Header Ads

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে !! (৪)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
প্রশান্ত কিশোর প্রসঙ্গে ঢোকার আগে প্রথমেই আমার একটা দৃঢ় ধারণার কথা বলে নেওয়া দরকার। লোকসভার অপ্রত্যাশিত বিস্ময়কর ফলাফল দেখে তৃণমূল নেত্রী যতই হতাশ হোন না কেন তাঁর নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা দলটিকে বাঁচানোর জন্যে কয়েক’শো কোটি মূল্যের এমন এক মগজ ভাড়া করতে হবে--যে মগজে আধুনিক কর্পোরেট ভোট ম্যানেজমেন্ট-এর কৌশলে ঠাসা থাকলেও এই বংলার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং বিশেষ করে দলনেত্রীর গোটা জীবনের রাজনৈতিক উত্থান পতনের  ইতিহাস ও কারণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই--এমনটা তিনি ভাবেন নি। কারণ, এমনটা ভাবলে এবং দলকে ঘুরে দাঁড় করানোর জন্যে  বাইরের কোনো মগজ ভাড়া করলে যে নিজের ওপর আর তিনি আস্থা রাখতে পারছেন না সেটাই সবকিছু ছাড়িয়ে সামনে উঠে আসবে।

মানুষের মনে হবেই নেত্রী নিজে যখন নিজের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না তখন এ দলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে না। অর্থাৎ সরাসরি একটা মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে দলের সর্বস্তরে। এটা না বোঝার মতো রাজনৈতিক বোধ মমতার নেই এটা আমার কাছে অন্ততঃ গ্রহণযোগ্য নয়। প্রশান্ত কিশোরের কর্পোরেট মগজ ভাড়া করার তাগিদ ছিল মমতার আলোয় বিশেষভাবে আলোকিত অন্য এক বৃত্তের ‘নেতা’দের মধ্যে। বহু যুক্তি জালে তিনি শেষপর্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন বলেই আমার ধারণা। আমার এই ধারণা ক্রমশঃ দৃঢ় হয়েছে দলের মধ্যে পি কে’র বৃত্তবন্দি বিচরণ ক্ষেত্র থেকে এমন কিছু চটকদার কর্মসূচী নেওয়া ও তার বাস্তবায়নের ধারা দেখে। কার বা কাদের নিয়ন্ত্রণে পি কে দলকে রক্ষা করার অভিনব কর্মসূচী নিচ্ছেন এবং এই কর্মসূচীর মাধ্যমে কাকে বা কাদের ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন সেটা কোনোভাবেই গোপন রাখা যায় নি। ফলে দলের সর্বস্তরে এই বার্তাটাই গরম হাওয়ার মতো সকলকে ছুঁয়ে গেল যে, যে কোনোভাবেই হোক পি কে’র গুডবুকে নাম তুলতে পারলেই কেল্লা ফতে ! গুডবুকে বিনামূল্যে নাম তোলার কোনো উপায় যে নেই সেটাও সকলেই জানে। ফলে গোটা রাজ্য জুড়ে পি কে’র সৌজন্যে যে চাঞ্চল্য তৈরি হল তাতে সর্বস্তরের সাংগঠনিক কাঠামো ভীষণভাবে নড়বড়ে হয়ে গেল। পি কে’র পরামর্শে সাংগঠনিক রদবদল দলকে শক্তিশালী করার বদলে ঠিক কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ার জন্যে আগামী বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

পি কে দলের সর্বস্তরের দুর্নীতিবাজদের তালিকা তৈরি করার পাশাপাশি দুর্নীতিগুলিকে আইডেন্টিফাই করে দলের নেতা কর্মীদের শুদ্ধ পট্টবস্ত্র পরিধান করার জন্যে পরামর্শ দিলেন--কাটমানির টাকা ফেরৎ দাও, তোলাবাজির টাকা ফেরৎ দাও, সিণ্ডিকেটরাজ চলবে না, কোনোসূত্রেই কোনো লেনদেন চলবে না--এই সব উচ্চাঙ্গের পরামর্শের ধাক্কায় দলের সর্বস্তরে এক ভয়ঙ্কর আর্তনাদ শুরু হল। হাজারে হাজারে তোলাবাজ কাটমানিখোর চিহ্নিত হয়ে গিয়ে প্রমাণ করলো দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি দুরারোগ্য ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে গেছে।  আমি দুর্নীতির বিশদ তালিকার মধ্যে যাচ্ছি না। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষজন যা দেখার দেখছেন--যা বোঝার বুঝছেন। আমার বলার কথা এটাই যে পি কে’র এই বিশদ্ধকরণ কর্মসূচীতে দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতির অভিযোগকেই শুধু প্রতিষ্ঠিত করলো তাই নয় দলের ভেতরে সর্বস্তরে আনুগত্য ও কর্তাভজার রাজনীতিতে সরাসরি বিভাজন তৈরি করে দিল। ময়দানে ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে নেতা হিসেবে উঠে আসাদের মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হল। অনেকেরই মনে হল মমতা নয় অন্য কারুর পাদুকা বহনের কথা ভাবতে হবে। এই ভাবনাটা অনেক আগেই তৈরি করা হচ্ছিল। এই ভাবনার কারণেই মকুলকে দলত্যাগে বাধ্য করা হল। এই আত্মঘাতী মারাত্মক ভাবনাটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্যেই তৃণমূল রাজনীতিতে পি কে’র অনুপ্রবেশ বলে আমার ধারণা। আমার আশঙ্কা, অদূর ভবিষ্যতে এই ভাবনার অভিঘাতেই শুভেন্দু সহ আরও কয়েকজনকে দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ মুকুল না হতে হয় !
দলকে বাঁচানোর বদলে দলকে যে জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে ভাড়াটে মগজ তাতে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।  মাঝে মাঝেই পি কে দলের সংশোধনী কর্মসূচীকে এতটাই চড়া রঙে চটকদার করতে চেয়েছেন যাতে কাজের কাজ যতটা না হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি নেতা কর্মীরা চোখে সর্ষেফুল দেখতে বাধ্য হয়েছেন। কার কারা থাকবে কারা কারা থাকবে না--কতজন টিকিট পাবে কতজনকে বাদ দেওয়া হবে--প্রকাশ্যে এই সব প্রগলভতার মধ্যে উচ্চ সাংগঠনিক মেধা প্রতিফলিত হয় না--গোটা দলের ভেতরের স্থিতিকে তালগোল পাকিয়ে দেওয়া হয় মাত্র--এই সাধারণ সহজ উপলব্ধি দলের শীর্ষস্তরকে একটুও বিচলিত করে নি দেখে রীতিমতো আশ্চর্য্য হয়েছি। এইসব প্রগলভতা বাচালতার মধ্যেই দলনেত্রী ঘোষণা করে দিলেন--দলের সব বর্তমান বিধায়কই ফের টিকিট পাবেন ! বললেন--কারণ, তিনি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছেন--বড়সড় ভাঙ্গনের শব্দ শোনা যাচ্ছে একটু কান পাতলেই। ভাঙ্গন ঠেকাতে তাঁর এই ঘোষণায় কতটা কাজ হবে সেটা দু’এক মাসের মধ্যেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বেশ কিছু বিধায়ক পি কে’র শুদ্ধিকরণ কর্মসূচীর দৌলতে স্পষ্ট বুঝে গিয়েছেন তৃণমূলের টিকিটে তিনি কিছুতেই জিতবেন না। ফলে রাজনীতিতে থাকতে হলে তাকে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে--না হলে রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিতে হবে। তাঁরা বুঝে গেছেন ভাড়াটে কর্পোরেট মগজের ক্ষমতাই নেই তাদের রক্ষা করার। কারণ, এই দলের এক ও একমাত্র ভরসার মগজের অধিকারী মমতা--তিনি যখন অন্যের হাতে হাল তুলে দেওয়ার কথা ভাবতে বাধ্য হন তখন গোটা দেশের মধ্যে এই একমাত্র ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক দলটিকে কে বাঁচাতে পারে? অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সর্বস্ব কর্পোরেট মগজ? সবাই যদি তা বিশ্বাস করতো তাহলে হয়তো এত সমস্যা হতে না--কিন্তু অসংখ্য কর্মী সমর্থক যে এখনও তা বিশ্বাস করতে রাজি নয়--তাদের নিয়ে পি কে কি করবেন? ডেরেক আর অভিষেককে নিজের দুই হাত হিসেবে ব্যবহার করে তৃণমূলকে ডাঙ্গায় তোলার স্বপ্ন দেখা ও দেখানোর মধ্যে অপরাধের কিছু না থাকলেও--দল পরিচালনার ক্ষেত্রে মমতার নিজস্ব স্টাইল নিজস্ব ভাবনা চিন্তার বিকল্প তৈরি করা পিকে বাহিনীর কম্মো যে নয় তা হয়তো বেশ চড়া মূল্যের বিনিময়েই দলকে বুঝতে হবে।
বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েও মমতা একাই ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারতেন--কারণ, তাঁর রাজনৈতিক জীবনে তিনি যে ধরণের ধাক্কা বার বার খেয়েও বিস্ময়করভাবে উঠে দাঁড়িয়েছেন তেমন ধাক্কা তৃণমূলে আর কাউকে খেতে হয় নি। এইসব ধাক্কার চরিত্র বুঝে ও তা সামলে ওঠার দিনগুলিতে যিনি পাশে থেকে নিজেকে শাণিত করে তুলেছেন সেই মুকুল রায়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে তাই মমতা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন না। মুকুলকে নিয়েই  তার চিন্তা বেশি--উদ্বেগও, বিজেপিকে নিয়ে ততটা নয়।
এইরকম একটা সঙ্কট মুহূর্তে মমতাকে লড়তে হচ্ছে একই সঙ্গে করোনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে। নির্বাচনও দ্রুত এগিয়ে আসছে। দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্য জুড়ে তুমুল আলোড়ন তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। এইসব কিছু সামলে দলকে তিনি তাঁর নিজস্ব স্টাইলে কিছুটা হলেও গুছিয়ে তুলতে পারতেন হয়তো--কিন্তু তালগোল পাকিয়ে দিয়েছেন পি কে তাঁর উচ্চ মূল্যের উচ্চ মেধার কর্পোরেট কৌশলের নিত্য নতুন চমকের গুঁতোয় ! কতটুুক কি করতে পারেন মমতা বা করতেই হবে তাই নিয়েই আগামীকাল এই প্রতিবেদনের শেষপর্ব !!
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.