Header Ads

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে !! (২)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
এর আগে বিজেপি’র সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম বিজেপি এই  মুহূর্তে ৩৬ থেকে ৫৪ টি আসনে বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে এবং আরও গোটা পঞ্চাশেক আসনে তৃণমূলকে যথেষ্ট বেগ দেওয়ার জায়গায় রয়েছে। অর্থাৎ মোট ১০৪-টি আসনে বিজেপি তৃণমূলের  একমাত্র জোরালো প্রতিপক্ষ। এই ১০৪-টি আসনে কংগ্রেস-সিপিএম এককভাবে অথবা জোটবদ্ধভাবে উদ্বেগজনক সমস্যা তৈরি করবে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে।

এ প্রসঙ্গে তৃণমূলের এই মুহূর্তে সম্ভাবনার অঙ্কটা আগেই জানিয়ে দিলে তার কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করা সহজ হবে। এখনই যদি ভোট হয় তাহলে তৃণমূল ৬৬-টি আসনে হেসেখেলে জেতার জায়গায় রয়েছে। এই অঙ্ক পিছনে ফেলে তৃণমূল বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকছে মোট ৮৮-টি আসনে এবং বিজেপিকে বেশ উদ্বেগের মধ্যে রাখবে মোট ১১০-টি আসনে।

এখন যদি ধরে নেওয়া যায় যে, মোট ২৯৪-টি আসনের মধ্যে বিজেপি ১০৪ এবং তৃণমূল ১১০-টি আসন দখল করছে তাহলে বাকি থাকছে ৮০-টি আসন। স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠবে এই ৮০-টি আসন কি বাম-কংগ্রেস জোটের দখলে যাবে? আমার পর্যবেক্ষণে কিন্তু সেরকম সম্ভাবনা দেখছি না। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বাম এবং কংগ্রেস--উভয়েরই আসন আরও কমবে। এই জোট ছোটখাট পকেট বা প্রান্তিক এলাকায় ১০/১৫-টি’র বেশি আসন পাবে বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে বাকি আসনগুলো কোথায় যাবে? আমার কাছে বঙ্গ রাজনীতির যে হাওয়া-বাতাস ভেসে আসছে তা থেকে অনুমান করছি--নতুন একটা জোট আগামী বিধানসভার আগে জন্ম নিতে চলেছে তৃণমূলের তিতিবিরক্ত ক্ষুব্ধ কোণঠাসা অপমান ও হেনস্থার শিকার কিছু দলত্যাগী ছোট-বড় নেতা (এদের মধ্যে এমন কিছু নেতাও থাকবেন যারা বুঝে গিয়েছেন দলের টিকিট পেলেও তাদের জেতার আশা থাকছে না),  বিজেপিতেও উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান না পেয়ে রাজনীতি থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা পুরোপুরি কোণঠাসা বেশ কিছু দলত্যাগী নেতা ছাড়াও কংগ্রেসেরও  প্রায় বেকার বসে থাকা নেতাদের নিয়ে। এই নতুন জোটের উদ্দেশ্যই থাকবে ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু শর্তের বিনিময়ে কোনো এক পক্ষকে সরকার গঠনে সাহায্য করা। শর্তধিীন সরকার গঠনে যদি তৃণমূলের আগ্রহ থাকে তাহলে তৃণমূল--অন্যথায় যদি বিজেপি শর্তাধীনে সরকার গঠনে রাজি থাকে তাহলে বিজেপিও এই নতুন জোটের সমর্থন পেতে পারে। অবশ্য তার আগে বিজেপি’র মার্কেটিং সেল যথারীতি অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠে রাজনৈতিক ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারটা সেরে ফেলতেও পারে। সে যাইহোক না কেন--ঠিক এই মুহূর্তে আমার পর্যবেক্ষণ বলছে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে একটা নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের সৃষ্টি হতে চলেছে--যার ফলে তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপি--কেউ-ই একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার মতো জায়গায় থাকতে পারবে না। যতদূর মনে হচ্ছে--ত্রিশঙ্কু ফলাফল হতে চলেছে আগামী নির্বাচনে। নির্বাচনের এখনও আট/ন’মাস দেরি আছে--কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা বেশ কঠিন। আমার পর্যবেক্ষণ এবিপি’র পর্যবেক্ষণের মতো অত বিরাট মাপের বিজ্ঞান ভিত্তিক নয়--বাণিজ্যিক দায়বদ্ধতা সম্পৃক্তও নয় যে, আমি বলে দেব--আগামী বিধান সভা নির্বাচনে তৃণমূল ড্যাং ড্যাং করে জিতে যাবে আর বিজেপি খুব বেশি হলে ২০-২৫-টি আসন পাবে ! লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি ৪-টি আসন পেতে পারে বলে বিজ্ঞান ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ করেছিল এবিপি--আমার বিনা কারিগরী প্রযুক্তিহীন বিনামূল্যের পর্যব্ক্ষেণ ছিল বিজেপি ১৬ থেকে ১৮-টি আসন পাবে !
এখন আলোচনা করা যেতে পারে--ক্ষমতায় ফেরার প্রশ্নে তৃণমূলের পক্ষে এই অনিশ্চয়তা তৈরি হল কি করে এবং কেন? এই  ‘কেন’র উত্তরে এত অসংখ্য কারণ রয়েছে যার তালিকা তৈরি করতে গেলেই একটা মহাভারত লিখতে হবে, আমি সেই দীর্ঘ তালিকা তৈরি করতে চাইছি না--খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ নিয়ে এখানে আলোচনা করব।
২০১১’র নির্বাচনের আগে বিরোধী দল হিসেবে তৃণমূলের যে বিরাট গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল তা ২০১৬ সালের নির্বাচন পর্যন্ত মোটামুটি টিকে থাকলেও (২০১৪ সালে বিপুল ক্ষমতায় বিজেপি ফিরে এলেও) তৃণমূলের গণতান্ত্রিক গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়টিতে। ৩৭% আসনে নির্বাচন হতে না দেওয়া, মনোনয়ন দাখিল করতে না দিয়ে বিডিও অফিসগুলো অবরোধ করে রাখা--বিপুল সংখ্যক মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখা কিংবা বুথ থেকে কুকুর তাড়ানোর স্টাইলে খেদিয়ে দেওয়া এবং প্রায় শতাধিক গ্রামীণ মানুষের প্রাণ ও রক্ত ঝরানো’র স্মৃতি মানুষ যে ভুলতে পারে নি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে। ভোট দিতে পারার প্রথম সুযোগেই মানুষ শাসক বিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে বেছে নিল সংগঠনহীন ঢাল-তলোয়ারহীন বিজেপিকেই। রাজনৈতিক মহল এই ফলাফলে কতটা বিস্মিত হয়েছিলেন তা নিয়ে আমি অন্তত বিশেষ কিছু ভাবি নি। চিন্তিত হয়েছিলাম দলনেত্রীর তীব্র হতাশাজনক প্রায় নির্বাক্ বিমূঢ় বিস্মিত প্রতিক্রিয়ায়। হতাশা তাঁকে এতটাই গ্রাস  করে ফেলেছিল যে, তিনি আর নিজের ওপরেও আস্থা রাখতে পারলেন না--দলকে রক্ষার তাগিদে বিহারী মগজ ভাড়া করতে হল তাঁর মতো দাপুটে অকুতোভয় নেত্রীকেও। নিজের ওপর তাঁর এই আস্থাহীনতার যে ব্যখ্যাই দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হোক না কেন তা দলেরই একাংশ ছাড়া আর কারুর কাছেই  প্রায়  গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি প্রশান্ত কিশোরেরই বিচিত্র সব কর্সূচী ও পরামর্শের কারণেই বলা যেতে পারে। পরে সে কথায় আসছি। তার আগে মুকুল প্রসঙ্গে দু’একটি কথা বলতেই হবে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও দলের ভোট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন মুকুল রায় দলানুগত নিষ্ঠার সঙ্গেই--কিন্তু একেবারেই স্বস্তি ও সম্মানজনক অবস্থানের ভেতরে থেকে নয়। কারণ, তার কিছু আগে থেকেই এই বঙ্গ রাজনীতিতেই ইন্দিরা-সঞ্জয় গান্ধী এপিসোডের মঞ্চায়ন একটু নতুন আঙ্গিকে শুরু হয়ে গিয়েছিল। মুুকুলকে দলের মধ্যে গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার প্রয়োজনটা ধীরে ধীরে বেশ প্রকট হয়ে উঠছিল। মুকুল নিজেও সেটা বুঝতে পারছিলেন কিন্তু প্রায় নিজের হাতেই গড়ে তোলা দলের মধ্যে তিনি তাঁর যে ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন তা মেনে নেওয়া  তাঁর পক্ষে একেবারেই সম্ভব ছিল না। দলের মধ্যে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দলের প্রয়োজনে দলের স্বার্থে এবং দলের নির্ভেজাল সমর্থনে তিনি যেসব কাজ করেছেন সেইসব কাজকর্ম নিয়ে দলের মধ্যে প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলার যে প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাতে তিনি স্পষ্টতঃই বুঝতে পারছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে। ফলে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মুকুলের দলত্যাগ দলের ভোটরাজনীতিকে রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেটা পঞ্চায়েত নির্বাচনেই বোঝা গিয়েছিল। বড্ড বেশি রকমের মূল্য দিয়ে দলকে বুঝতে হল গত লোকসভা নির্বাচনে। সামনে এখন বিধানসভা নির্বাচন--এই  নির্বাচনেও মুকুল  ও প্রশান্ত কিশোর তৃণমূলের বিপক্ষে যে বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে চলেছেন সেটাও প্রসঙ্গতঃ বুঝতে হবে। এর সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আগাপাশতলা বেলাগাম দুর্নীতির ব্যাপারগুলো তো রয়েইছে ! এই সীমাহীন দুর্নীতিকে সংযত করতে না পারার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সামলাবার মতো পরিস্থিতি এই মুহূর্তে দলের হাতে নেই বলেই সিংহভাগ মানুষের বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে !
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.