Header Ads

জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন...!!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
এখন আর কপাল চাপড়ে কোনো লাভ নেই। গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। গাণিতিক সূত্র বা ফর্মূলায় অঙ্ক কষে বলা হচ্ছে ইতিমধ্যেই ভারতে ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে করোনা তার থাবা বসিয়ে দিয়েছে। জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন দখলে খুব বেশি দেরি নেই আর ভারতের। জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে পরীক্ষা যতটুকু হয়েছে এবং যে বিশাল সংখ্যা অপরীক্ষিত রয়েছে এখনও এবং যাদের মধ্যে লাখে লাখে উপসর্গহীন আক্রান্তরা না জেনে বুঝে চেইন সিস্টেমে সংক্রমণের সুনামি তৈরি করছে তাতে যদি ইতিমধ্যেই মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশও আক্রান্ত হয়ে থাকে (অপরীক্ষিতের সংখ্যাই এক্ষেত্রে মারাত্মক রকমের বেশি) তাহলেও আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ কোটির বেশি হওয়াই সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ গবেষকরা। সুতরাং এখন আর কপাল চাপড়ে আক্ষরিক অর্থেই কোনো লাভ নেই। কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম লকডাউন ঘোষণার আগে নিশ্চিতভাবেই দিনসাতেক ঝুকি নিয়ে জরুরি কিছু প্রাক্ প্রস্তুতি নিতে পারতো--কিন্তু নেয় নি। তার মারাত্মক ফল এই গোষ্ঠী সংক্রমণ। 
 
কেন্দ্র যা করার করেছে--কিন্তু আমার রাজ্য কি করতে পারল? কোনোদিন ক্ষমা করতে পারা যাবে রাজ্যের বিস্ময়কর মেধাহীন বিকারগ্রস্ত অক্ষম অপদার্থতা? জানি না আমাদের মতো মানুষ কতজন বেঁচেবর্তে থাকতে পারবো--না পারলে আমরা কিন্তু মোটা মাথার বিভ্রান্ত দিশেহারা রাজনীতির কুয়োর ব্যাঙদের দিকেই তর্জনী তুলে যাব।
রাজনৈতিক নেতানেত্রী হলেই--জনপ্রতিনিধি হলেই--মন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক হলেই তিনি সর্বজ্ঞানী সর্ববিশারদ গবেষক বিজ্ঞানী শিল্পী সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন আশ্চর্য এক নির্বিরোধ সমর্থনে। ভেতরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ‘চ’ নেই তবুও এদেশে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ! প্লেটোর আমলের বা সিন্ধুসভ্যতার আমলের পৌরবিজ্ঞানের কথা বাদ দিচ্ছি--অত্যাধুনিক পৌরবিজ্ঞানের বিন্দুমাত্র ‘প-ফ’ জ্ঞান না থাকলেও এদেশে পৌরমন্ত্রী হয়ে হাস্যকর মাস্টারি করা যায়। আবার প্রত্যক্ষভাবে সরকারে না থেকেও মন্ত্রী-প্রশাসকদের
কর্ণাকর্ষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণও করা যায় ! সর্বক্ষেত্রেই হুবহু একই চিত্র।
আর যদি ভুলবশতঃ প্রকৃত যোগ্য কেউ সঠিক মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েও যান--প্রতিদিন ভৃত্যের দায়িত্ব পালনের প্রবল চাপে প্রতিদিন একটু একটু করে তিনি তাঁর নিজের শিক্ষা দীক্ষা বেমালুম ভুলে যেতে যেতে বিচিত্র এক বিদূষক রাজনৈতিক রোবটে পরিণত হন ! সব মানুষ নন--কিছু মানুষ এসব লক্ষ্য করছেন--কিন্তু অচলায়তনকে ধাক্কা দেওয়ার মতো সংখ্যায় তারা যতদিন অনেক কম থাকবেন ততদিন তাদের যম-যন্ত্রণা ভোগ করতেই হবে !
আমাকে যাঁরা নিয়মিত ফলো করেন তাদের মনে থাকার কথা আমি অনেক আগেই পশ্চিমবঙ্গের এই পরিণামের সম্ভাবনার কথা স্পষ্ট করেই লিখেছিলাম। স্তাবক বিদূষকের দল তখন নবান্নের দরবারী বৈঠকের ফানুসে ভাসানো রঙবেরঙের বকোয়াসে বেজায় মুগ্ধ হয়ে আমাকে কটাক্ষ করতে ছাড়েন নি। দরবার আলো করে যাঁরা প্রতিদিন মানুষকে অভয় দিতেন--‘ভয় পাবেন না আতঙ্কিত হবেন না’ (না-এর ওপর নাটকীয় জোর দিয়ে)--তাঁরা রীতিমতো বেগতিক অবস্থা দেখে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তাঁদের বুঝতে অসুবিধে হয় নি তাদের শিক্ষাদীক্ষা বোধ বিবেচনা এবং ভয়ানক এই সঙ্কটসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞ মতামত ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই পাত্তা পাচ্ছে না বা পাবে না। তাঁরা শুধু অবাক নয়নে সর্বজ্ঞ সর্ববিশারদ রাজনীতিক জনপ্রতিনিধিদের নির্লজ্জ রাজনৈতিক ফায়দা লোটার প্রতিযোগিতা দেখতে বাধ্য হচ্ছিলেন !
কি করলো রাজ্য সরকার? মোদীর দু’দিন আগেই রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা করে প্রমাণ করল বাংলা এগিয়ে এক নম্বরে থাকছে। কিন্তু রাজ্যের মানুষ কি দেখলো? রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে গেল করোনা উৎসব ! দোকান-বাজারে মানুষের সে কী গলাগলি ঢলাঢলি গা-ঘেঁষাঘেঁষি ! ত্রাণ বন্টনের নামে করোনা বন্টনের কী প্রবল উন্মাদনা ! রেশন লুণ্ঠন ও তার প্রতিক্রিয়ায় কী ভয়ানক জনবিক্ষোভ ! কাঙ্গাল বাঙালির মিষ্টিবুভুক্ষা মেটাতে মিষ্টির দোকান খুলে দেওয়া হল--মন্দির মসজিদ বন্ধ থাকলেও পুষ্প বিলাসী রসিক বাঙালির মর্মযাতনা ঘোচাতে ফুলবাজারও খুলে দেওয়া হল--পান-বিড়ি-চায়ের দোকানের ঝাঁপও উঠে গেল--এসবই হতে থাকলে এমন কিছু পরামর্শের মোড়কে যা রীতিমতো হাস্যকর এবং যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল জনদরদী রাজনীতি !
কোথাও কোনোরকম কঠোরতা ছিল না। বাজার থেকে পাড়ার অলিগলিতে--তারপর পরিবার থেকে পরিবারে ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকল করোনা ভাইরাস ! করোনা কে প্রতি মুহূর্তে ‘ভয় পাবেন না--আতঙ্কিত হবেন না’ বলে বলে সাধারণ মানুষকে বেপরোয়া করে তোলা হতে লাগল। ভয়ঙ্কর বিপদ সম্পর্কে তারা সচেতন হওয়ার সুযোগই পেল না। লকডাউনের নামে সর্বত্রই প্রায় নির্ভেজাল ফাজলামি ও রঙ্গরসিকতার প্রতিযোগিতা চলতে থাকল। ব্যাপক হারে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর শুরু হল দ্বিতীয় ধাষ্টামো--অনলক ! চালু হল অফিস -কাছাড়ি, কিন্তু পরিবহণ পরিস্থিতিকে করোনা প্রতিরোধের উপযুক্ত করে তোলা হল না। কর্মীরা দলে দলে বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেন--একই সঙ্গে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ঘরে ফিরতে শুরু করে দিতেও বাধ্য হলেন--পরিণতি যা হওয়ার তা হতে থাকল। হু-হু করে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
গাণিতিক ফর্মূলায় অঙ্ক কষলে এই মুহূর্তে বাংলার অবস্থান ঠিাক কোথায় আমি সেই শিহরিত হওয়ার মতো বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। শুধু এই টুুকু বলতে পারি অচেতন অজ্ঞান নির্বোধ মানুষেরও আর বুঝতে বাকি নেই--ঠিক কোন্ জায়গায় এসে তাঁরা দাঁড়িয়েছেন ! এখনও রাজনৈতিক কমেডিয়ানরা সোৎসাহে দলীয় মিছিল করছেন--অবরোধ করছেন--বিক্ষোভ জমায়েত করছেন--আম্ফান-রেশনের টাকা লুট করে মনুষকে ক্ষোভে বিক্ষোভে রাস্তায় নামতে বাধ্য করছেন ! লক্ষ লক্ষ মানুষকে জবরদস্তি মৃত্যুমিছিলে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন যারা তার কিন্তু খুব সহজেই মানুষের আদালতে পার পেয়ে যাবেন না।
রাজনৈতিক ধান্ধাবাজ লুটেরাদের বা কোনও শক্তি-গোষ্ঠীর কাউকে হাসপাতাল চত্বরে হয়রানির শিকার হয়ে ছুটে বেড়ানো মানুষকে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে দেখা যাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি সমস্ত বেড এবং ‘ভগবান’রা নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছেন চড়া লেনদেনের রাজনীতিতে। তাই মানুষকে মরে পরে থাকতে হচ্ছে হাসপাতালের সামনে-রাস্তাঘাটে ! মানুষ এসব ছবি ভুলে যাবে? কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকা লোকজন ও তার পরিবারের সদস্যরা ভুলে যাবে তাদের নারকীয় অভিজ্ঞতার কথা--অমানবিক বঞ্চনার কথা। তাদের অসহায় ক্রোধ খুব তাড়াতাড়ি বাষ্প করে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা প্রশান্ত কিশোর বা তার তৈরি কোনো শক্তিরই হবে না। সেটার প্রমাণ পাওয়া এখন স্রেফ কিছু সময়ের অপেক্ষা।
অথচ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে যদি প্রথম থেকেই নির্বোধ মেধাহীন প্রগলভতার ফুলঝুরি না ছড়িয়ে প্রশাসনকে কঠোর ভাবে ব্যবহার করে লকডাউনকে আক্ষরিক অর্থেই লকডাউন হিসেবে পালনের চেষ্টা করা হতো তাহলে এই অবস্থা হত না। রেল-বিমান-কেন্দ্রের ঘাড়ে নিজেদের অপদার্থতার বোঝা চাপিয়ে হাততালি না দিয়ে নিজেদের যতটুকু যা করার ছিল করতে পারলেও রাজ্যকে আজ এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে হত না।
যারা যা বোঝার বুঝতে পারছে। নিত্য নতুন নাটকীয় যাত্রাপালার সংলাপে অন্ধ স্তাবক বিদূষকদের কিছুদিনের জন্যে বোঝানো গেলেও বেশি দিন তাও পারা যাবে না। কারণ, তারা যখন বুঝবে তাদের ঘরেও করোনা থাবা বসিয়েছে--তাদের আত্মীয় পরিজনদের জন্যেও চিকিৎসা নেই হাসপাতালে বেড নেই--তাদের দাদা-দিদিরাও নিঃশব্দে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে তখন তাদের কে সামলাবে কে জানে ! সকলেরই তো চড়া দামে বেড কেনা চিকিৎসা কেনার ক্ষমতা নেই !
মানুষের মধ্যে তীব্র বিরক্তি ক্ষোভ হতাশা এবং অসহায় ক্রোধ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। রাজনৈতিক কমেডিয়ানরা তার কোনো খোঁজখবর রাখছে না। কিন্তু যখন টের পাবে তখন আর সত্যি সত্যি কিছু করার থাকবে না !!



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.