Header Ads

প্রসঙ্গ : একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র সরকার গঠনের সম্ভাবনা কতটা !! (৪)

 বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
সল্টলেকে মুকুল রায় ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’র জন্যে নতুন অফিস খোলার বিষয়টাকে কেন্দ্র করে কিন্তু বঙ্গ বিজেপি তো বটেই ক্ষমতাসীন তৃণমূলের অন্দরেও জল্পনা শুরু হয়ে গেছে। একটা ব্যাপার অবশ্য স্পষ্ট হয়ে গেছে--মুকুল যাতে তাঁর প্ল্যানমাফিক কাজকর্ম কোনোরকম  অবাঞ্ছিত নাকগলানোর বাইরে থেকে করতে পারেন তার জন্যেই তাঁকে পৃথক করে দেওয়া হচ্ছে।

অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদী জানেন, তৃণমূলকে ভেতর থেকে দুর্বল করতে হলে মুকুল ছাড়া গতি নেই। তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুকুল-ই হলেন সেই অস্ত্র যাকে ব্যবহার করেই বিজেপি বাংলায় পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারছে। মুকুলের কাছাকাছি থাকবেন অমিত শাহ--যিনি মুকুলের পরিকল্পনার বাস্তবতা  ঠিকঠাক বুঝে নিয়েই মুকুলকে সবুজ সঙ্কেত দেবেন। এক কথায় বলতে গেলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মুকুলই হলেন বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতের ট্রাম্পকার্ড।
ইতিমধ্যেই মুকুলের কাজ অনেকটাই সেরে রেখেছেন তৃণমূলের দলীয় শুদ্ধিকরণের প্রবক্তা প্রশান্ত কিশোর। তাঁর টিম এমন সব দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের তালিকা তৈরি করে ফেলেছে যাদের দু’দিন আগেও ঠিকমতো খাওয়া জুটতো না কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কোটিপতি হয়ে গেছেন বলে মনে করছেন পিকে স্বয়ং ! আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তাদের টিকিট দেওয়ার ব্যাপারেও স্পষ্ট আপত্তি রয়েছে পিকে’র। ফলে চমকপ্রদ বেশ কয়েকটি কর্মসূচী নিয়ে সাড়া জাগালেও শুদ্ধিকরণ বলতে যা বোঝায় তার কতটা কি হল সেটা বোঝা না গেলেও দলের বিভিন্ন স্তরে অসংখ্য ফাটল  তৈরি হয়ে গেছে। যারা নানান সূত্রে খবরাখবর নিয়ে মোটামুটি টিকিট না পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছেন তারা মাস ছয়েক আগে থেকেই বিজেপি’র  ‘ট্রাম্পকার্ডের’ সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। এদের একটা বড় অংশ লোকসভা নির্বাচনের আগের মতোই বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্ মুহূর্তে বিজেপিতে নাম লেখাবেন এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধেই প্রার্থী হবেন। মাঝে মাঝে মুকুল রায় এবং দিলীপ ঘোষ জানাতে ভোলেন না যে তৃণমূলের ৫০ থেকে ১০০ জন বিধায়ক দলত্যাগ করে বিজেপিতে আসার জন্যে মুখিয়ে রয়েছেন ! তাঁদের এ দাবি কতটা সত্যি তা জানা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে, মুকুলের হাত ধরে দু’তিনজন দলীয় দাপুটে প্রভাবশালী সহ বেশ কিছু বিধায়ক বিজেপিতে নাম লেখানোর জন্যে তৈরি হয়ে আছেন। এই মুহূর্তে এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও  (লোকসভা নির্বাচনের আগেও অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল) ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে গিয়ে তা আর মনে হবে না।
তার মানে অবশ্য এই নয় যে, মুকুল একাই বিজেপিকে ডাঙ্গায় তুলে দেবেন। মুকুলের কাজ মুকুলকে করতে দিয়ে গোটা দলটাকে অত্যন্ত সুসংহতভাবেই মাঠে নামাতে হবে দিলীপ ঘোষকেই। বাংলার ভোটাররা যে রাজনৈতিক ভাষা বোঝেন--যে শালীনতা কৃষ্টি সংষ্কৃতি বাংলার ভোটাররা নেতাদের চালচলনে আচার ব্যবহারে প্রতিফলিত হতে দেখতে চান ঠিক সেইভাবেই ভোটারদের কাছে দিলীপবাবুদের  যেতে হবে। দলের আনাচে কানাচে প্রচুর গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জন্ম হয়েছে আদি ও নব্য বিজেপি’র মধ্যে--ঠিক তৃণমূলেরই মতো--এই বিষাক্ত খেয়োখেয়ির রাজনীতি থেকে দিলীপবাবুরা যদি দলকে মুক্ত রাখতে পারেন তাহলে তৃণমূলকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। সায়ন্তনী বচন রাহুলি প্রগলভতা যদি আরাবুল-অনুব্রত লাইনকে ফলো করে তাহলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি। বাংলায় ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গোবলয়ের রাজ্যগুলির মতো এ রাজ্যের মানুষ গোগ্রাসে গেলে না। ক্ষমতাসীন দলের বাড়াবাড়ি রকমের সংখ্যালঘু  তোষণের রাজনীতিও যে ভোটাররা আর পছন্দ করছে না তা গত লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যলঘু অধ্যুষিত এলাকার ফলাফলেই মারাত্মকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ঐসব এলাকায় সংখ্যাগুরু ভোট বহুমুখী হয় নি--কিন্তু সংখ্যালঘু ভোট বহু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও তেমনটাই দেখা যেতে পারে যদি না ক্ষমতাসীন দল সমতা রক্ষার রজনীতিতে ফিরে আসার কথা ভাবে।
আকস্মিকভাবে করোনার প্রাদুর্ভাব এবং তৎসংক্রান্ত সরকারি প্রশাসনের নানাবিধ গাফিলতি ব্যর্থতা এবং পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যায় চূড়ান্ত নাজেহাল পরিস্থিতির ওপর আম্ফান নিয়ে জেরবার সরকারের অসংখ্য দুর্বলতা প্রতিপক্ষের হাতে বহু সুযোগ তুলে দিয়েছে। ত্রাণ ও রেশন দুর্নীতিই তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটা উদ্বেগজনক আবহ গড়ে দিয়েছে জনমনে--বিজেপি এইসব দুর্নীতি ও সরকারি ব্যর্থতাকে কী ভাবে ব্যবহার করতে পারে সেটাই এখন দেখার। রাজ্যের গোটা পরিস্থিতিটা খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখে এটা বলাই যায় বিজেপি’র সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে সব নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার ধাক্কা সামলানোর পাশাপাশি একেবারে চূড়ান্ত মুহূর্তে  দলের ভাঙন যে গহ্বর তৈরি করবে তা ভরাটের জন্যে মা-মানুষ কতটা মাটি সরবরাহ করতে পারবে তার ওপরই নির্ভর করবে ফলাফল। আমি আমার বিভিন্ন বিশ্লেষণে বার বার বলে এসেছি--প্রশান্ত কিশোর তৃণমূলকে বিভিন্ন চমকপ্রদ কর্মসূচীর মাধ্যমে দলকে শুদ্ধ করে রক্ষা করার চেষ্টা করতে গিয়ে দলের ভেতরের ব্যাপক দুর্নীতি (কাটমানি, তোলাবাজি, সিণ্ডিকেটবাজি, প্রমোটারি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব) প্রকাশ্যে নিয়ে এসে বিরোধীদের দুর্নীতির অভিযোগকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন--এর ফলে দলের প্রায় সর্বস্তরে নানান ধরণের অসন্তোষ ক্ষোভ হতাশা অনিশ্চয়তা এবং উদ্বেগের জন্ম হয়েছে। পিকে’র এই কর্পোরেট মগজ গোটা দলটাকেই শুধু ভেতরে ভেতরে নড়বড়ে করে দেয় নি--দলের সুপ্রিমোর প্রতি এতদিনকার তর্কাতীত আস্থাতেও কোথাও যেন ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে ইন্দিরা গান্ধী-সঞ্জয় গান্ধী এপিসোডের কথা। তবে আমি ঠিক এই মুহূর্তে বলতে পারছি না--এটা বিশেষ কোনো চক্রের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কিনা ! বিধানসভা নির্বাচনের টিকিট বন্টন ও প্রার্থী মনোনয়নের মুহূর্তে এটা স্পষ্ট হতে পারে বলে আমার ধারণা। এই গোটা পরিস্থিতিটা সম্যক উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতা মুকুল রায় ছাড়া আর কোনো বিজেপি নেতার নেই। মুকুল রায়-ই একমাত্র জানেন এই পরিস্থিতির সুযোগ কোন পথে কী ভাবে নেওয়া সম্ভব। মুকুলকে আর কেউ চিনুক না চিনুক তৃণমূল সুপ্রিমো ১০০% চেনেন--তাই তাঁর  দুশ্চিন্তা বিজেপিকে নিয়ে ততটা নয় যতটা মুকুল রায়কে
নিয়ে !
গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যে ১৮-টি আসন দখল করেছিল তার মধ্যে যে ১২৬-টি বিধানসভার আসন রয়েছে তার মধ্যে ৩৬-টি বিধানসভায় বিজেপি এই মুহূর্তে বেশ ভাল জায়গায় রয়েছে এবং আরও ১৮-টি আসনে তুল্যমূল্য অবস্থায় রয়েছে বলা যায়। অর্থাৎ এই মুহূর্তে ৩৬ থেকে ৫৪-টি আসনে বিজেপির সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। পাশাপাশি আরও গোটা পঞ্চাশেক আসনে বিজেপি তৃণমূলের ঘাড়ে রীতিমতো উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলছে। যত দিন যাবে পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই অনেকটাই বদলে যাবে। পরিস্থিতির বদলটা কে কার পক্ষে টানতে পারে সেটা এত তাড়াতাড়ি বলা কঠিন। যাইহোক,  আসনগুলো এখনই চিহ্নিত করছি না আমি--সময়মতো বলবো। প্রসঙ্গতঃ আর একটা কথাও বলে রাখা ভাল--আগামী নির্বাচনে সিপিএম-কংগ্রেস পৃথকভাবেই হোক বা জোটবদ্ধভাবেই হোক বিজেপি’র যতটা না সমস্যা তৈরি করবে তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যা তৈরি করবে তৃণমূল কংগ্রেসের। এই দুই দল বা এই দুই দলের জোট বহু আসনে তৃণমূলের বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে পারে।
এই সম্ভাবনাটাকে আরও অনেকটাই বাড়াতে চান অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী। মাইনাস মুকুল ও প্লাস মুকুল বিজেপি’র চেহারাটা ঠিক কি রকম তা এই দুই ধুরন্ধর রাজনীতিকের পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গেছে বলেই মুকুলের জন্যে তাঁরা বিশেষ আয়োজন করেছেন। মুকুলের পাশেই থাকছেন অমিত শাহ । স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যাতে মুকুলকে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয় তার জন্যেই  দলের সদর দফতর থেকে মুকুলকে বিচ্ছিন্ন করে বেশ খানিকটা দূরে নিজের নজরদারির মধ্যে রেখেই মুকল-অস্ত্রের সুচারু ব্যবহার করতে চান অমিত শাহ নিজে। ফলাফল কী দাঁড়ায় সেটা নিয়েই এখন জোরদার বিশ্লেষণ চলবে।
তবে এটা আমি জোর গলায় দাবি করতে পারি--আমার এই দীর্ঘ বিশ্লেষণকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে কেউ খণ্ডন করতে এগিয়ে আসবেন বলে মনে হয় না ! আমার এই প্রতিবেদনের একটি লাইনও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা খুব সহজ হবে বলে কি মনে হয় আমার বন্ধুদের? আমার এই প্রতিবেদন শুধু বিজেপি নেতারাই নন--তৃণমূলের নেতারাও যদি মন দিয়ে পড়েন তাহলে অনেক রাস্তার সন্ধান তাঁরা পাবেন--এ দাবি আমি করতেই পারি !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.