অসমে বাঙালিদের স্বর্ণ যুগ, আজ শুধুই অতীত, স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া কিছুই নেই
অমল গুপ্ত, গুয়াহাটি : অসমের প্রায় ৫০ লক্ষ বাঙালি হিন্দুর বর্তমান অবস্থান খুবই নড়বড়ে।অনিশ্চিত জীবন। তাদের কোনো রাজনৈতিক দল নেই। বিজেপি, কংগ্রেস তাদের গুরুত্ব দেয় না। বামপন্থীরা তাদের গুরুত্ব দিত, কিন্তু সেই বাম দলগুলোর পায়ের তলার মাটি নেই। বরাক ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিদের কোনো বিশ্বাসযোগ্য নেতা নেই। প্রফুল্ল কুমার মহন্তের অগপ সরকারের আমলে একজনও বাঙালি বিধায়ক ছিলেন না। হিতেস্বর শইকিয়ার কংগ্রেস রাজত্বকে বাঙালিদের স্বর্ণ যুগ বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬-র এই সময়ে বিধানসভার অধ্যক্ষ পদে ছিলেন লামডিঙের দেবেশ চক্রবর্ত্তী, ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিলেন ডাক্তার অর্ধেন্দু কুমার দে, দুই প্রতিমন্ত্রী পদে ছিলেন বরাকের গৌতম রায় ও নিম্ন অসমের গোপী দাস। সেই সময় রাজ্যের মুখ্যসচিব, পুলিশ প্রধান, আই জি পি, অর্থসচিব সহকারি মুখ্যসচিব সহ একঝাঁক বাঙালি অফিসার সুচারুভাবে সরকার পরিচালনা করতেন। আজ বাঙালিদের সর্বত্র সন্দেহের চোখে দেখা হয়। হিতেস্বর শইকিয়া বাঙালিদের উন্নয়নে ভাষিক সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেছিলেন। তেজপুরের নৃপেন সাহাকে বোর্ডের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অগপ আমলে বোর্ড বাতিল করা হয়। পুনরায় তরুণ গগৈ কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে বোর্ড চালু করেন। বর্তমান বিজেপি সরকার তাদের সরকারের তিন বছর পর বোর্ড গঠনের কথা মনে পড়ে। বাজেটে সামান্য দু'চার পয়সা দিয়ে প্রাক্তন বিধায়ক অলক ঘোষকে চেয়ারম্যান পদে বসান। বিশ্ব কাঁপানো নেলি গণহত্যা কাণ্ডের পর হোজাইয়ে অসমের বাঙালি হিন্দু মুসলিম মিলেমিশে ইউনাইটেড মাইনোরিটি ফ্রন্ট বা ইউ এম এফ স্থাপন করে নির্বাচনে জয়লাভ করে বিধানসভাতে ১৭ টি আসন লাভ করেছিল। রাজ্যের বিশিষ্ট আইনজীবী কালিপদ সেন ইউ এমএফ-এর সভাপতি পদে ছিলেন। আর একজন বিশিষ্ট আইনজীবী গোলাম ওসমানী দলের সম্পাদক প্রদান ছিলেন। অসমের বাঙালি হিন্দু মুসলিমের উত্থান ভালো চোখে দেখেনি কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল। এক বিশ্বকর্মা পুজোর দিন রিহাবাড়ির নিজের বাড়িতে বাঙালিদের আইকন কালিপদ সেনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আজ বাঙালিদের কোনো নেতা নেই, অভিভাবক নেই। হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি অসমের বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে রাজনীতি করছে। নাগরিকত্ব সংশোধনীর নামে 'ডি' ভোটারের নামে, ডিটেনশন ক্যাম্পে নামে, এন আর সি চূড়ান্ত তালিকা তৈরির নামে বিজেপি সরকার বাঙালিদের হেনস্থা করেছে। হয়রানি করেছে, তার তুলনা মেলা ভার। সরকারের নথি বলছে ডিটেনশন ক্যাম্পে ২৭ জন মারা গেছে।এই বাঙালি হিন্দুরা গত নির্বাচনে বিজেপিকে হাত খুলে ভোট দিয়েছে। বিনিময়ে বরাকে কিছুই পাইনি। আবার ভোট আসছে। বাঙালি হিন্দুদের সমর্থন ছাড়া রাজ্যের ৪২ টি বিধানসভা কেন্দ্রে কোনো দলের প্রার্থী জয়লাভ করতে পারবে না। আগেও পারেনি। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে পাশ হলেও আজও আইন তৈরি হল না। ৬ মাসের মধ্যে আইন হতে লাগে। এন আর সি-র চূড়ান্ত থেকে ৮ থেকে ৯ লক্ষ বাঙালি হিন্দুর নামবাদ পড়েছে। লক্ষাধিক 'ডি' ভোটার ভোট দান সহ সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে। দেশ ভাগের বলি বাঙালিদের আজও অধিকাংশ জমির পাট্টা হয়নি। চরম অনিশ্চয়তার জীবন তাদের। নির্বাচন আসছে, তাদের নিয়ে রাজনীতি শুরু হবে। রাজ্যে ১২৬ বিধানসভার ৪২ টি আসন বাঙালি ভোটাররা জিততে না পারলেও নির্ণায়ক শক্তি। বিজেপি হিন্দুদের কথা বলে, হিন্দুত্ববাদ নিয়ে সরব হয়, কিন্তু হিন্দু বাঙালিদের অভাব অভিযোগ নিয়ে বিজেপি সোচ্চার না হলেও আজও আশা করে বিজেপি বাঙালিদের স্বার্থে কাজ করবে। কংগ্রেস দল আই ইউ ডি এফ-এর সঙ্গে হাত মেলালে দলের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বিনষ্ট হবে। হিন্দু বাঙলিদের কোনো স্থান হবে না। বর্তমান কংগ্রেস দল বাঙালিদের নিয়ে ভাবে না। এরকম ধারণা করার যুক্তি আছে? অপরদিকে, নানাভাবে হেনস্থার শিকার হওয়ার পরও বিজেপিকে ভাগ্যবিধাতা বলে মনে করে বাঙালি ভোটাররা। আজও আশা, জীবন জীবিকার অধিকার সুনিশ্চিত করতে বিজেপি কাজ করবে। তবে বাঙালির স্বর্ণ যুগ আর ফিরে আসবে না। শুধুই অতীত সোনালী স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া বাঙালিদের করার কিছুই নেই।
কোন মন্তব্য নেই