা  যাবে ক্যান্টারবেরিতে তীর্থ করতে । এদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত লোক যেমন আছে তেমনি আছে অভব্য লোক । । এরা হৈ হৈ করতে করতে যাবে পথ বেয়ে ।   আমরা যেন সেই ছবি দেখতে পেলুম, স্যার যেন আমাদের নিয়ে ট্যাবার্ড ইনে উঠেছেন    ঊনত্রিশ জন লোক । চসার বলছেন, যাবো তো এদেরই সঙ্গে ! তো এক এক করে জেনে নিই এদের ! স্যার তখন  স্বয়ং চসার ।  তাঁর কথা শুনেই যেন  আমরা এই তীর্থযাত্রী  একেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছি । ওই তো নাইট, পোড় খাওয়া, ভালমানুষ চেহারাটি একটু বিষণ্ণতায় ভার । ঐ তার ছেলে । গায়ের জামাখানা দেখো, যেন উজ্জ্বল রোদ পড়েছে মাঠে তাতে নানার রঙের ফুল ফুটেছে । কোঁকড়ানো চুলে কপাল ঢাকা । ছোঁড়ার বয়স কুড়ি, প্রেমে পড়েছে । রাত্তিরে ঘুমোয় না, পাপিয়া পাখির মত রাত জেগে গান গায়, বাঁশি বজায়, কবিতা  লেখে ।  আর ঐ যে সন্ন্যাসিনী, - বেশ সাদাসিধে, ধীর, স্থির, মুখে স্মিত হাসি । স্যুপ খাচ্ছেন আর কী আলতো করে বারবার ঠোঁট মুছে নিচ্ছেন ! তারপর স্যারের মুখে দুষ্টু  হাসির ঝিলিক । বললেন, গলার লকেটটাই তো দেখলে না সন্ন্যাসিনীর ! আমরা যেন লকেটটা হাতে নিয়ে দেখলুম । ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে  তাতে লেখা : Amour vincit omnia. আমরা হোহো করে হেসে উঠলুম । ঐ দেখো, ওয়াইফ অফ বাথ । "Gath-toothed was she" -   সামনের দাঁত দুটোর মাঝখানে একটুখানি  ফাঁক । এরকম মহিলা  একটুখানি পুরুষ-ঘেঁষা হন  Husbands at Church door hath she five.
ঐ যে ভদ্রলোককে  দেখছো ছুটোছুটি করছেন ব্যস্ত হয়ে, বিশৃঙ্খল লোকগুলোকে একটি শৃঙ্খলায় আনার চেষ্টা করবেন , উনি হলেন  host. তিনি এদের দিয়ে গল্প বলাবেন ।    সঞ্চালকের ভূমিকায় আমরা তাকে দেখবো, সহনশীল, উদার কিন্তু কঠোর ।
   এরকমই পড়াতেন স্যার । গল্প গাঁথার গল্প : বিষ্ণু শর্মার পঞ্চতন্ত্র, বকাচ্চোর ডেকামেরণ । চসার কী চোখে দেখছেন এদের ?  ভাল  খারাপ বিচার নেই তাঁর । ঈশ্বর যেমন বিচার করেন না । এককোষী থেকে বহুকোষী - অপার স্নেহে, অপার যত্নে সৃষ্টি করেন তিনি । তেমনি চসার । জগতের আনন্দযজ্ঞের বিচারক নন, দর্শক । তাঁর মুখে হাসি , মনে কৌতুক ।
            Paradise Lost পড়াবার প্রারম্ভের দিকে  স্যারের সেই মৃদু হাসিটা মনে পড়ে এখনও । Of man's first disobedience I sing - সে ঠিক আছে কিন্তু কবির গগণছোঁয়া স্পর্ধাটা দেখো ! তাঁর এই মহাকাব্য লেখার উদ্দেশ্যটা কী ? To justify the ways of God to man ! ...পড়াতে পড়াতে থামলেন সেইখানটায় যেখানে Satan প্যারাডাইসের দোরগোড়ায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে, হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে না, অপলকে দেখছে । স্যাটানের চোখ দিয়ে কবি দেখছেন মানুষের প্রথম বাসভূমি । বললেন এটা হল distancing.
    স্যার যখন যুবক,  সগর বিশ্ববিদ্যালয়ের টগবগে এক অধ্যাপক সে সময়ের  কথা স্যার নিজে কখনও আমায়  বলেননি । ।  বলেছিলেন সত্যদেও দুবে । সত্যদেও ছিলেন ইংরেজির ছাত্র । রাজনীষ (পরে Osho নামে পরিচিত), সত্যদেওদের একটা স্টাডি  গ্রুপ ছিল । ওশো ছিলেন দর্শনের ছাত্র । আমাদেরই ঐদিককার এক ডাকসাইটে দার্শনিক ছিলেন বিভাগীয় প্রধান । নামটা ভুলেছি । ওশো তাঁর ছাত্র ।  স্যার ছিলেন সেই স্টাডি গ্রুপের  উপদেষ্টা । সত্যদেও আমাকে বলেছেন, কী ধৈর্য নিয়ে স্যার এদের সঙ্গে বসতেন । কতদিন রাত দুপুরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হামলা করেছেন । কী ? না, ওশোর মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে তার ফয়সালা তক্ষুনি দরকার । সকাল  অব্দি অপেক্ষা করা যাবে  না। কাকিমা দিতেন চা করে । তর্কে বিতর্কে রাত শেষ হয়ে যেত ।
    বোম্বেতে আব্রাহাম আলকাজির   একটি থিয়েটার গ্রুপ ছিল । নাম থিয়েটার ইউনিট । আলকাজি চলে গেলেন দিল্লি স্কুল অফ ড্রামার অধ্যক্ষ হয়ে । সত্যদেও হলেন সেই থিয়েটার ইউনিটের কর্ণধার । তাঁর অনেক বিখ্যাত কাজ ।এখানে বলবার অবকাশ নেই । শ্যাম বেনেগালের জন্যে স্ক্রীণশট লিখেছেন, বাদল সরকার, গিরিশ কন্নড়, উৎপল দত্ত এবং আর  সব বড় নাট্যকারের মারাঠি অনুবাদ করে নাটক করেছেন । তাঁর কাজের কোন শেষ নেই । পুরস্কার ও মিলেছে অনেক ।  2011 সালে তিনি গত হন । তাঁর চাণক্য বিষ্ণুগুপ্ত এককালে সাড়া ফেলেছিল । শেক্সপিয়ার,  ভাস থেকে অনর্গল বলতে পারতেন ।
স্যারকে সমীহ করতো সকলে । সাহিত্যের রথী মহারথীদের দেখেছি তাঁর সঙ্গে সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বলতে । একবার কেবল  উর্দু-সাহিত্যের এক নামকরা  বিশেষজ্ঞ তাঁর সামনে উদ্ধত ভাবে কথা বলেছিল ।  সরল, মিষ্টভাষী মানুষ । তিনি কোনদিন এমন ব্যবহার পাননি কারও কাছে । এমন মানুষ জানেনই না কী ভাবে এর জবাব দিতে হয় ! তিনি সহ্য করেছিলেন । ঘটনাটি  ঘটেছিল যখন দু'জন ছিলাম সামনে । স্যারের থেকে বছর পাঁচেকের ছোট পরম অভিচন্দানি, সিন্ধি সাহিত্যের এটি মান্য  বিশেষজ্ঞ , আমার পরমাত্মীয়ের মত ।  আমরা স্যারের সামনে মাথা নিচু করে ছিলাম । তারপর পরম আমাকে বললেন , এর বদলা নিতে হবেনিয়েছিলাম ।  সেই অহংকারী, ঈর্ষাপরায়ণ ভদ্রলোককে  এমন শিক্ষা দিয়েছিলাম, স্যার থাকাকালে আর সে একাডেমিমুখো হয়নি । নামটা বলছি না । 
    স্যার ছাত্রমহলে ও সহকর্মীমহলে এতটাই শ্রদ্ধা ও জনপ্রিয়তার আসনে ছিলেন । কি সাগরে কি আসামে । একবার আমার কলেজ আমার লিয়েন বাড়াতে  অস্বীকার করলো । স্যার ফোন করলেন আসামের শিক্ষা কমিশনার অশোক শইকিয়াকে । আমার সামনে । শইকিয়া বললেন, আমি দিল্লি এসে আপনার সঙ্গে দেখা করছি । আপনি ভদ্রলোককে ছাড়বেন না, কলেজ যাই বলুক । আমি দেখছি । স্যারকে অদেয় কারো কিছু ছিল না ।
   ছাত্রদের সম্পর্কে স্যারের কৌতূহল ছিল অফুরান । কে কোথায় আছে, কী করে, ছেলেমেয়েরা কী পড়ে - সব তাঁর জানা চাই ।
         আমার সঙ্গে অনেকবার অনেক মতভেদ হয়েছে । ঝগড়ার পর্যায়েও গেছে । কিন্তু  সব ছাপিয়ে উঠেছে তাঁর স্নেহ।
     এমন  বিদগ্ধ, মিষ্টভাষী, স্নেহশীল,  সহৃদয় মানুষ আমি কমই দেখেছি

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.