Header Ads

বাংলা তথা কংগ্রেস রাজনীতির এক বর্ণময় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

সত্তর দশকের উত্তাল বঙ্গ রাজনীতির কেন্দ্রে যে’কজন যুব কংগ্রেস নেতার প্রবল উত্থান ঘটেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সোমেন মিত্র ! কলকাতার কলেজ জীবনের শুরুতেই তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল আমার। বেশ কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি রয়েছে এখনও। বরাবরই আমার মনে হয়েছে--একমাত্র বিধান রায়-ইন্দিরা গান্ধী-রাজীব গান্ধী-প্রণব মুখার্জ্জীর কংগ্রেস-ই সোমেন মিত্রের স্বাভাবিক রাজনৈতিক বিচরণের ক্ষেত্র ছিল। কংগ্রেসের রাজনৈতিক কালচারে তিনি নিজেকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করে ফেলেছিলেন যে, সেখান থেকে তাঁর মানসিক বিচ্ছিন্নতা কখনো সম্ভব ছিল না।

এই প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রথম যে ছবিটা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে সাদা-কালোর আবহে যে সোমেন মিত্রকে দেখা যাচ্ছে আমি সেই সোমেন মিত্রকেই আজও মনে রেখেছি--কারণ, ঐ ছবির সোমেন মিত্রই আসল সোমেন মিত্র। দ্বিতীয় যে ছবিতে মমতার সঙ্গে সোমেন মিত্রকে দেখা যাচ্ছে সেই সোমেন ও মমতার দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক নিয়ে প্রথম দিন থেকেই আমার তীব্র সন্দেহ ছিল। সোমেন মিত্রের তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদানের ব্যাপারে আমার সমর্থন ছিল না। কারণ, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে যে দু’একজন নিজস্ব ক্যারিশ্মায় সম্পূর্ণ নতুন দল গঠন করে সফল হয়েছেন তাদের বাদ দিলে বাকি যারা অন্য দলের আশ্রয় নিয়ে ক্রীতদাসত্বের শর্তে কিছু উচ্ছিষ্ট দু’হাত পেতে গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠে নিজেদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে বেশরম ব্যক্তিত্বহীন কমেডিয়ানের চরিত্রাভিনয়কে বেছে নিয়েছেন তাদের সঙ্গে সোমেন মিত্রের রাজনৈতিক চরিত্রের আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না ব্যক্তি ক্যারিশ্মানির্ভর কোনো দলে বেশিদিন মানিয়ে চলা। শেষ পর্যন্ত সোমেন মিত্র তা পারেন নি। তাঁকে তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই হয়েছিল।
জলের মাছ ডাঙায় উঠে গেলে এবং জলের মাছ জলে ফিরে গেলে কি হয় তা সোমেন মিত্রকে যারা খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা বুঝেছেন। তাঁর এই কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদানের বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে প্রচুর অনুতাপ করতে শোনা গেছে এবং সেটা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না। তৃণমূলের অত্যন্ত রমরমার দিনে তিনি যদি করজোড়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন তাহলে লোকে হয়তো একদিন তাঁকে ধীরে ধীরে ভূলে যেত--একজন নির্ভেজাল রাজনৈতিক ভাঁড় হিসেবে তাঁর নতুন পরিচয় গড়ে উঠতো--তাহলেও তো তিনি মাঝে মাঝে পরিপাটি সেজেগুজে আলোঝলমলে মঞ্চের কোনো এক প্রান্তে একটা চেয়ার পেতেন--নিজস্ব বলয়ে ছড়ি ঘোরাতে পারতেন--ইতিহাস তাঁকে নতুন আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করলেও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কী এমন ‘‘ক্ষতি’’ হতো? তিনি এসব ভাবতেই পারতেন--কিন্তু ভাবেন নি। সোমেনের জায়গা তাই বঙ্গ রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে হারাবার নয়।
তিনি যে আদ্যান্ত কংগ্রেসী ছিলেন--এই পরিচয়টাই তাঁর থেকে যাবে। মাঝখানের কয়েকটা অস্বস্তিকর বছরের কথা তিনি যেমন প্রাণপণে ভুলতে চেয়েছিলেন--তাঁর অনুগামী সমর্থকরাও তা মনে রাখবেন না। এমন কী, তিনি নিজের হাতে যাদের গড়েপিটে নেতা বানিয়েছেন তাদের অনেকেও প্রকাশ্যে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে অক্ষম হলেও মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলবেন না তাঁরা সোমেন মিত্রকে গাইড হিসেবে না পেলে আজ কোথায় থাকতেন !
মনে পড়ছে, এই সোমেন মিত্র-ই একদিন মমতাকে বলেছিলেন--‘তুমি বিধান রায় হয়ে ওঠো !’ এ কথা তিনি কেন বলেছিলেন এবং মমতা-ই বা কি হয়ে উঠলেন সেই রাজনৈতিক বিশ্লেষণে যেতে চাইছি না--শুধু এটুকুই বলতে চাই--সোমেনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁকে অনেক দূরের দৃশ্যপটকে দেখতে সাহায্য করে এসেছে চিরকাল। কিন্তু বাংলায় কংগ্রেসের সাফল্য শুধুমাত্র সোমেন নির্ভর না থাকায় কংগ্রেস সে ভাবে মাথা তুলে থাকতেই পারল না। এর দায় শুধুমাত্র সোমেনের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন অনেকেই। কিন্তু তাঁরা প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের নাবালকত্ব ও হাইকম্যাণ্ডে প্রশ্নাতীত  আত্মসমর্পিত মানসিকতা নিয়ে সেভাবে সরব হন নি কখনো।
এমনই এক বর্ণময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বাংলা হারালো আজ ! বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এটা এক স্মরণীয় ছন্দপতন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকল ! ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে
গভীর শ্রদ্ধা জানাই। গভীর সমবেদনা জানাই তাঁর পরিবারের সকলের প্রতি !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.