Header Ads

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে !! (৩)

 বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
আমাদের মতো ক্ষুদ্রবুদ্ধির সামান্য লোকেরা সত্যি সত্যি কল্পনা করতে পারি নি--মমতার নেতৃত্বাধীন একটি দীর্ঘকালীন অচলায়তনকে প্রবল ধাক্কায় শুইয়ে দেওয়া রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের সিংহভাগ নেতাকর্মী রাজনীতি বলতে কাটমানি-তোলাবাজি-সিণ্ডিকেটরাজ-প্রোমোটারি-নিয়োগপত্রের নিলামী-সরকারি প্রকল্পের টাকা লুট-ত্রাণের টাকা লুট-নির্লজ্জ স্বজন পোষণকেই বুঝবেন। দলের সিংহভাগ নেতাকর্মীর এই আত্মঘাতী ‘‘রাজনৈতিক চেতনা’’ যত দ্রুত গতিতে বিকশিত হয়েছে ততই নেত্রীর উদ্বেগের পারদ হু-হু করে চড়ে গেছে এমন একটা জায়গায় যেখান থেকে তিনি অনেকটাই বাধ্য হয়ে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষে দলের সর্বস্তরের দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশ্য মঞ্চে দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকিও দিয়েছেন মাঝে মাঝেই--কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া যে সম্ভব হচ্ছে না সেটা রাজ্যের মানুষ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ব্যবস্থা নিতে গেলেই চেইন সিস্টেমে যুক্ত থাকা এমন অসংখ্য তথাকথিত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হয়--নিলে দলটাই আর অখণ্ড থাকার নিশ্চয়তা থাকে না। কারণ, হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গার মতো প্রচুর হাঁড়ি তাদের থলিতে রাখা আছে !

মাঝে মাঝে দলীয় শুদ্ধিকরণের নামে জেলায় জেলায় সাংগঠনিক রদবদল (পুরনো নেতাকর্মীদের অপমান হেনস্থা করে কোণঠাসা করে দিয়ে নব্যদের প্রাধান্য দিয়ে) যা করা হয় তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন নাটক ছাড়া অন্য কিছু মনে করতে পারে না। কিছু সাংগঠনিক পদে রদবদল করা হয় বটে তবে, যাদের গুরুত্ব দেওয়া হয় তারাও কর্তাভজা সাংগঠনিক দিক থেকে একেবারেই প্রভাবপ্রতিপত্তি হীন দুর্বল কিন্তু গোষ্ঠীরাজনীতির এক একজন রুই-কাৎলা। লুটেপুটে চেটেচুটে খাওয়ার ‘‘চৈতন্যশ্রী’’ গোষ্ঠীবাজদেরই (যারা প্রয়োজনে অন্তর্ঘাত করতেও দু’বার ভাবে না) ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পদস্থ করার ফলে সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে হতে আজ এমন একটা জায়গায় এসে  পৌঁছিয়েছে যে তৃণমূলের অসীম দাপটের রাজ্য এই বাংলায় একটা আধটা নয়--১৮-টি আসন কেড়ে নিল বিজেপি ! কিন্তু সংগঠনের জোরে নয়--সন্ত্রাসের জোরে নয়--ইভিএমের কারচুপির জোরেও নয়--দলের প্রতি বিশ্বাস হারানো আস্থা হারানো ক্রুদ্ধ বিরক্ত মানুষ কোন বিকল্প দেখতে না পেয়ে বিজেপিকেই ভোট দিয়ে তৃণমূলকে একটা বড়সড় শিক্ষা দিতে চেয়েছে শেষপর্যন্ত ! আসন হারানোর এই সংখ্যাটা ২৮ থেকে ৩০-ও হতে পারতো বলে বেশ স্পষ্টভাবেই বুঝতে অসুবিধে হয় নি কারুর।

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল এই চূড়ান্ত লাল সঙ্কেতের পরেও কি দুর্বিনীত দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের একাংশ প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে পেরেছে? কমেছে তাদের বেপরোয়া লুণ্ঠন মানসিকতা? ঔদ্ধত্য পেশীআস্ফালন শালীনতাবর্জিত মেধাহীন প্রগলভতা? চোখে পড়ছে কারুর? মানুষের বিরক্তি ক্রোধ কমছে এতটুকুও? কমছে না--তার কারণ, দুর্বার দুর্নীতিকেও ‘ছোটখাট ভুল’ বলে তা নিয়ে ‘রাজনীতি’ না করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ! সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন উঠছে--তাহলে রাজনীতি করার এক চেটিয়া অধিকার থাকছে কার? বিরোধীরা চোখের সামনে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত মানুষের মাথার ওপরের সামান্য ত্রিপলটুকুও কেড়ে নেওয়ার--মুখের অন্নটুকুও লুটে নেওয়ার--ত্রাণের সামান্য আর্থিক প্রাপ্যটুকুও ছিনিয়ে নেওয়ার হাজারো ঘটনা দেখেও রাজনীতি করবে না? মুখে আঙুল পুরে চুপচাপ বসে থাকবে? দুর্নীতি ঢাকতে বিরোধীদের কাঠগড়ায় তোলার রাজনীতি মিডিয়া এবং অন্ধ সমর্থকদের পেটপুরে খাওয়ানো গেলেও সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে খাওয়ানো যাবে? প্রকৃতপক্ষে তারা কি তা খাচ্ছে? পুঞ্জীভূত হচ্ছে না নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জেদ এবং সুযোগের জন্য অপেক্ষার মানসিকতা?
এসব যে দিকে দিকে হচ্ছে সেটা লোকসভায় বড়সড় অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খাওয়ার পর আর কেউ না বুঝুক দলের সুপ্রিমোর বুঝতে অসুবিধে হয় নি। চটকদার ডোল রাজনীতিতে, ক্লাব-অনুদানের রাজনীতিতে, বিচার বিবেচনা না করেই যাকে তাকে পারিতোষিক-রত্ন-ভূষণ-বিভূষণ বিতরণের রাজনীতিতে মানুষকে যে আর ভুলিয়ে আজ্ঞাবহ করে রাখা যাবে না বা যাচ্ছে না সেটা এখন অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শিক্ষিত যুবসমাজ চাইছে প্রতিবছর নিয়ম করে এসএসসি পরীক্ষা হোক--নির্ভেজাল ফলাফল প্রকাশিত হোক, কোনো ক্ষেত্রেই কোনো প্যানেল বা নিয়োগ তালিকায় নাম তোলার আগে নীলামে চড়ানোর জঘন্য সংস্কৃতির পরিবর্তন হোক, নিয়োগের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্লজ্জ স্বজনপোষণ এবং অমার্জনীয় বাণিজ্যবেসাতি বন্ধ হোক। এসব কিছুই হয় নি বা হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কারণ, যে দলের টিকিট পেতে পদ পেতে নির্দিষ্ট কোটা পূরণ করতে হয় বলে অভিযোগ সে দলে স্বচ্ছভাবমূর্তির নেতাকর্মীদের দেখা পাওয়া সম্ভব? নির্দিষ্ট কোটা পূরণের তাগিদেই কাটমানি-সিণ্ডিকেট-প্রেমোটারি-নিয়োগতালিকায় নাম তোলার বাণিজ্যবেসাতি থেকে যেখানে যতরকমের সুযোগ রয়েছে টাকা তোলার (বাড়ি দেওয়ার নামে টাকা, বিনামূল্যের রেশন, ত্রাণের টাকা সহ আরও অসংখ্য গলিঘুঁজি থেকে) বেপরোয়া উন্মত্ততা দিন দিন এতটাই বেড়ে গেছে যে--মানুষের কাছে আর বিন্দুমাত্র বিশ্বাসযোগ্যতা থাকছে না ! কোটা পূরণ করতে পারলেই উঁচু পদ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার চেয়ারম্যান এমন কী অধ্যক্ষ-উপাচার্য্য পদে বসতেও অসুবিধে হয় না। শিক্ষা নিয়ে হাসপাতাল নিয়ে রেশন নিয়ে পুর-পঞ্চায়েত-জেলা পরিষদ নিয়ে যে সব কাণ্ডকারখানা প্রকাশ্য দিবালোকে চলছে মানুষ তো সেসব দেখছে--লুকিয়ে রাখা তো যাচ্ছে না ! বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে না? বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার পুলিশের অবরোধে শ্বাসরুদ্ধকর  হয়ে উঠলেও ক্ষমতাসীন দলের চুনোপুঁটি থেকে ওপরমহলের কেষ্টবিষ্টুদের জন্যে অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় পুলিশের আত্মনিবেদন মানুষ দেখছে না?
দলের দুর্নীতি নিয়ে দলেরই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা-বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রী মুখ খুলে সত্যটা যেমন প্রকাশ করেছেন--তেমনই তাঁরা দলের মধ্যেই গদ্দার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে হয় কোণঠাসা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে শেষপর্যন্ত বসে গেছেন কিংবা দলত্যাগ করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন ! এসব তো চেপে রাখা যাচ্ছে না ! সদ্য সদ্য কোচবিহারের এক দলবদলু ‘বিশিষ্ট তৃণমূল বিধায়ক’ প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন চাকরি দেওয়ার নামে বাড়ি পাইয়ে দেওয়ার নামে যারা কোটি কোটি টাকা খেয়েছে তাদের পিঠের ছাল-চামড়া তুলে নেওয়া হবে রাজ্যপালের কাছে নেত্রীর পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ! কী মারাত্মক দাবি বা অভিযোগ--আমার যতদূর মনে পড়ছে আজপর্যন্ত কোনো ক্ষুব্ধ নেতা (মুকুল রায়-ও নয়) এইরকম তীব্র ঝাঁঝের সঙ্গে দলের বিরুদ্ধে কামান দেগেছেন বলে। দলীয় শীর্ষ স্তরে নিশ্চয়ই  এই ‘‘বিশিষ্ট অভিযোগ’’-এর সত্যতা এবং কার্য্যকারণ ছেঁড়াকাটা করে বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সরাসরি বহিষ্কারের কালচার এই দলে নেই। ফলে কতদূর কী হতে পারে তা নিয়ে দলের কিছু লোকজন ছাড়া বিশেষ কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। কড়া ব্যবস্থা নিতে গেলেই আরাবুল-অনুব্রত-জ্যোতিপ্রিয়-কল্যাণ থেকে উদয়ন পর্যন্ত সকলেই হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখেন বলেই এদের দাপট-বাচালতা-ঔদ্ধত্য কমার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। স্ব-স্ব পদে বহাল তবিয়তে সবাই দাপটের সঙ্গেই রাজনীতি করে যান। মানুষ সবই দেখে ও বোঝে। এখন তো পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল--দু-দিন পরে কে থাকবে কে অন্য ডালে গিয়ে বসবে সে সম্পর্কে দলের কাছে স্পষ্ট কোনো খবর নেই। ফলে সন্দেহের তালিকায় যারা গত প্রায় দু-বছর ধরে রয়েছেন তাদের সংখ্যা খুব কম নয়। কাকে তাড়িয়ে কাকে রাখা যায়--এই সিদ্ধান্ত গ্রহণও যথেষ্ট কঠিন হচ্ছে এখন !
এখানেই আলোচনায় আনতে হচ্ছে প্রশান্ত কিশোরকে। তাঁর কর্পোরেট মগজের প্রতিক্রিয়ায় দল কতটা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে বা আরও বিপাকে পড়েছে--সেই বিশ্লেষণের জন্যেই !
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.