Header Ads

স্বাধীনতা দিবসের বেদনা

উমা পুরকায়স্থ

১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস ; ভারতের জাতীয় জীবনে এক পরম গৌরবোজ্জ্বল দিন, যার পেছনে আছে অগনিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রাণ বলিদান, আরও পৈশাচিক নির্যাতনের বেদনাময় ইতিহাস!  স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত বিবরণ আজও ইতিহাসে স্থান পায়নি, যে ইতিহাস প্রচলিত আছে তা তৎকালীন রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীদের ফরমায়েসি গৌরবের কাহিনি মাত্র!


 ছবি, সৌঃ আন্তৰ্জাল
 আজ ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসে যে উপলব্ধি মনে আসছে তা হল, স্বাধীনতা লাভ পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের জীবনে এক পরম অভিশাপ! এ দিন আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমাদেরও একটা দেশ ছিল; যেখানে ছিল পিতৃ-পিতামহদের শতস্মৃতি বিজড়িত ঘরবাড়ি; ছিল বড় আদরে পোষা গরু-বাছুর, কুকুর - বেড়াল; ছিল আম, জাম, কাঁঠাল গাছের সারি! যেখানে আমরা প্রাণ খুলে হাসতাম, গলা ছেড়ে গান গাইতাম, মনের আনন্দে নাচতাম, খেলতাম 'বন্দিছুট', 'লুকোচুরি' আরও কত খেলা। সারা বাড়িতে দৌড়ঝাঁপ করে আনন্দে কেটেছে আমাদের ছেলেবেলা । হ্যাঁ, অভিভাবকদের শাসন নিশ্চয়ই ছিল, ছিল সাবধানের  সতর্কতা কিন্তু আজকের মতো রাজনৈতিক বিধি নিষেধ এবং পক্ষপাতদুষ্ট বিচার ছিল না । যেখানে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব শিশুরাই সমান স্বাধীনতা নিয়ে খেলাধুলা করেছে । যেখানে ছিল না ধর্মগত বিদ্বেষ, ছিল না ভাষাগত এবং জাতিগত কোন বিভেদ, ছিল না 'বিদেশি ', 'বহিরাগত ' আর 'ডি' ভোটারের শনাক্তকরণ। হিন্দু -মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃস্টান, বাঙালি -অসমিয়া, উপজাতি -অনুপজাতি সেখানে পাশাপাশি বাস করেছে সম্প্রীতি নিয়ে । এক ধর্মের প্রতি আরেক ধর্মের মূলগত বিভেদ থাকলেও, মানসিক বা আত্মিক কোনো বিদ্বেষ ছিল না । তাই তো, রহিম চাচা  আর রমেশ কাকারা একই হুঁকোয় তামাক টেনেছেন, একে অপরের সুখে -দুঃখে পাশে এসে অংশীদার হয়েছেন। সেখানে সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনি একাকার হয়ে মিশে যেতো গীর্জার ঘন্টা ও আজানের সুমধুর ধ্বনিতে। যেখানে সব ধর্মের ছাত্র-ছাত্রছাত্রীরা একই সুরে পড়তো :-

" মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রং

মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা বাজলো ঠং ঠং ।।" ( রবীন্দ্রনাথ )


আবার একই নিষ্ঠা নিয়ে পড়তো,--
'কি মধুর আজানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর,বাজিল কি সুমধুর,
আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী'। ( কায়কোবাদ)

পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একই সুরে গেয়েছে--

'শঙ্খ বাজে' মোর চিত্ত মাঝে
চির নূতনের দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ ।।'.... (রবীন্দ্রনাথ )


কৈ, কারও জিহ্বা তো ধর্মীয় সংস্কারে আড়ষ্ঠ হয়ে যায় নি? আজ কোথায় হারিয়ে গেল সেই দেশ? আজ কেন ' মন্দির ' উচ্চারণে, ' শঙ্খ ' উচ্চারণে ধর্ম নাশের ভয় ? স্বাধীনতার ঘুর্ণিঝড়ে  সব ওলোটপালট হয়ে গেল; দেশ হয়ে গেল খান খান । শুধু দেশই ভাঙল না; ভেঙে চুরমার হয়ে গেল মানুষের এতকালের আত্মিক সম্পর্ক! প্রতিবেশী ভুলে গেল এতকালের বংশ পরম্পরা ঘনিষ্ঠতার কথা; কসাই হতে সময় লাগল না! এক নিমেষের এক-একটা ঘটনায় মানুষকে পৌঁছে দিল পশুত্বে!' পালাও! যে দিকে পারো পালাও'! প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটলো বাঙালি হিন্দুরা হিন্দুস্তানের দিকে; একমাত্র আশ্রয়! পেছনে পড়ে রইল চৌদ্দপুরুষের  ভিটেমাটি, খেত খামার, পড়ে রইল গরু বাছুর গৃহস্থালি। কী ছিল ওদের অপরাধ? দেশ ভাগ যাঁরা করেছিলেন, পরাধীন অখণ্ড ভারতবর্ষের নেতৃত্ব যাঁদের হাতে ছিল, দেশের তৎকালীন সেই কর্ণধারেরা কি একবারও ভেবেছিলেন পূর্ববঙ্গের ওইসব দুর্ভাগা হিন্দুদের কথা? কোথায় ছিল তাঁদের দূরদর্শিতা? তাঁরা একবারও কি ভেবেছিলেন দেশ ভাগের ফলে এমন সর্বনাশা সাম্প্রদায়িক জিঘাংসার শিকার হবে নির্দোষ এই বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় ? স্বাধীনতা সংগ্রামে পূর্ববঙ্গের যে হিন্দু বাঙালিরা একদিন জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের সন্তান-সন্ততিরাও আজ দেশবিভাগের বলি;তাঁরাও পেলো না ভারতীয়ের মান; তাঁরাও আজ বহিরাগতের তালিকায়। তাঁদের অপরাধ, দেশভাগের ফলে তাঁদের জন্মমাটি পাকিস্তানে পড়ে গেছে; এ দেশে যাঁদের পরিচয় আজ ' উদ্বাস্তু ', শরণার্থী, বহিরাগত, বিদেশি, বাংলাদেশি, ' ডখার' ইত্যাদি মুখরোচক শব্দ; এবং সর্বশেষ অসমে ' ডি ভোটার '! তাঁদের এতকালের বংশপরম্পরা সম্ভ্রান্ত পরিচয় নস্যাৎ হয়ে গেল স্বাধীনতার ঘুর্ণিঝড়ে! পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে যারা ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি ছেড়ে, শুধু প্রাণ হাতে নিয়ে ভারতের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিল; নেহরু সরকার বিনা শর্তেই যাঁদের স্থায়ী আশ্রয় দিয়েছিলেন ভারতের মাটিতে; ওঁরা তিনপুরুষ ভারতের মাটিতে বসবাস করেও আজ পর্যন্ত ' ভারতীয় ' হতে পারল না । তাঁদের অনেকেই আজ কারাবন্দি ' ডি ভোটার ' পরিচয়ে।

যে শ্রীহট্ট জেলা একদিন ছিল অসমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যে শ্রীহট্ট বাসীর অকুন্ঠ অবদানে অসম একদিন হয়েছিল সমৃদ্ধ; সেই সোনার দেশ শ্রীহট্ট  রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, জাল গণভোটের চক্রান্তে বিক্ষিপ্ত হল পাকিস্তানে; তখন বিক্ষুব্ধ শ্রীহট্টবাসী অমুসলিমদের কাতর ক্রন্দন কি পৌঁছয়নি তৎকালীন তাবড় তাবড় দেশ নেতাদের কানে? অসম প্রদেশকে যারা মাতৃভূমি বলে জানতো, তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল অসমের মানচিত্র থেকে; কি ছিল তাঁদের অপরাধ? রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থপরতা, অদূরদর্শিতা এবং অবিমৃষ্যকারিতার বিশেষ বলি হয়েছিল সেদিনের অখণ্ড ভারতের শ্রীহট্টবাসী বাঙালি হিন্দুরা । তারপর, ১৯৫০ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়ে সেই শ্রীহট্টবাসী হিন্দুরা যদি প্রাণের দায়ে নিকটতম অসমের আশ্রয়প্রার্থী হয়ে থাকে, তা কি অমার্জনীয় অপরাধ?  যে অসমকে ওরা দ্বিতীয় মাতৃভূমি বলে গ্রহণ করেছিল, সেই অসমেই আজ ওরা ' ডি' ভোটার । ওদের জেলে পাঠানো হচ্ছে । এনআরসি-র তদন্তে তাঁদের চৌদ্দপুরুষের তালিকার পর্যবেক্ষণে ওরা ক্ষতবিক্ষত! দেশ ভাগের অনেক আগের থেকেই যারা অসমে বসবাস করে আসছে, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাথুরে অনুর্বর পতিত জমিকে করেছিল সুফলা, শস্যশ্যামলা সেই বাঙালিরাও আজ বহিরাগত আখ্যাপ্রাপ্ত ! তাহলে  অসমের প্রকৃত ভূমিপুত্র কারা?

তাই তো , স্বাধীনতা লাভের আনন্দ যতটুকু, বঞ্চনার বেদনা, দুঃখ তার শতগুণ বেশি । পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা, যারা প্রথম দাঙ্গার পরেও, দেশের মাটির মায়া কাটাতে পারেনি, নেহরু লিয়াকৎ চুক্তির পর যারা নতুন আশায় বুক বেঁধে আবার মন বসিয়েছিলেন, একটা সময় তাঁরাও বাধ্য হল দেশ ছাড়তে; কারণ ধর্ষণ এবং ধর্মান্তরিত করার ভয় ;প্রাণের ভয় তো ছিলই ।

তখন দেশ ছেড়ে আসা ছাড়া আরা কোনও গত্যন্তর তাঁদের ছিল না; অথচ এখানে পেলো অমানুষিক ব্যবহার, এবং সেটাই হল আইনসঙ্গত! তাহলে ওঁরা কোথায় যাবে? এমন স্বাধীনতা তো আমাদের পূর্বপুরুষের কাম্য ছিল না । আজও চলছে 'ডি '-ভোটার আর ডিটেনশন ক্যাম্প! স্বাধীনতার ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে গেছে আমাদের দেশ,হারিয়ে গেছে জাতীয় বন্ধন,হারিয়ে গেছে আমাদের পরম্পরা । তাই তো স্বাধীনতা দিবস আমার কাছে আসে এক তিক্ততার দুঃসহ বেদনা নিয়ে, স্মৃতিভারে জর্জরিত হই, আবার শৈশবের ফেলে আসা অনাবিল আনন্দময় দিনগুলোর মাধুরিমায় কখনো  মন ভরে ওঠে, ভাবি,সার্থক হবে কি কোনওদিন কবিগুরুর প্রকৃত স্বাধীন দেশের স্বপ্ন .......


'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির'.....

Where the mind is without fear,
and the head is held high'.

 (লেখিকা শিলংয়ের গভৰ্নমেন্ট গাৰ্লস হাইস্কুলের প্ৰাক্তন প্ৰধান শিক্ষিকা )

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.