Header Ads

মুকুল-শুভেন্দু-ই বড় ফ্যাক্টর একুশের নির্বাচনে !! (১)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

যাঁরা ভাবছেন আগামী ৮-৯ মাসের মধ্যেই নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়তে চলেছে তাদের ভাবনা ঠিক পথে চলছে না। কারণ, পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষাপট থেকে যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাতে প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে একুশের নির্বাচন একুশেই হবে তবে তা নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কয়েক মাস পরে অর্থাৎ একুশের নভেম্বরে এবং তা হবে রাষ্ট্রপতি শাসনেই।

করোনা প্রকোপের জের আগামী ৮-৯ মাসে ততটা কমবে না যতটা কমলে গায়ে গা লাগিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়া যায়, বদ্ধ ঘরে বহু মানুষের জমায়েতে ভোট গণনা করা যায়, ঘরে ঘরে দল বেঁধে প্রচারে যাওয়া যায়, মিটিং-মিছিলে বড়সড় জমায়েতের আয়োজন করা যায়। এসব করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না বলেই মনে করছেন চিকিৎসক গবেষকরাই। কেন্দ্র এবং নির্বাচন কমিশন করোনাকে সামনে রেখেই নির্বাচন পিছিয়ে দেবে শুধু বাংলারই নয়--বিহার-আসামেরও। রাষ্ট্রপতি শাসনে নির্বাচন মেনে নেওয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সম্ভব হবে না--তিনি প্রতিবাদে হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টেও যাবেন। কিন্তু সেখানে বিশেষ কিছু ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে বলে মনে
হয় না।
নির্বাচন পিছিয়ে গেলে (রাজ্যপাল তো এ ব্যাপারে কেন্দ্রকে সমর্থন জানাতে তৈরি থাকছেন-ই) এবং রাষ্ট্রপতি শাসনে হলে ঘোরতর সঙ্কটে পড়ে যাবে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দল। করোনা’র কারণে নির্বাচন পিছিয়ে গেলে মানুষ খুব একটা অখুশি হবে না--ফলে রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে নির্বাচন করলে জনমনে সিমপ্যাথি’র যে ঝড় ওঠার সম্ভাবনা থাকে এক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যাবে না। রাজ্যে করোনা প্রকোপের যে চেহারা ক্রমশঃ ফুটে উঠছে তাতে এর জের বা প্রতিক্রিয়া খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে না। ফলে ৮-৯ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা রাজ্যপাল-কেন্দ্র এবং নির্বাচন কমিশনার ভাববেন না বলেই নানা সূত্রে সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে।
আগামী বিধানসভা নির্বাচনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে চলেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের শুভেন্দু অধিকারী এবং বিজেপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুকুল রায়। আগে মুকুলের কথায় আসা যাক।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে গোটা ভারতকে চমকে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর বিজেপি দল বিপুল জনসমর্থন পেয়ে যখন ক্ষমতাসীন হয় তখন মুকুল তৃণমূলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বিজেপির মোকাবেলা যে ভাবে করেছেন তাতে বিজেপি দাঁত ফোটাতে পারে নি। মাত্র দুটি আসনে (প্রকৃত পক্ষে একটিই বলা যায়, দার্জিলিং তো গুরুংয়ের দয়ার দান ছিল) বিজেপি জয় পায়। তার দু-বছর পরে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনেও মুকুল তৃণমূলের নির্বাচনী ম্যানেজার হিসেবে বিজেপিকে যে ভাবে ঠেকিয়েছিলেন তাতে বিজেপি’র বুঝতে অসুবিধে হয় নি--বাংলার মাটি প্রকৃতপক্ষে বিজেপি’র মাটি নয়। ফলে ২০১৬ সালেও তৃণমূল বিপুল জয়ের পথে ক্ষমতাসীন হয় দ্বিতীয়বারের জন্য।
কিন্তু এই জয়ে ক্ষমতাসীন দলের দেমাক ও আত্মতুষ্টি এতটাই বেড়ে গেল যে তারা মুকুলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত হাল্কাভাবেই দেখতে শুরু করে দিল। একাংশের মধ্যে মুকুলকে নিয়ে রীতিমতো নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিল। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণেও মুকুলকে হেয় করা উপেক্ষা করা এবং কোণঠাসা করে ফেলার বিস্ময়কর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। তখন মাঝে মাঝেই শোনা যেত--ব্যক্তি নয় দল-ই সব কিছুর উর্দ্ধে। অর্থাৎ দলে মুকুলের থাকা না থাকা নিয়ে কারুর কোনো মাথাব্যথা নেই ! অপমান উপেক্ষা সহ্য করেও দলে শেষপর্যন্ত টিকতে পারলেন না মুকুল। আত্মসম্মান রক্ষার তাগিতে দল ছেড়ে বেড়িয়ে এলেন। যতক্ষণ দলে ছিলেন ততক্ষণ তিনি দলের নিষ্কলঙ্ক সম্পদ ছিলেন--দল ছেড়ে বেড়িয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে হাজার হাজার অভিযোগ
উঠতে শুরু করল--প্রায় প্রতিমাসে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
হতে থাকলো। তিনি রাস্তায় নামলেই ‘‘জনরোষের’’ মধ্যে পড়তে
থাকলেন ! রাজ্যের মানুষ সব কিছুই দু’চোখ মেলে দেখছিল।
মুকুল তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর রাজ্যে যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয় তার মধ্যেই অশনি সঙ্কেত দেখতে পেয়েছিলেন বোধবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক মহল। তার পরে যে বৃহৎ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হল অর্থাৎ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন তাতেই মুকুল প্রমাণ করে দিলেন তাঁর রাজনৈতিক মেধার গুরুত্ব কতটা। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিজেপিতে বোলচাল সর্বস্ব সব নেতারাই ছিলেন--নরেন্ত্র মোদী-অমিত শাহ’ও ঘন ঘন ছুটে এসেছেন রাজ্যে বাংলাকে পাখির চোখ করে--তবু মুকুল বিহীন বিজেপি প্রায় খতম হয়ে যাওয়া সিপিএম-কংগ্রেসের ধারেকাছেও পৌঁছুতে পারে নি।
কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি মাত্র দু’টি আসন থেকে একেবারে ১৮’টি আসনের মালিক হয়ে গেল মুকুলকে পাওয়া মাত্র। এর একটাই কারণ, মুকুলের মতো বুথ ধরে ধরে ভোটের অঙ্ক কষার মতো একজন নেতাও বঙ্গ বিজেপিতে আগেও ছিল না--এখনও নেই। শুধু বিজেপিতেই কেন--তৃণমূলেও যে এই মাপের অঙ্ক কষে দলকে অনায়াসে জয় এনে দেওয়ার মতো কেউ নেই সেটা বুঝতে একটুও দেরি হয় নি বলেই তড়িঘড়ি দলকে বাঁচাতে বিহারি মগজকে বহুমূল্যের বিনিময়ে ভাড়া করে আনতে হল !
সিপিএমের অনিল বিশ্বাস দলীয় সদর দফতরে বসে বসে ঠিক এইমাপেরই অঙ্ক কষে কষে বার বার দলকে জিতিয়ে আনলেও ২০১১’র নির্বাচনে তারই কায়দায় অঙ্ক কষে তাঁকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মুকুল রায়। তারপর যতক্ষণ দলে ছিলেন ততক্ষণ তাঁর এই অঙ্কই তৃণমূলকে যে নিশ্চিন্ত রেখেছিল তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। সেই মুকুলকে পেয়ে বিজেপি কি করছে? স্রেফ ভোট রাজনীতিতে ব্যবহার করছে সারদা-নারদার কুমিরছানা দেখিয়ে--এটাই অনেকের বিশ্বাস। এর মধ্যে কিছুটা সত্যি থাকলেও সবটাই সত্যি নয়। কারণ, মুকুল-ই একমাত্র নেতা যিনি সিবিআই বা ইডি’র ডাককে এড়িয়ে চলার জন্যে কোনোরকম নাটকের আশ্রয় নেন নি। প্রত্যেকবার হাজির হয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এসেছেন এবং তিনি তো বটেই বিজেপিও জানে--সিবিআইয়ের চার্জশিটে মুকুলের নাম যুক্ত করার মতো জোরালো তথ্যাদি বিশেষ নেই। ফলে চার্জশিটে মুকুলের নাম না থাকার সম্ভাবনা যে ষোল আনা সে সম্পর্কে বিশেষ কারুর সন্দেহ নেই।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? সারদা-নারদা’র ভয়ে মুকুল বিজেপিতে পড়ে আছেন? না--একেবারেই তা নয়। গত বছর ঠিক আজকের দিনেই মুকুল রায়  আমরনাথ যাত্রায় গিয়ে অমরনাথের পুজো দিয়ে বলেছিলেন, বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে উৎখাত করার পর আবার এখানে এসে পুজো দিয়ে যাব। সুতরাং মুকুল রায় যে কোন পরিস্থিতিতেই তৃণমূলে ফিরছেন না এটা কোনোরকম সংশয় না রেখেই বলা যায়।
তাহলে মুকুল রায়ের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ কি? তাঁর একমাত্র লক্ষ্য তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করা। তার জন্যে বিজেপি’র মতো একটা রাজনৈতিক মঞ্চ তাঁর দরকার--কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি রাজনৈতিক মেধা বন্ধক রেখেই বিজেপিতে থাকবেন। তাঁর লক্ষ্যপূরণে তিনি যে সহায়তা বিজেপি’র দিক থেকে চান তা না  পেলে তিনি বিজেপি থেকেও বেরিয়ে আসতে পারেন--এমনই শরীরি ভাষা তাঁর সাম্প্রতিক চেহারাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছ্। তাঁর রাজনৈতিক তথা ভোট-গণিতের ওপর বিজেপিকে আস্থা রাখতে হবে--এটাই মুকুল চান। পাশাপাশি এমন একটা সম্মানজনক পদও তাঁর দরকার যার কারণে তিনি রাজ্যের সর্বত্র নির্বিরোধ ঘোরাঘুরি করতে পারেন। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিতে পারেন এবং সে সব ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসন বা পুলিশ যেন তাঁকে বাধা দিতে না পারে। এটা স্পষ্ট করে বোঝাতেই তিনি দিল্লির বৈঠক ছেড়ে শুক্রবারেই কলকতা ফিরে এসেছেন ‘চোখ দেখানো’র কথা বলে। তিনি এ-ও বলেছেন, দিল্লির বৈঠক কতদিন চলবে তিনি তা জানতেন না ! ঠিক উল্টো কথা বলেছেন দিলীপ ঘোষ--তিনি বলেছেন যাদের ডাকা হয়েছিল তারা সবাই জানেন (অর্থাৎ মুকুলও জানতেন)। তবু মুকুল কেন তড়িঘড়ি ফিরে এলেন কলকাতায়? কারণ, তিনি প্রথম দিনের আলোচনায় বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গণিতকে উপেক্ষা করা হচ্ছে ! বিজেপি কর্তারা যেসব অঙ্ক কষছেন তার মধ্যে রিয়েলিটির কোনো সম্পর্ক নেই। ১৯০ আসনে তাদের জয়ের নিশ্চয়তার ভিত্তি যে স্রেফ আবেগ ও আত্মতুষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয় সেটা তিনি বোঝাবার চেষ্টা করেও সফল হন নি। ফলে তাঁকে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়েছে। এক অলৌকিক ঝড়ে তাঁর দিল্লির বাড়িময় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ’র যেসব ছবি ফেস্টুন ফ্লেক্স ছিল সে সবও উড়ে গেছে !
তবু তিনি আজ কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠকে বললেন--‘আমি বিজেপিতেই আছি বিজেপিতেই থাকবো, অন্য কোথাও যাচ্ছি না। আমার ছেড়ে আসা দলে আমার ফেরা নিয়ে যে জল্পনা তৈরি হচ্ছে তা একটা চক্রান্ত ছাড়া কিছুই নয়। এটা আমাকে ব্যথিত করেছে !’--এমনটাই তিনি বলবেন ততদিন যতদিন পর্যন্ত না তাঁর ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারছেন। নির্বাচনের এখনও বেশ কিছুটা সময় হাতে পাচ্ছেন তিনি। যে কোনো মুহূর্তে  বিজেপি ছেড়ে নতুন কোনো বিকল্প গঠনে একক বা যৌথ উদ্যোগে সক্রিয় হতে পারেন। কারণ, মুকুল জানেন, সারদা-নারদা’র কুমির ছানা দেখিয়ে তাঁকে ধরে রাখা যাবে না। সে চেষ্টা করলে বিজেপি’র কৌশলী ব্ল্যাকমেলিংয়ের রাজনীতি বিচ্ছিরিভাবে এক্সপোজ হয়ে যাবে এবং তার মারাত্মক নেতিবাচক প্রতক্রিয়া দেখা দেবে ভোটের ফলে।
এই সত্যিটা কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ বুঝতে পারছেন বলেই ২৪ ঘন্টা যেতে না যেতেই মুকুলকে দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়েছে। আমার যতদূর ধারণা আগস্টের মধ্যেই মুকুলকে বিজেপিতে ধরে রাখার জন্যে বিশেষ কিছু ঘোষণা করা হতে পারে। কারণ, মুকুল ছাড়া বিজেপি’র বাংলা জয়ের স্বপ্ন একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলার মাটিতে। অরবিন্দ মেনন বা দিলীপ ঘোষ এবং তাদের সঙ্ঘসতীর্থদের ক্ষমতা হবে না তৃণমূলকে উৎখাত করে বাংলার শাসন ক্ষমতা অর্জনের। মুকুল তাই বিজেপি’র জন্যে যতটা প্রয়োজনীয় ঠিক ততটাই আশঙ্কার তৃণমূলের জন্যে। কিন্তু যদি নতুন কোনো বিকল্পের জন্ম হয় মুকুলের হাত ধরে তাহলে? পরবর্তীতে এ প্রসঙ্গে আসা যাবে। আগামীকাল তার আগে শুভেন্দু প্রসঙ্গে আলোচনায় যেতে হবে।
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.