Header Ads

ভারতীয় জীবনে রাম কেন আদর্শ পুরুষ

অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী
শ্রীরাম মন্দিরের ভূমিপূজনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সভ্যতায় নতুন যুগের সূচনা হলো অবশেষে।  সমস্ত পৃথিবীর টানটান দৃষ্টি ছিল এই অনুষ্ঠানের দিকে। তথাকথিত ভণ্ড প্রগতিশীল, মেকি ধর্মনিরপেক্ষদের কাছে এটা ছিল বুক চাপড়ে আর্তনাদের দিন। আর মৌলবাদী আরবীয় সাম্রাজ্যবাদীদের করুণ পরাজয়। অন্যদিকে আর্য 
স্বাভিমানের উত্থান~ভারতীয় সাংস্কৃতিক গৌরবের পুনর্জাগরণ। রাম মন্দিরটি নিছক একটি মন্দির নয়। রামচন্দ্রের অমন মন্দির তো হাজার-লক্ষ রয়েছে। এই মন্দির ভারতীয় সভ্যতার কলামন্দির~রাষ্ট্র-মন্দির। রামচন্দ্র এখানে সেই সভ্যতার প্রতীক। ভূমিপূজন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বাণীতে এই বার্তাই উচ্চারিত হলো। কোটি কোটি মানুষের আস্থা, সামূহিক সংকল্প আর শক্তির প্রতীক। নরের সাথে নারায়ণের যুক্ত হওয়ার দিন। 
   শ্রীরামচন্দ্রকে মর্যাদাপুরুষ পুরুষোত্তম বলা হয়। অথচ রামায়ণের কত রকম ব্যাখ্যা~কত কদর্য কুৎসিত নোংরা বিশ্লেষণও হয়েছে। কে বলে~এই দেশ সহিষ্ণু নয়? সহিষ্ণু না-হলে কি সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতন কত শত পণ্ডিত পণ্ডিতা রামায়ণের অমন কাটাছেঁড়া পোস্টমর্টেম করতে পারেন? এর ছিটেফোঁটাও যদি আরবের অবতারটিকে নিয়ে করতেন~তখন বোঝা যেত~কত ধানে কত চাল, কত দিনে মাস আর ঘাড়ে ক-খানা মুন্ডু। রামায়ণ তো নিছক মহাকাব্য নয়। মহা ধারা। ভারতীয় মহাসভ্যতা, মহাজীবনের নানা কথা উপকথা এখানে এসে মিশেছে। গঙ্গায় ব্রহ্মপুত্রে তো কত আবর্জনা ভেসে আসে~তাও তা শাশ্বত। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ থেকে আচার্য সুনীতিকুমার~সকলেই বলে গেছেন~রামকাহিনিতে বহু যুগের বহু উপকরণ এসে মিশেছে। মহর্ষি বাল্মীকির নামে যা চলছে~তাতে অন্য কবির, লোকসাহিত্যরচকের বহু প্রক্ষিপ্ত পদও যুক্ত হয়েছে। স্বামীজি লিখছেন~"পরবর্তী কালে অপরের রচিত অনেক আখ্যানমূলক কবিতা ঐ প্রাচীন কবি বাল্মীকির পরিচিত নামের সহিত জড়িত হইয়াছে। শেষে এমনও দেখা যায় যে, অনেক শ্লোক বা কবিতা তাঁহার রচিত না হইলেও সেগুলি তাঁহারই রচিত বলিয়া মনে করা একটা প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।"(দ্র. স্বামীজি রচনাবলি অষ্টমখণ্ড)। এর ফলে কত শত রকমের রামায়ণ, কত বিচিত্র কাহিনি, কত নতুন রামচরিত্র দেখা দিল। এটা এই দেশেই সম্ভব। এতটাই সহিষ্ণু ও বৈচিত্রপূর্ণ এই দেশ। একটা উদাহরণ দিই। পালি জাতক গ্রন্থে "দশরথ-জাতক" রয়েছে। ওখানে রাবণ বা সীতাহরণ নেই। সীতা রামের ভগিনী এবং পরে বিবাহিতা স্ত্রী। ভাবা যায়? আচ্ছা, ওসব নাহয় পুরাতনী। একেবার উনিশ শতকে মাইকেল মধুসূদন তো "আমি কি ডরাই সখী ভিখারী রাঘবে" লিখে রামচন্দ্রকে ভিখিরিও করে রাবণের দিকে পাঠকের সমবেদনা টেনে আনলেন। কই, এই নিয়ে তো বঙ্গদেশে লাঠালাঠি হয়নি। আসলে রবীন্দ্রনাথের একটি কথাতেই এর মূল কারণ লুকিয়ে আছে~"দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েকে দেবতা"~সনাতন ভারতবর্ষ চিরকাল সেটাই করেছে। দেবতা-ঈশ্বর-ভগবান~যা-ই হোক না কেন~আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের প্রিয় করে নিয়েছে। আর এর ফলেই এই দিব্য চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রচুর লৌকিক গুণাগুণ , রক্তমাংসের মানুষের সমস্ত কিছুই যুক্ত হয়েছে। কিন্তু তাও সেই অনন্য চরিত্রায়ণ ব্যাহত হয়নি। তাঁরাই ভারতীয় জীবনের আইডল হিসেবে পূজ্য আছেন। এই দেশ চিরকাল শুভ ও সুন্দরকেই আরাধনা করেছে। শ্রীরামচন্দ্র সেই সুন্দরের আরাধনার প্রতীক। 
    শ্রীরামচন্দ্রকে কেন্দ্র করেই তো এত বিরাট বিপুল সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস~জীবনধারা, দর্শন~শক্তিমত্তা, বিচারবোধ~রাজনীতি~রাষ্ট্রবাদ~বিভিন্ন দিকে ভারতীয় সভ্যতা উদভাসিত। তাঁর পিঠে শস্ত্র। ধনুক। তির। কিন্তু যুদ্ধটাই রামায়ণে একমাত্র উদ্দেশ্য নয়~শেষ কথা নয়~লড়াকু জীবনটাই প্রতিপাদ্য~এই ব্যাখ্যা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। তিনি লিখছেন~"দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এই কাব্য রচিত তাহাও নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন, পণ্ডিতেরা ইহার প্রমাণ করিবেন। ...কবি যদি রামায়ণে নরচরিত্র বর্ণনা না-করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন, তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত...। মানুষ বলিয়াই রামচন্দ্র মহিমান্বিত।"(দ্র. "প্রাচীন সাহিত্য")। বুদ্ধদেব বসুও লিখেছেন~রামচন্দ্রের কর্মময় জীবনের দিকটিই সবচেয়ে বড়। বলছেন~"বাল্মীকিতে এ-কথা একটু জোর দিয়েই বারবার বলা  হয়েছে যে রাম অবতার হলেও মানুষ, নিতান্তই মানুষ। মনুষ্যত্বের মহত্তম আদর্শের প্রতিভূ তিনি, বিশেষ-কোনো একটি দেশের বা যুগের নয়, সর্ব দেশের, সর্ব কালের। দেহধারী মানুষ হয়ে, স্থানে ও কালে সীমিত হয়ে, যতটা মুক্ত, শুদ্ধ, সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব, রামচন্দ্র তা-ই। যদি তিনি সাক্ষাৎ নারায়ণই হবেন, তবে মারীচের রাক্ষসী মায়ায় মজবেন কেন?"(দ্র. 'সাহিত্যচর্চা')। 
    রাম চরিত্রের এই সর্বজনগ্রাহ্য স্বাভাবিক কর্মময়, ন্যায়বাদী জীবনচর্যাটিই ভারতবর্ষের চিরকালের আরাধ্য। প্রথমত নিষ্ঠা। রামায়ণের বালকাণ্ডটি তো শৈক্ষিক নিষ্ঠার চরম উদাহরণ। বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ প্রমুখ মুনিদের পবিত্র সান্নিধ্যে বাস্তবজীবনবীক্ষার দীক্ষা ও শিক্ষা। অযোধ্যাকাণ্ডে কর্তব্য। পিতৃভৃতি, মাতৃভৃতি, ভ্রাতৃভৃতি। সত্যের জন্য চরম ত্যাগ। কৃচ্ছ্রসাধনা। শ্রমসুখপ্রিয়তা, আরণ্যক জীবন। এরপর সরল পার্বত্য অনার্যজীবনের সঙ্গে সহবাস~সহযোগ আর উদ্যম। জীবনের কঠিন পরীক্ষা যে ভগবান বলে আরাধ্যজনকেও দিতে হয়েছিল~তারই নিদর্শন। ভারতীয় সভ্যতায় ঈশ্বরের আরেক নাম "বিধি"। বিধি মানে নিয়ম। জগতের নিয়ম সকলকেই বহন করতে হয়। জীবনসংগ্রাম যে  কর্তব্য~কিছু পেতে হলে কর্মের ভেতর দিয়ে পেতে হয়~সেটাই রাম চরিত্রে পরিস্ফুট। কিছুদিন আগে সৎসঙ্গের বর্তমান মেন্টর অর্কদ্যূতি চক্রবর্তী এই উদাহরণটি দিয়ে এক সভায় বলেছিলেন~তিনি যদি ভগবানই হবেন~তাও তাঁর বউকে চুরি হতে হয় কেন! তিনি অলৌকিক কিছু করতে পারতেন না?আসলে রামায়ণকার এটাই বুঝিয়েছেন~সকলেই বিধি বা নিয়মের অধীন। এমনকি ঈশ্বরও। তাই ঈশ্বরের আরেক নাম "বিধাতা"। বিধির উদগাতা। এই কর্মের ভেতর দিয়ে প্রাপ্তির শিক্ষাই রামায়ণের শিক্ষা। সৎসঙ্গের এই ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়~এবং এখনও এর কুৎসিত ব্যাখ্যা চলছে। অথচ বুদ্ধদেব বসু সেই কবেই লিখে গেছেন~"সীতা-উদ্ধার হলেই তো হলো না, সেটা ত্যাগের ও দুঃখের দীর্ঘতম পথে হওয়া চাই; কেননা, সীতা-উদ্ধার তো উপলক্ষ, লক্ষ্য হলো রামের সর্বাঙ্গীণ মরত্ব-ভোগ।"(দ্র. "সাহিত্যচর্চা")। সত্যিই তো~যে রামভক্ত ল্যাজের আগুনে লঙ্কাপুরী ছারখার করেন~যিনি ফাল মেরে শত সহস্রযোজন সাগর পেরিয়ে যান~এক রাতের মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে হিমালয় গিয়ে গন্ধমাদন পর্বত মাথায় করে আনতে পারেন~সেই হনুমান কি অশোক বন থেকে সীতা মাইয়াকে সসম্মানে পিঠে বসিয়ে প্রভু রামের কাছে নিয়ে আসতে পারতেন না? তিনি এই প্রস্তাব সীতা মাইয়াকে দিতেই সীতা বলেছিলেন~"সমস্ত রাক্ষসদের বধ করে যদি তুমি জয়ী হও, তাতে রামের যশোহানি হবে।...যদি রাম এখানে এসে দশানন ও অন্য রাক্ষসদের বধ করে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান তবেই তাঁর যোগ্য কাজ হবে।"  অর্থাৎ রামচন্দ্রের মহিমাময়, দীপ্ত, বীরত্বমুখর কর্তব্যপরায়ণ চরিত্রটিই রামায়ণকারের প্রতিপাদ্য ছিল। অলৌকিক রামকে ভারতবর্ষ চায়নি। চায় না। তাঁর মর্ত্যজীবনের মহান রূপটিকেই ভারত পূজা করে। 
      রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই শেষ করি। তিনি লিখেছেন~ "রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে। পিতাপুত্রে, ভ্রাতায় ভ্রাতায়, স্বামীস্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন, যে-প্রীতিভক্তির সম্বন্ধ~রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে।" কবি আরও লিখেছেন~দেশজয় ও শত্রুবিনাশ~সেটা মহাকাব্যে গুরুত্ব পায়নি। "রামায়ণের মহিমা রাম রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই, সে যুদ্ধঘটনা রাম ও সীতার দাম্পত্যপ্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষমাত্র।" পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, পতিপত্নীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে, রামায়ণ তাহাই দেখাইয়াছে।"
    দুঃখের বিষয় রামচরিত্রকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার এই বিরাট বিপুল জীবনসত্যকে এই দেশেরই তথাকথিত 'প্রগতিশীল' দেশদ্রোহীরা চিরকাল অপব্যাখ্যা করে ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতিকে চরম অপমান করে এসেছে। এরা রাম মন্দিরকে চিরদিন রাজনৈতিক উপকরণ রূপে গণ্য করেছে~সভ্যতার উপকরণ রূপে নয়। রাম-কালচার যে হিন্দুস্থানের মর্মে গাঁথা~সেটাও এদের বিচার্য নয়। এই ঘৃণনীয় মানসিকতার জন্যই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন~"রামের চরিত্র উচ্চ কি নীচ, লক্ষণের চরিত্র আমার ভালো লাগে কি মন্দ লাগে~এই আলোচনাই যথেষ্ট নহে। স্তব্ধ হইয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে হইবে, সমস্ত ভারতবর্ষ অনেক সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কীরূপভাবে গ্রহণ করিয়াছে। আমি যত বড় সমালোচকই হই-না কেন, একটি সমগ্র প্রাচীন দেশের ইতিহাস-প্রবাহিত সমস্ত কালের বিচারের নিকট যদি আমার শির নত না-হয়, তবে সেই ঔদ্ধত্য লজ্জারই বিষয়।"
    রাম মন্দির স্থাপনটি তাই নিছক ধর্মাচরণ নয়। ভারতীয় স্বাভিমানের আত্মপ্রকাশ~ সাংস্কৃতিক পুনরুত্থান।এই উত্থানের ফলে রবীন্দ্রনাথ-কথিত সমস্ত ঔদ্ধত্য নতুন করে পরাভূত হবে। মূর্তি ও মন্দির ভাঙার চৌদ্দশ বছরের অপসংস্কৃতি থমকে দাঁড়াবে। নতুন ভারতে শক্তি, শান্তি, প্রগতি, সমৃদ্ধি~সমস্ত দিক থেকে নয়া যুগের সূচনা হবে।
•••••
কটন বিশ্ববিদ্যালয়, গুয়াহাটি

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.