Header Ads

বিজেপি’র চমক সৃষ্টির রাজনীতিতে তথাগত- কৃপাকরানন্দ-মুকুল ও শুভেন্দুকে নিয়ে জল্পনা !! (২)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 

চমক সৃষ্টির রাজনীতি প্রবণ বিজেপি’র খাতায় উঠে আসা চমকপ্রদ নাম--স্বামী কৃপাকরানন্দ মহারাজ ! কে এই মহারাজ? দেবতোষ চক্রবর্তী বাংলায় মাধ্যমিকে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছিলেন। সপ্তম হয়েছিলেন উচ্চমাধ্যমিকে। তারপরে তিনি মেডিকেল জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ১৭তম স্থান অর্জন করেন এবং এনআরএস মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এরপরে তিনি দিল্লির এইমস থেকে এমডি করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে হার্ট রিসার্চ করতে যান। সেই দেবতোষই আজ কৃপাকরানন্দ মহারাজ !
 
আমেরিকাতে তার গবেষণার দিনগুলির পরে দেবতোষ অদৃশ্য হয়ে যান। তাঁর এনআরএসের রুমমেটরা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন সেই তথ্য। কয়েক বছর পরে কৃপাকরানন্দ নামে এক যুবক সন্ন্যাসী বেলুড় মঠে হাজির হন এবং স্বাস্থ্য ভবনের দায়িত্ব নেন। তিনি হলেন দেবতোষ চক্রবর্তী। আজকের কৃপাকরানন্দ মহারাজ। এই বেলুড়মঠেই তাঁর সঙ্গে একাধিকবার দেখাও হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গেও ! দক্ষতা-যোগ্যতার শীর্ষে থাকা এক আদর্শ যোগী একজন দক্ষ ডাক্তার এবং আকর্ষণীয় বক্তা হওয়ার পাশাপাশি তিনি শিল্পী ও গায়ক। আশ্চর্যরকমভাবে নিখুঁত শাস্ত্রীয় সংগীত গাইতে পারেন তিনি। একসব গুণে গুণান্বিত তিনি। তাঁর মতো যোগ্য ব্যক্তি খুব কমই হন। কিন্তু তাঁর পাশাপাশি এটাও প্রযোজ্য যে তাঁর মতো যোগ্যর রাজনীতিতে আশা মানে নিজেকে মেরুকরণ করে দেওয়া। সেটা একেবারেই হওয়া উচিত নয়। বিজেপি যদি কৃপাকরানন্দ মহারাজকে আনতে পারে সক্রিয় রাজনীতিতে, তবে গেরুয়া শিবিরের কাছে তা সোনায় সোহাগা হবে। বিজেপির কাছে সবদিক দিকে আদর্শ মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হবেন তিনি। তবে রামকৃষ্ণ মঠের আদর্শ, তাঁর নিজের আদর্শের পরিপন্থী হবে এই সিদ্ধান্ত। তাই তিনি হয়তো এই সম্ভাবনার জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
 
বিজেপি মনে করছে, তিনি যদি রাজি হন, তবে তাঁর পক্ষে কোনও সমস্যা হবে না বাংলার কুর্সিতে বসা। কেননা এই রাজ্যে বিশিষ্ট মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বিধানচন্দ্র রায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো মুখ এসেছেন আগে। ফলে কৃপাকরানন্দের মতো শিক্ষিত-মার্জিত-রুচিশীল মানুষ বসলে সব দিক দিয়ে উজ্জ্বল হবে।
কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশন রাজনীতির প্রতি স্পর্শকাতর থেকেছে। কৃপাকরানন্দ নিজেই নিজের জন্য রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা অস্বীকার করেছিলেন। তবে এই সম্ভাবনাও রয়েছে যে, এটি আরএসএসের একটি অন্যতম গোপন পরিকল্পনা। বাংলার জনসাধারণকে চমকে দিতে রাজনীতির বাইরের কোনও মানুষকে প্রশাসনিক শীর্ষ পদে বসানো। তাই যদি হয়, কৃপাকরানন্দ মহারাজ অন্যতম মুখ হয়ে উঠতে পারেন।
কিন্তু যদি তা না হন তাহলে বিজেপি’র হাতে কি তাহলে পেন্সিল ছাড়া আর কিছুই থাকছে না? দিলীপ ঘোষ আরএসএস লবির ঘনিষ্ঠ হলেও তাঁর সম্পর্কে ইদানীং নির্ভরতা সেই জায়গায় রাখা যাচ্ছে না। কারণ, বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একজন লড়াকু নেতা এবং তিনি আরএসএস থেকে উঠে এসে বঙ্গ বিজেপির প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন--তবুও শিক্ষিত বাঙালিরা তাঁর এই বাস্তবিক মেঠো রাজনীতি পছন্দ করেন না। অথচ বাংলা জয়ের স্বপ্নকেও বাস্তবায়িত করতেই হবে--এমন একটা পরিস্থিতিতে এমন কাকে তুলে ধরা যায় যাকে দিয়ে একই সঙ্গে তৃণমূলকে ভেঙে তছনছ করে দেওয়া যেতে পারে ! এই জায়গাটিতেই তুমুল জল্পনা তৈরি হচ্ছে শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে। তৃণমূলে এখন শুভেন্দুর ঠিক সেই অবস্থা চলছে যে অবস্থা থেকে তীব্র বিরক্ত ও হতাশ হয়ে মুকুল দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল কংগ্রেসের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সামনেই ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনের আগে তাঁর মতো জননেতা শাসক শিবিরে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছেন। ক্রমেই তৃণমূলের কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁর সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ। কেননা একের পর এক ঘটনায় তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর ফারাক বেড়েই চলেছে। কিছুদিন আগে হুল দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। সেদিনই হুল দিবসের অন্য এক অনুষ্ঠানে তিনি হাজির হয়েছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল আদিবাসী দিবসে। দলের মহাসচিব উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শুভেন্দু এড়িয়ে গেলেন সরকারি অনুষ্ঠান। তারপরই রাজনৈতিক মহলে জল্পনা উঠল চরমে। এই অবস্থায় আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে পড়তে হল সেই প্রশ্নবাণের সামনে। ঝাড়গ্রামে সিধু-কানু মঞ্চের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, শুভেন্দু এলে ভালো হত। কিন্তু তিনি এলেন না। কী আর বলব, আমি তো এখানে বিতর্ক তৈরি করতে আসিনি।
সরকারি অনুষ্ঠানে না গেলেও, শুভেন্দু অধিকারী গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রাম শহর থেকে কিছুটা দূরে কলাবনির পিয়ারডোবায় বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদয়াপন অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের দাবি, গত ১০ বছর ধরে অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন শুভেন্দু। অনুষ্ঠানে ৫০টি ক্লাবকে ক্রীড়া সরঞ্জাম এবং ১০টি লোকসংস্কৃতি দলকে ধামসা মাদল বিতরণ করেন শুভেন্দু অধিকারী। এর আগে শুভেন্দু বহুবারই জল্পনা বাড়িয়ে তৃণমূল এবং সরকারি অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে গিয়েছেন। এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন যাতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তিনি তৃণমূলের থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। এমনকী সমান্তরাল জনসংযোগও চালানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
শুধু অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াই নয়, শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের সমন্বয় কমিটির বৈঠকেও যোগ দেননি। তিনি চিঠি লিখে মহাসচিবকে জানান বিশেষ কাজে তিনি যোগ দিতে পারছেন না, পরবর্তী বৈঠকে তিনি যোগ দেবেন। তিনি চিঠি লিখলেও জল্পনা থামেনি তাঁর পদক্ষেপ নিয়ে।
এরপর সম্প্রতি একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছে খোল বাজিয়ে রামনামে মাতোয়ারা তৃণমূলমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর মুখে রাম নাম শুনেই জল্পনার পারদ চড়ে যায় নিমেষে। অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভূমিপুজোর দিন বিজেপি নেতারা রামপুজো করেছেন, কিন্তু তৃণমূলের হেভিওয়েট রামপুজো করবেন দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে, তা কেউ ভাবেননি। কিন্তু সেটাই হওয়ায় শুভেন্দুর বিজেপি-যোগ নিয়ে ফের জল্পনা শুরু হয়ে যায়। শুভেন্দু তৃণমূলে যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন না বলে দাবি তাঁর অনুগামীদের। সম্প্রতি রদবদলে পর্যবেক্ষক পদ উঠে যাওয়ায় জেলার দায়িত্ব হাতছাড়া হয়েছে শুভেন্দুর। তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়নি। তাঁর অনুগামীরা রাজ্য সভাপতি পদ দাবি করেছিলেন, পরিবর্তে শুধু দুই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন শুভেন্দু। তাই শুভেন্দুও মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে।
এইসব ঘটনা পরম্পরা থেকে খুব সঙ্গত কারণেই জন্ম হচ্ছে নানান ধরণের জল্পনার। বাংলায় বিজেপি’র মুখ্যমন্ত্রীর মুখ যদি যোগীর মুখ না হয়, যদি তথাগত না হন,সৌরভ তো হচ্ছেন না বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে, মুকুলও চমকের তালিকায় নেই, বৈশাখী ঝড়ে উড়ে যাওয়া শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কথাও ভাবা হচ্ছে বলে কোনো খবর নেই--দিলীপেও শ্যামাপ্রসাদ লবিরতো বটেই--সাভারকার লবিরও আস্থা অনেক কমের দিকেই--তাহলে সেই চমকপ্রদ মুখটি কি শুভেন্দুর? এ ব্যাপারে অবশ্য না কলকাতা না দিল্লি--কোথাও কোনোরকম প্রকাশ্য আলোচনা নেই--যদি কোনো আলোচনা থেকেই থাকে তা রুদ্ধদ্বার কক্ষেই থেকে যাচ্ছে এখনও পর্যন্ত।
শুভেন্দুকে এসো বললেই শুভেন্দু বিজেপিতে যাবেন না। তাঁর নিজস্ব কিছু শর্ত থাকবে--সেসব বিজেপি মেনে নিলেই শুভেন্দু যেতে পারেন। কারণ, তিনি মানুষের জন্যে কাজ করতে চান এবং সেটা সম্মানের সঙ্গেই। এক মুকুলে রক্ষে নেই--এর সঙ্গে যদি শুভেন্দু যোগ দেন তাহলে এই দুই ধারালো জোড়া ফলার শক্তিতে বিজেপি প্রায় অপরাজেয় হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। শুভেন্দু দল ছাড়লেও তাঁর বিরুদ্ধেও মুকু্লের মতোই কয়েক’শো দুর্নীতির মামলা দায়ের হবে। দলের বাইরে যে তাঁর কোনো মূল্যই নেই তাও ফলাও করে প্রচার করা হবে। এটাই রাজনৈতিক দস্তুর সবাই তা জানে।
তবে এটা ক্রমশঃই খুব স্পষ্ট হযে উঠছে যে, বঙ্গ রাজনীতি ক্রমশঃই এক টান টান উত্তেজনার আবহে ঢুকে পড়তে চলেছে !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.