Header Ads

বিজেপি’র চমক সৃষ্টির রাজনীতিতে তথাগত- কৃপাকরানন্দ-মুকুল ও শুভেন্দুকে নিয়ে জল্পনা !! (১)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
মমতার বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্যে দাঁড় করানো যাবে এমন একজন নেতাও বঙ্গ বিজেপি’র ভাঁড়ারে নেই। দিলীপ ঘোষের একলাই বাজিমাতের হাস্যকর প্রবণতায় রক্তচাপ বেড়ে চলেছে বিজেপি’র শীর্ষমহলে। আরএসএসও সম্প্রতি দিলীপ ঘোষের ‘একাই এক’শো’ হিসেবে তুলে ধরার ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখছে না। তারাও চাইছে উত্তরপ্রদেশের যোগীর মতোই এমন একজন কাউকে বিজেপি’র মুখ হিসেবে তুলে ধরে নির্বাচনে যেতে। এমন একজনের সন্ধানও যে তারা পায় নি তা নয়--তাঁকে সম্মত করানোর জোর চেষ্টাও চলেছে। 
 
অপ্রত্যাশিতভাবে ঠিক এই সময়েই রাজ্য বিজেপি’র প্রাক্তন সভাপতি তথা রাজ্যপাল তথাগত রায় বেশ কড়া কিছু মন্তব্য সহ এই বার্তাই পাঠিয়েছেন যাতে মনে হচ্ছে তিনি রাজ্য রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে ফিরতে চাইছেন। বিজেপি’র অন্দরমহলে এর ফলে আলোড়ন পড়ে গেছে। গেরুয়া শিবিরে নতুন সমীকরণের জল্পনা উসকে দিয়েছেন তথাগত রায়। প্রাক্তন বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাজ্যপালের সাংবিধানিক পদ ছেড়ে ফের সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাতেই বঙ্গ বিজেপির মুখ হিসেবে তাঁর উত্থান নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। এবার সেই সম্ভাবনা নিয়ে মুখ খুললেন দিলীপ ঘোষ। বঙ্গ বিজেপি এই সম্ভাবনায় দু-ভাগ।
তথাগত রায়ের সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার ইচ্ছাপ্রকাশ নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে চর্চা শুরু হতেই কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা স্বাগত জানিয়েছিলেন তাঁর এই বার্তাকে। কিন্তু বিজেপির বর্তমান রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সুচতুরভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেও প্রাকারান্তরে অনীহা প্রকাশ করলেন। বুঝিয়ে দিলেন তাঁর অবস্থান।
মঙ্গলবার জলপাইগুড়িতে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে দিলীপ ঘোষ এই অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে বলেন, এটা আমার বিচার্য বিষয় নয়। এ বিষয়টি পার্টি বুঝবে। তবে তাঁর এই উত্তর নিয়েই জল্পনা তৈরি হয়েছে যে, তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তাঁর অনীহাই প্রকাশ করলেন এ বিষয়ে।
তথাগত রায় ২০১৫ সালে সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে সাংবিধানিক পদে চলে গিয়েছিলেন। তিনি ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন রাজ্যপালের দায়িত্ব নিয়ে। সেখানে থেকে মেঘালয়ের রাজ্যপাল হয়েছিলেন। পাঁচ বছর পর তিনি আবার ফিরতে চাইছেন সক্রিয় রাজনীতিতে। তাঁর এই ইচ্ছায় বঙ্গ বিজেপিতে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
রাজ্য রাজনীতিতে উভয়ের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। স্বভাবতই তথাগত রায় ফের সক্রিয় রাজনীতিতে এলে দিলীপ ঘোষ চাপে পড়তে বাধ্য। তাঁকে যদি বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মুখ করতে চায় আসন্ন নির্বাচনে, তবে বিজেপি শিবিরে লড়াই বাড়বেই। এমনিতেই বঙ্গ বিজেপিতে দুই বা ততোধিক গোষ্ঠী হয়ে রয়েছে। তথাগত এলে সেই লড়াই যে আরও কঠিন হবে, তা বলাই যায়।
তথাগত তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার ইচ্ছাপ্রকাশের পাশাপাশি তাঁর বক্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বঙ্গ বিজেপি সঠিক পথে চলছে না। বড্ড বেশি ধর্মীয় তাস খেলা হচ্ছে। গোমুত্রে করোনা সারবে, দুধে সোনা মিলবে- এই ধরণের নির্বুদ্ধিতা প্রকাশের রাজনীতি বাংলায় চলে না। তাঁর এই ধরনের ভাষ্য যে দিলীপ ঘোষ ভালোভাবে নেননি, তা বুঝিয়ে দিলেন প্রশ্ন এড়িয়ে।
ঠিক এই জায়গাটাতেই সমস্যা বেশ জটিল। তথাগত আদ্যান্ত ধুতি-পাঞ্জাবি’র বাঙালি এবং বাংলা সংস্কৃতি ও কৃষ্টিতে তিনি অভ্যস্ত ও সাবলীল--তার চেয়েও বড় কথা তিনি সাভারকার লবি’র লোক নন--শ্যামাপ্রসাদ লবির লোক। হয়তো এই কারণেই আরএসএস-এর ওয়াশিং মেশিনে তাঁর মাথা সম্পূর্ণ ধোয়া সম্ভব হয় নি। তবু বঙ্গ বিজেপি’র রাজনীতিতে তথাগত রায় যদি সত্যি সত্যি সক্রিয়ভাবে ফিরে আসেন তাহলে একাধিক ফাটলে বিব্রত বঙ্গ বিজেপি আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাবে দুটি শিবিরে। সাভারকার লবি সংখ্যালঘু হলেও আরএসএস ও কেন্দ্রীয় সাভারকার পন্থীদের আশীর্বাদে শ্যামাপ্রসাদ পন্থীদের তুলনায় শক্তিশালী হওয়ায় যে দিলীপ ঘোষকে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে রাজ্যের মানুষ তো দূরের কথা বিজেপি’রই তৃণমূলস্তরের কর্মী-সমর্থকরা কেউ চিনতেন না তাঁকেই রাতারাতি এবং সরাসরি রাজ্য সভাপতির পদে বসিয়ে দিতে অসুবিধে হয় নি। তবু তথাগত সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে এলে (বা তাঁকে ফিরে আসার সুযোগ দিলে) দিলীপ ঘোষের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি হবে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক জ্ঞানগম্যির বিচারে ধারে ও ভারে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন তথাগত রায়।
রাজ্য বিজেপিতে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও সাভারকারপন্থীরা কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করে মুকুলকে শুধুমাত্র প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবহারের যন্ত্র হিসেবে ধরে রেখেছে। মুকুলকে তাঁর যোগ্যতার বিচারে এখনও সেভাবে মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। তবু মুকুল এখনও বিজেপিতে রয়েছেন, কিন্তু কেন রয়েছেন সেটাও খুব তাড়াতাড়িই স্পষ্ট হতে পারে বলেই আমার ধারণা। নিজের হাতে গড়া দল ছেড়ে মুকুল যখন বিজেপিতে আসতে বাধ্য হন তখনই তিনি বুঝতে পারছিলেন--প্রতিনিয়ত উপেক্ষা হেনস্তা আর অপমান মুখবুঁজে সহ্য করে নিজের রাজনৈতিক জীবনকে খতম করা উচিত হবে না। পাশাপাশি এটাও বুঝতে পারছিলেন--দলের সিংহভাগ কর্তৃত্ব হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে এবং তার ফলে দল আর অটুট থাকবে না। সেটা প্রমাণ হয়েছে মুকুল দল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। দল ছাড়ার সঙ্গে তার বিরুদ্ধে কয়েক’শো দুর্নীতির মামলা আত্মপ্রকাশ করল--দলত্যাগের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এসবের কোনো অস্তিত্বই ছিল না ! মুকুলকে শুনতে হচ্ছিল--তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া মুকুলের কোনো অস্তিত্বই নেই। হারিয়ে যাবে মুকুল--ঝরে যাবে অকালেই এবং লোকে ভুলে যাবে--মুকুল নামে কোনো নেতা তৃণমূলে ছিল ! এই বালকোচিত স্পর্ধিত কটাক্ষের জবাব মুকুল গত লোকসভা নির্বাচনেই দিয়ে দিয়েছেন--কিন্তু অপমানের জবাব পুরোপুরি দিতে এখনও বাকি ! এটা খুবই স্পষ্ট যে, মুকুল তৃণমূলে ফিরছেন না, বিজেপিতেও তিনি এখন কঠিন এক প্রশ্নচিহ্ন হিসেবে নিজেকে ঝুলিয়ে রেখেছেন--তাঁর সঠিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ কি হতে পারে তাই নিয়েই চলছে তুমুল
জল্পনা ! কারণ, মুকুল রায় একজন বিরাট সংগঠক এবং তৃণমূল ভাঙতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিনি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত। মূল হিন্দু নেতৃত্ব এবং ক্যাডারদের (আরএসএস) কাছে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নন।
বাংলায় এবার বিজেপি’র ‘ডু অর ডাই সিচুয়েশন’। এক বছরেরও কম সময় বাকি বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের। বিজেপির কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো বিকল্প কোনও বিশ্বাসযোগ্য মুখ নেই। তাই মাঝে মাঝেই সৌরভের নামটাও বিজেপি’র মুখ হিসেবে বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আমি এর আগে একটা প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই বলেছিলাম--সৌরভ বিজেপির রাজনৈতিক ঘুঁটি হচ্ছেন না। এখনও সেই কথাই বলছি। তার অসাধারণ জনপ্রিযয়সত্ত্বেও তিনি রাজ্যের হিংসাত্মক এবং অশান্ত রাজনৈতিক জালে আদর্শগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যে নারাজ সেটা তিনিও অস্পষ্ট রাখেন নি।
যোগী আদিত্যনাথের পর আরও এক স্বামীজির উত্থান হতে পারে সক্রিয় রাজনীতিতে। স্বামী কৃপাকরানন্দ মহারাজের সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্থান নিয়ে বাংলায় তীব্র জল্পনা তৈরি হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি ইতিমধ্যেই তাঁকে বাংলার ভবিষ্যতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বর্ণনা করতে শুরু করেছেন। তা সত্যি হলে দিলীপ ঘোষদের কপাল পুড়তে পারে। এখন সবটাই নির্ভর করবে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যের উপর। তাহলেই উত্তর প্রদেশের পর বাংলাতেও মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে পারেন এক যোগী পুরুষ। রামকৃষ্ণ মিশনের যোগী কৃপাকরানন্দ মহারাজ হতে পারেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্য রাজনীতিতে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, দিলীপ-মুকুলদের হাত ধরে বাংলা জয় সম্ভবপর হলেও কুর্সিতে বসবেন যোগী মহারাজ। বিজেপিতে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী অরাজনৈতিক ব্যক্তি ! রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলার রাজনীতিতে এরকম বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটতে পারে যদি বিজেপি নেতৃত্ব ওই যোগী মহারাজকে সক্রিয় রাজনীতিতে আনতে পারে কিংবা তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিতে রাজি হন তবেই।
বঙ্গ বিজেপির মুখ নিয়ে যে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, তাতে ২০২১ সালের বাংলার নির্বাচনী লড়াইকে সামনে রেখে দলের শীর্ষে উঠে আসতে পারেন রাজনীতিরে বাইরের কেউ। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, রামকৃষ্ণ মিশন সর্বদা রাজনীতির বাইরে থেকেছে। আর রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ হিসেবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার পক্ষে নয় কেউই। আগে এক সাক্ষাৎকারে কৃপাকরানন্দ মহারাজ নিজেই বলেছিলেন যে, এ জাতীয় কোনও পরিকল্পনা তাঁর নেই। তাই তিনি রাজি হবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। বাংলায় পরিবর্তন আনতে কোনও ব্যতিক্রমী পন্থা তবে রাজনীতিতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। আর কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। তাই সেই সম্ভাবনা ধরে নিয়েই বলা যায় অবাক করার মতো কোনও ঘটনা ঘটতেই পারে। কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব বাংলায় পরিবর্তন আনতে এমন কোনও পন্থা অবলম্বন করতেই পারে। সেটা যদি হয় তা একাবারে অবাস্তব হবে না।
 
 
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.