Header Ads

‘সৃজনশীলতার আনন্দটাই আসল। বাকি সব তুচ্ছ।’



শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ অতি পরিচিত  ব্যক্তিত্ব     সমকালীন  বাংলা সাহিত্যের  এক  অগ্রগণ্য  নাম নতুন  করে  তার  বিশেষ  পরিচয়ের   দরকার  পড়ে  না নিঃসন্দেহে  তিনি   নিজেই  এখন  একটি  সমীহযোগ্য  প্রতিষ্ঠান  সাহিত্যের  পাশাপাশি  সরকারি  পদেও তিনি   শীর্ষস্থানে  রয়েছেন কবিতা, প্রবন্ধ,  ছোটগল্প  এবং  উপন্যাস  -  সব  মিলিয়ে  এখন  পর্যন্ত  তাঁর  প্রকাশিত  বইয়ের  সংখ্যা  সতেরো  এই  মুহূর্তে  ভারত  সরকারের  পর্যটন  মন্ত্রণালয়ের  আঞ্চলিক  অধিকর্তা  হিসেবে  উত্তরপূর্ব  ভারতের  দায়িত্বে  ন্যস্ত  রয়েছেন   সম্প্রতি শঙ্খশভ্র  দেববর্মণের  একটি  সাক্ষাৎকার  নিয়েছিলেননয়া ঠাহরএর  পক্ষে   ননী গোপাল ঘোষ  করোনা  ভাইরাস জনিত  বৈশ্বিক  অতিমারীর  সংকট  মোকাবিলায়  ব্যস্ত   যখন   সবাই  -  তাঁর  কাছে   জানতে   চাওয়া  হয়েছিল  একজন  উচ্চপদস্থ    সরকারি   আধিকারিক  এবং   এই সময়ের শীর্ষস্থানীয়  সাহিত্যিক  হিসেবে  তিনি  কীভাবে  গোটা  বিষয়টিকে   দেখছেন    অনিবার্যভাবে  উঠে  এসেছিল  তাঁর  সাহিত্যচর্চার কথাও  অকপটে  অনেক  কথাই  বললেন  তিনি সেই  সাক্ষাৎকারের   অংশ বিশেষ   উদ্ধৃত  হল  এখানে
ননীঃকোভিড  ১৯’র  সংক্রমণ    ঠেকাতে   আমাদের দেশ প্রায়   আড়াই মাস  লকডাউনের  মধ্যে ছিল। এর মধ্যে  জীবন  নির্ধারণের   জন্য  অত্যাবশ্যক কাজগুলি   ছাড়া  বাকি  সব পরিষেবা বন্ধ ছিল।  এই    অচলাবস্থার  এখনও  অবসান  হয় নি।  পর্যটন  এবং তার সংগে জড়িত সব ছোটবড় ব্যবসা কিম্বা ইন্ডাস্ট্রি   কার্যত   বন্ধ  হয়ে গিয়েছে। এর  রিভ্যাইভ্যাল  সম্ভব কীভাবে? 
শঙ্খশুভ্রঃ হ্যাঁ, ক্ষতির  পরিমাণ  অপরিমাপযোগ্য।  কীভাবে এই অচলাবস্থা  কাটিয়ে  ওঠা   যায়  - তার জন্য  ভাবনাচিন্তা চলছে।  সমস্যার  সুরাহা  হবে  নিশ্চয়।   দেশের   চাকরির  বাজারে  বারো   শতাংশ  চাকরি  আসে   এই  পর্যটন  থেকেই।   কত  অসংখ্য  মানুষের   রুটিরুজি  জড়িয়ে  আছে এর  সঙ্গে।   ভারতে   বিদেশি   মুদ্রা  অর্জনেরও   প্রধান মাধ্যম এই  পর্যটন।   এই  শিল্পকে   তাই   কীভাবে  পূর্বাবস্থায়   ফিরিয়ে  আনা যায়  তার  জন্য নতুন   উপায়  খুঁজে  বের  করার   চেষ্টা   তো করতেই  হয়।   এ ছাড়া   উপায়  কী। ভারত  সরকারের  পর্যটন   মন্ত্রণালয়   ইন্ডাস্ট্রির   সঙ্গে  জড়িতদেশের   শীর্ষ  স্থানীয়   ট্যুর  অপারেটর,  ট্র্যাভেল  এজেন্টস,  হোটেলিয়ার্স, গাইড   সহ  সব ক’টি   রাজ্য  সরকারের  সঙ্গে  নিয়মিত  যোগাযোগ  রেখে চলেছে।  আলাপ  আলোচনা  হচ্ছে। সমস্যার  সমাধান  সম্ভব কীভাবে  -  কথা হচ্ছে   সেই বিষয়ে  নিরন্তর।
ননীঃ  লকডাউনের  সময়  কী  ভাবে    চলেছিল আপনাদের  ট্যুরিজমের কাজকর্ম?   
শঙ্খশুভ্রঃ  পর্যটন  হয়তো  এসেনশিয়্যাল  সার্ভিসের  মধ্যে   পড়ে না  ঠিকই;   লকডাউনের  সময়েও  আমরা  তবু  চেষ্টা  করে গেছি  মানুষের  পাশে  থাকার।  আশ্বাস  দিয়েছি  ভরসার।  আমি  তাই  অনুমোদিত আমার সরকারি    সামর্থ্যের মধ্যে    সমাজের  উন্নয়নমূলক  কাজকর্মের  সঙ্গে   জড়িত   এমন  এন জি ও’র  মাধ্যমে মহিলা  সেলাই  কর্মীদের  দিয়ে   ইনক্রেডিবল  ইন্ডিয়ার  লোগো সহ  মাস্ক  বানিয়ে  নিয়েছি।   স্থানীয়  কারিগরদের  দিয়ে  ছাতা  বানিয়ে  নিয়েছি। এতে  লকডাউনের   সময়ও  কিছু   লোকের  অর্থোপার্জন এবং   অন্ন সংস্থানের  সুবিধা  হয়েছিল। সংক্রমণের   প্রবল  ঝুঁকি  সত্বেও   তারপর   রাস্তায়  দাঁড়িয়ে   সেইসব  মাস্ক  এবং  ছাতা   সাফাই কর্মী,  আরক্ষা  কর্মী, মুটে মজদুরভাই, ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, অটো  রিকশা  চালক,  সাংবাদিকদের  হাতে  তুলে দিয়েছি।   শহরের  সর্বত্র  মাস্কের  আকাল।  উত্তরপূর্ব  ভারতের  অন্যান্য  শহরেরও  একই  অবস্থা।  আমরা   মাস্ক, ছাতা  গুয়াহাটি   সহ  উত্তরপূর্ব   ভারতের  বিভিন্ন  শহরে  বিতরণের   চেষ্টা  করেছি।
ননীঃ  মাস্কগুলি   দেখেছি।  অভিনবত্বের  ছাপ  আছে  মানতে  হবে  গণ মাধ্যমেও  দেখেছি  প্রশংসিত  হয়েছে  আপনাদের  এই  উদ্যোগ 
শঙ্খশুভ্রঃ   হ্যাঁ,  আমরা  পর্যটনের  মানুষ।  আমাদের  কাজই  হচ্ছে  স্থানীয়  প্রোডাক্টকে  প্রোমোট করা।   কিন্তু  প্রোমোট  করার  জন্যও  যথেষ্ট   কল্পনা  করতে   হয়।   ভেবেচিন্তে   বের করতে  হয় প্রাসঙ্গিক এমন কিছু  - যা   জনসাধারণের   ব্যবহারের জন্য  জন্য উপযুক্ত।    বিশেষ  পরিস্থিতিতে   জনগণের  কাছে অপরিহার্য হিসেবে  বিবেচ্য  হয়। ইনোভেটবলি  কাজ  করাটা  এখানে  গুরুত্বপূর্ণ হয়ে  দাঁড়ায় 
ননীঃ    বিশ্বজুড়ে   কোভিড  ১৯এর  এই  অতিমারীর  ফলে  পর্যটন ব্যবসার  চূড়ান্ত ক্ষতি  হয়ে  গেল  কিন্তু  এই  দুরাবস্থার  কালো  মেঘ  একদিন  অবশ্যই   কাটবে  কোভিড  ১৯এর  ভ্যাকসিন  বেরোবে  কী  বেরোবে  না  আমরা  জানিনা   কিন্তু  প্রকৃতির  স্বাভাবিক  নিয়ম  মেনেই    ভাইরাসের  প্রকোপ কমবে   পরিস্থিতি    ধীরে  ধীরে  স্বাভাবিক হয়ে   আসবে  কিন্তু  পর্যটন  কী  তার  পূর্বাবস্থায়  ফিরতে  পারবে?  লোকজনের  মধ্যে  কী   ভ্রমণ  করার   সেই  সাহস  থাকবে?
শঙ্খশুভ্রঃ   কোভিড  ১৯এর  উত্তরকালে  বিশ্বের  সর্বত্র  জনপ্রিয়  পর্যটন ক্ষেত্রগুলির  জনপ্রিয়তা  হয়তো  কিছুটা  হ্রাস  পাবে   আমার ব্যক্তিগত  ধারণা  দলে পালে  হই হই  করে  ঘুরে  বেড়ানো  আপাতত  আর  সম্ভব  নয়  ওয়েলনেস  ট্যুরিজম  কিম্বা  মেডিক্যাল  ট্যুরিজমের  গুরুত্ব আরও বাড়বে  বিনোদনমূলক  ট্যুরিজমের  মধ্যে    গলফ  ট্যুরিজমের  জনপ্রিয়তা    বাড়ার  সম্ভাবনা  রয়েছে
ননীঃ   কোভিড  ১৯এর  উত্তরকালে   আমাদের    উত্তরপূর্ব  ভারতের  পর্যটন শিল্পের   পুনর্জাগরণের  সম্ভাবনা  কতটুকু? 
শঙ্খশুভ্রঃ  আমি  তো  বিভিন্ন  মিডিয়াকে  সাক্ষাৎকার  দিতে  গিয়ে বারবার  সবাইকে  একই  কথা  বলছি,      পোস্ট  কোভিড  ১৯ পরিস্থিতিতে  উত্তরপূর্ব  ভারতের  পর্যটন  শিল্পের    গুরুত্ব  এবং  জনপ্রিয়তা  বাড়বে  আরও
ননীঃ  কীভাবে    সম্ভব?
শঙ্খশুভ্রঃ  উত্তরপূর্ব  ভারতের  ট্যুরিজমের  সব  প্রোডাক্টসই  কোভিড  ১৯এর  উত্তরকালে    মানুষের  কাছে  উপশমের  মতো  কাজ   করবে  হ্যাঁ,  আবারও   বলছি  উপশমের  মতো  কাজ  করবে  এই অঞ্চলের  পর্যটন ব্যবস্থাই   এ রকম  যে    যথোচিত    সোশ্যাল   ডিসট্যানসিং  মেনে  তা  এনজয়  করা  সম্ভব   লকডাউনের  ফলে  ঘরবন্দী   লোকজন  হাঁপিয়ে  উঠেছে কোভিড  ১৯  জনিত  উৎকণ্ঠা, ভয়   এবং  তারপরে  অবসাদ  চেপে  বসেছে  অনেকের  মনে  মিডিয়ায়  দেখেছি  বিশ্বের  এই  সংকটকালীন  পরিস্থিতিতে  ঘরবন্দী    অনেকেই    মানসিক ব্যাধিতেও  আক্রান্ত   হচ্ছেন   সবাই  চাইছে এমন  পরিস্থিতির  অবসানে  একটু  হাঁপ  ছেড়ে  বাঁচতে  উন্মুক্ত  সবুজ  প্রকৃতির  সান্নিধ্য  ছাড়া  এমন  দমবন্ধকর  পরিস্থিতি  থেকে  উত্তরণ  সম্ভব  কীসে  যথোচিত  সোশ্যাল  ডিসট্যান্সিং  মেনে    এই  সময়ে  ওয়াইল্ড  লাইফ  ট্যুরিজম, অ্যাডভেঞ্চার  ট্যুরিজম,  নেচার  ট্যুরিজম,  টি ট্যুরিজম,  মনসুন  ট্যুরিজম    এনজয়  করা  সম্ভব  আর  এমন  সব  ট্যুরিজমের  জন্যই  উত্তরপূর্ব  ভারত  বিখ্যাত  এ ছাড়াও  রয়েছে  ট্রেকিং, মাউন্টেনারিং, বার্ড  ওয়াচিং  মতো মতো  ব্যবস্থা  বলাবাহুল্য, স্ট্রেস  আর  টেনশন  থেকে  মুক্তি  পেতে  এর চাইতে  ভালো  কিছু  আর  হতে  পারে  না কোথাও  সেই  হই হই  করে  দলেপালে  যাওয়ার  প্রশ্ন  নেই ভিড়ভাট্টা  নেই চীৎকার  চেঁচামেচি  নেই   এ শুধুই   পাখির  কলতান,  ঝর্ণার  উচ্ছ্বল  সুরতান,  ঝিঁঝিঁর  কনসার্ট  শুনতে  শুনতে  প্রকৃতির  নিবিড়  সান্নিধ্য  উপভোগ  করা   এর  চাইতে  আর  কী  বড়  উপায়  হতে   মানসিক  অবসাদ কাটানোর !      আমি  তো  খুবই  আশাবাদী     এই   কারণে যে   কোভিড  ১৯এর  উত্তরকালে     উত্তরপূর্ব   এ দেশের  পর্যটন মানচিত্রে  আরও   উজ্জ্বল  হয়ে  উঠবে এই অঞ্চলের    রাজ্য  সরকারগুলিও  নিশ্চিত  সেই  লক্ষ্যেই  এগোচ্ছে 
ননীঃ  কোভিড ১৯ উত্তরকালে  তবে উত্তরপূর্ব ভারতের  পর্যটন শিল্পের  ক্ষেত্রে  হতাশ  হওয়ার মতো  কিছু  নেই   সম্ভাবনা    আরও  উজ্জ্বল  হবে  বলেই  মনে  হচ্ছে  এই    আশাবাদের  কথা   বাস্তবায়িত  হোক এতেই  এই    অঞ্চলের  মঙ্গল
শঙ্খশুভ্রঃ  হ্যাঁ  এখন  অনলাইনের   মাধ্যমেও  আমরা  ব্যাপক  প্রচার  চালাচ্ছি  পর্যটন  মন্ত্রণালয় অনলাইনে ‘’দেখো  আপনা  দেশ’’ বলে  ভারতের  বিভিন্ন  দর্শনীয়  স্থানগুলির  কথা  তুলে  ধরছে   ওয়েবিনারের   মাধ্যমে  উত্তরপূর্বের  পর্যটনকে   প্রসারিত  করার  চেষ্টা  চলছে   উত্তরপূর্বের   বহু   সুন্দর     এবং  ইন্টারেস্টিং  পর্যটন  ক্ষেত্র   রয়েছে    অথচ   সেসব  তেমন  প্রচারিত  নয়   যেমন    ধরো  পবিতোরা  ওয়াইল্ড  লাইফ  স্যাংচুয়ারি  কাজিরাঙ্গার  কথা  সবাই  জানেন কিন্তু   খুব  সুন্দর   পবিতোরা ওয়াইল্ড  লাইফ  স্যাংচুয়ারির   কথা  তেমনটা   সবার  কাছে  সেভাবে  পৌঁছায়নি  কিন্তু   এই  সময়ে  আমি    উত্তরপূর্বের  এমন সব অঞ্চল  নিয়ে   ইংরেজি   পত্র পত্রিকায়  ক্রমাগত   লিখছি    পাঠকদের  সাড়াও  পাচ্ছি  বেশ  ভালোই  আজকাল  তো   বহুল  প্রচারিত   সব   পত্রপত্রিকারই  অন লাইন  সংস্করণ  রয়েছে  বিশ্বের  সর্বত্র পাঠকেরাও  তাই  পড়ার সুযোগ  পাচ্ছেন  এই  রীচ আউটের  ব্যাপারটা  কম  নয়  
ননীঃ    আপনার   তাহলে    ব্যস্ততার  মধ্যেই  দিন কাটছে   নিজের  লেখালিখিও   পুরো দমে  চলছে?   এরই  মধ্যে  অঞ্চলের   বাংলা  পত্রপত্রিকাতেও   আপনার  বেশ  কয়েকটি  লেখা   দেখলাম
শঙ্খশুভ্রঃ   লেখালিখিটা  তো  আমার  প্যাশন  আমার    মূল  অঙ্গীভূত   সত্তা    এ ছাড়া  বাঁচি  কী ভাবে !  সব  ছাপিয়ে  আমার  লেখক কবি  সত্তাটাই  বড়
ননীঃ  হ্যাঁ,  আমাদের   কাছে  কিন্তু  আপনার  লেখক  কবি  পরিচয়টাই  আসল আপনি  আমাদের  ঘরের  মানুষ  আপনাকে    কিন্তু  আমরাও  এইভাবেই  দেখতে  ভালবাসি 
শঙ্খশুভ্রঃ   লেখক কবি  হিসেবে   পাওয়া  মানুষের  এই  ভালবাসাটাই  আসল
ননীঃ    দূরদর্শনের  ন্যাশনেল নেটওয়ার্কে   আপনার  উপন্যাসের     সিরিয়াল,  ত্রিপুরার  সরকারের  পুরস্কার,  বিশ্ববিদ্যালয়ে  আপনার  বই  পাঠ্যক্রম  হিসেবে  পড়ানো  -  আপনার  কী  মনে  হয়  না    পরিকাঠামোহীন উত্তরপূর্ব  ভারতের  একজন  আঞ্চলিক ভাষার  কবি সাহিত্যিক  হিসেবে  এই  অ্যাচিভমেন্ট  অনেকখানি?
শঙ্খশুভ্রঃ  এসব  ভেবে  লেখালিখি  তো  করি নি কিম্বা  এখনও  করছি না  সৃজনশীলতার  আনন্দটাই  আসল  বাকি  সব তুচ্ছ 
ননীঃ  আপনার  লেখালিখির  প্রেক্ষাপট তো  সবই  ত্রিপুরা  তথা  উত্তরপূর্ব  ভারত
শঙ্খশুভ্রঃ  হ্যাঁ  আমি এই  অঞ্চলের  ভূমিপুত্র  এই  অঞ্চলকে  আমি  যেমনভাবে  জানি  কিম্বা   চিনি   অথবা  যে  ভাবে   নিজেকে  আইডেন্টিফাই  করতে  পারি -  অন্য    কোনও অঞ্চলের  কথা  আমি  সে রকমভাবে  বলতে পারবো না  লিখলে  তো   স্বভূমির  কথাই  লিখবো     সাহিত্য ভাবনা  আসলে    স্বতঃস্ফূর্ত  এবং  স্বতোৎসারিত; নিজের  অঞ্চল,  মাটি, মানুষ, সংস্কৃতিকে   জানতে  না  পারলে,  না বুঝতে  পারলে   এই  ভাবনা সম্ভব  নয়   
ননীঃ  উত্তরপূর্ব ভারতের  বেশিরভাগ   বাংলা ভাষার  সাহিত্যিকদের কলমে   আজও  তাঁদের   নিজ  অঞ্চলের  কথা   তেমনভাবে  উঠে আসছে  না ব্যাপারটা  বিস্ময়কর  নয়  কি?
শঙ্খশুভ্রঃ  আমার  মনে হয়   দেশভাগের   পর   কয়েক  যুগ  কেটে  গেলেও    উত্তরপূর্ব  ভারতের   বেশির  ভাগ   বঙ্গভাষী  এই  অঞ্চলের  সঙ্গে  আজও  তেমনভাবে   নিজেদের  একাত্ম  কিম্বা আত্তীকরণ  করতে  পারেন নি    কলকাতা,    ঢাকার প্রভাব   ওঁদের  জীবনে  অমোঘ এবং  অপরিসীম   বঙ্গভাষী  বলেই  সম্ভবত  এই  ঘটনা  ঘটে চলেছে  কলকাতা কিম্বা  ঢাকার  গণ মাধ্যম   মানে  টেলিভিশন  এবং  পত্রপত্রিকা  পড়ে   এখানকার  বঙ্গভাষীরাও  প্রভাবান্বিত  হন কলকাতায়  ঝড়বৃষ্টির  খবর  দেখে শুনে  এই অঞ্চলের  বঙ্গভাষীরাও ফেসবুকের  মতো  গণমাধ্যমে  তুমুল  আলোচনায়  মেতে  উঠেন  কলকাতা  কিম্বা  ঢাকার  সঙ্গে  এই  আইডেন্টিফিকেশনটা  এখানকার বঙ্গভাষীরা   হামেশাই   খুঁজে  পান  ত্রিপুরা  কিম্বা  উত্তরপূর্ব  ভারতের  কোথাও  প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে  কলকাতা  অথবা  ঢাকার  মানুষ   সে সব  নিয়ে  আলোচনা করেনও না করার  তেমন দরকারই  বা  কী  কেননা  এই  অঞ্চলের   বঙ্গভাষীদের  সঙ্গে  তাদের  আইডেন্টিফিকেশনের কোনও  প্রয়োজন   নেই; মানে  গুরুত্ব  নেই  উত্তরপূর্ব  ভারতের  বঙ্গভাষীরা কিন্তু  সেই   আইডেন্টিফিকেশনের  মরীয়া  চেষ্টা  চালায়  প্রতিনিয়ত  পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের  সঙ্গেই    অথচ  পাশের  রাজ্য  মণিপুর  কিম্বা  মিজোরামে  বন্যা  হলেও  তার  খোঁজখবর কেউ  প্রায়  রাখেন না  আগ্রহও  দেখা  যায় না   অরুণাচল প্রদেশ   কিম্বা  নাগাল্যান্ড   একই  অঞ্চলের  অন্তর্ভুক্ত  হওয়া  সত্বেও  এখানকার    বঙ্গভাষীরা  তবু  কলকাতার  সঙ্গেই   একাত্ম হতে   ভালবাসে  ভাষা  এখানে  একটা  বড়  ফ্যাক্টর  কিন্তু   একথা   ঠিক  পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের  সঙ্গে  উত্তরপূর্ব  ভারতের   বঙ্গভাষীদের   যতটা  মিল  -  ঠিক  অমিল  রয়েছে  ততোটাই  ভাষা  বাংলা হলেও  পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের  তুলনায় এই  অঞ্চলের  বঙ্গভাষীদের  উচ্চারণ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনচর্যা, প্রাকৃতিক  পরিবেশ  একেবারে  সম্পূর্ণভাবে   ভিন্ন  এই  ভিন্নতারই  আর  এক নাম  বৈচিত্র্য  এই  বৈচিত্র্যই  যে   উত্তরপূর্ব  ভারতের  বঙ্গভাষীদের  শক্তি  -  এই   সত্য  উপলদ্ধি  করতে  না পারলে  আত্ম বিকাশের  সম্ভাবনা  বিরহিত  হয়  সৃজনশীলতাও  মার  খায়;    মৌলিকতাহীন  হয়ে  পড়ে     এই  অঞ্চলের  বাংলা   সাহিত্যেও  একই  ঘটনা  ঘটছে 
ননীঃ  উত্তরপূর্ব  ভারতের  বাংলা সাহিত্যের  এই  মৌলিকতার  দিকটি  নিয়ে  যে  আপনি  খুবই  চিন্তাভাবনা  করেন  তা  আপনার  শিলঙে  পোস্টেড  থাকার  সময়েই  লক্ষ্য  করেছি  মনে  আছে  নর্থ ইস্ট  হিল  ইউনিভার্সিটির  ইংরেজি  বিভাগ  থেকে  প্রকাশিত  ‘’আন এনথোলজি  অব  পোয়েট্রি  অব  নর্থইস্ট’’ বইটির  ওপর   সামগ্রিক    আলোচনা  করতে  গিয়ে   সেদিন  কী  বলেছিলেন আপনার  সেই  বক্তব্য  কিন্তু  ভাবিয়েছিল  আমাদের 
শঙ্খশুভ্রঃ ‘’আন এনথোলজি  অব  পোয়েট্রি  অব  নর্থইস্ট’’   বইয়ে  উত্তরপূর্ব  ভারতের  আটটি রাজ্যের    কবিদের  নির্বাচিত   কবিতা  ছিল   উত্তরপূর্ব  ভারতের  বিভিন্ন ভাষাভাষীদের  অনূদিত  ইংরেজি  কবিতা একটা  ব্যাপার  লক্ষ্য  করেছিলাম  সব  কবিতাতেই  মর্মরিত হয়েছিল ভুমিপুত্রকন্যাদের     বিষণ্ণতা আর   আক্ষেপ  ওইসব  কবিতায়  উচ্চারিত হয়েছিল ভূমিচ্যুতদের  বঞ্চনা,  নির্বিচার অরণ্য ধ্বংস   আর  পশুপাখি  নিধনের  বিষাদমালা,  নগরায়নের  নামে  প্রকৃতি পরিবেশের  অবদমন,   বিচ্ছিন্নতাবাদী  আন্দোলনের  নামে  সন্ত্রাসবাদীদের  তান্ডব,  পুলিশ  মিলিটারির    ভারী  বুটের শব্দ,   রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস  কিন্তু  এদের  মধ্যে সর্বার্থেই  ব্যতিক্রম  ছিল  ত্রিপুরার  কবিতা  ত্রিপুরার  কবিদের  ওইসব  কবিতায়   সন্ত্রাস কবলিত   উত্তাল   উত্তরপূর্বাঞ্চল  কিম্বা  রাজ্যের   সেই  সময়ের  কথা  পুরো  অনুল্লেখিত  কনটেন্ট  এইসব  কবিতায়  অনুচ্চারিত উপেক্ষিত  মাটির  কথা,  জনজাতিদের  কথা, মিশ্র  সংস্কৃতির  বিষয় কলকাতার  অনুকরণে  এই  কবিতাগুলি  নিছক  ফর্ম সর্বস্ব   তখনই   মনে  হয়েছিল,   অঞ্চলের  বাংলা  সাহিত্যের  ক্ষেত্রে  কোথাও  একটা  বিভ্রান্তি ঘটছে  আর  এই   বিভ্রান্তির  ফলে   -    না হচ্ছে    আমাদের  অঞ্চলের  বাংলা  সাহিত্যের  মৌলিকতা,  না  হচ্ছে  কলকাতা  কিম্বা  ঢাকার  সার্থক  অনুসরণ এ ছাড়া  আমাদের  বাংলা   সাহিত্য  নিয়ে  কলকাতা  কিম্বা  ঢাকার    আলাদা  আগ্রহই  বা থাকবে কেন ওরা  তো  ধরেই  নিয়েছে  আমাদের  অঞ্চলের  বাংলা সাহিত্য  আদতে  কলকাতা, ঢাকা  বিস্তৃত  প্রচ্ছায়া  মাত্র  ঘটনাটা সত্যি  এবং  এই  অবস্থার  জন্য  আমরা  নিজেরাই  দায়ী কলকাতা,   ঢাকার  কবি সাহিত্যিকদের  আমরা  আত্মীয়  বলে  মনে করি ওদের অনুসরণ  করার  চেষ্টা চলে  নিরন্তর  কলকাতা, ঢাকার পত্রপত্রিকায়  লিখতে  পারলে  নিজেদের  ধন্য  মনে করি  অথচ  নিজের  অঞ্চলের ... উত্তর পূর্বাঞ্চলের  কবি  সাহিত্যিকদের  কথা   জানি না  বললেই  চলে  মামাং  দেই, তেনসুলা  আও, নংকেনরি  মতো  খ্যাত  কবি   সাহিত্যিকদের  কথা  অজানাই রয়ে  যায়!   স্বভূমির  সৌরভ        উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যে   বিকশিত    না হলে  মৌলিকত্বের আশা  অসম্ভব
ননীঃ তার  মানে  আপনি  এই কথাই  বলতে  চাইছেন,  পশ্চিমবঙ্গ  কিম্বা  বাংলাদেশের  পরিসীমার  বাইরে  উত্তরপূর্বের  বঙ্গভাষীদের   সচেতনভাবেই  নিজেদের  স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে  তোলা  দরকার !  মানে  উত্তরপূর্বের  বঙ্গভাষীরাও   এই  অঞ্চলের  সমৃদ্ধ  সংস্কৃতির  অংশীদার,    ঐতিহ্যবাহী  মিশ্র  সংস্কৃতির  ধারকবাহক  তাই  তো !
শঙ্খশুভ্রঃ অবশ্যই আমার  ছোটগল্প,    উপন্যাসে  মিশ্র  সংস্কৃতির  কথাই  বারবার তুলে  ধরার  চেষ্টা করি জনজাতিদের  কথা  বলার  চেষ্টা করি
 ননীঃ  আপনার  কবিতার  বই  সমাহিত  মেঘধুলি, খুমপুই;  ছোটগল্পের  সংকলন অরণ্যে  প্রেম নেই,   বৈনারী  এবং  বনকুন্তলার  উপাখ্যান, জতুগৃহের  পাখি, ত্যুই, মেঘবতীর মতো  উপন্যাস   নিঃসন্দেহে উত্তরপূর্ব  ভারতের  বাংলা সাহিত্যের  উল্লেখযোগ্য  সম্পদ  এসব লেখায়  ফুটে  উঠেছে  মিশ্র  সংস্কৃতি, জনজাতিদের  জীবনচর্যা,  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভাষ্য  ত্যুই,  মেঘবতী  মতো  উপন্যাসে  ফুটে  উঠেছে  প্রকৃতি  পরিবেশ  ভাবনা  বিলুপ্তপ্রায়  বন্যপ্রাণীদের  সংরক্ষণের  কথা
শঙ্খশুভ্রঃ  উত্তরপূর্ব  ভারতের  বাংলা সাহিত্যের  উল্লেখযোগ্য  সম্পদ  কিনা  জানি না  আমি  চির  ক্ষুধার্ত, অতৃপ্ত  আমায়  লিখতে  হবে  আরও  হাঁটতে হবে  আরও বহু পথ
ননীঃ  সাহিত্যের  খোঁজখবর রাখে,   সাহিত্য  নিয়ে  পড়াশোনা করে  সাহিত্যচর্চাকারী  এমন   উত্তর পূর্বাঞ্চলের    উঠতি প্রজন্মের  ছেলেমেয়েরা  কিন্তু  আপনার  লেখালিখির  বিষয়ে  যথেষ্ট  আগ্রহী  এটা  তো  মানেন! 
শঙ্খশুভ্রঃ   হ্যাঁ, এ আমার  কাছে  স্বস্তির বিষয় যে  আমি  উঠতি প্রজন্মের  সঙ্গে  কানেক্ট করতে  পারছি ওরা আমার   ছোট গল্প,   উপন্যাস  নিয়ে   বিশ্ববিদ্যালয়ে  বিভিন্ন প্রকল্প  তৈরি করছে; গবেষণার  বিষয় হিসেবে   বেছে  নিচ্ছে  এসবই  আমার  সাহিত্য জীবনের  বড় প্রাপ্তি  এবং স্বীকৃতি
ননীঃ নারী  মহলে  আপনার  জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত জনশ্রুতি  আছে নারীরা   আপনাকে লিপস্টিক  লাগানো  ঠোঁটের  ছাপ   দিয়ে     চিঠি   পর্যন্ত   দিয়েছে
শঙ্খশুভ্রঃ (হাসি) সৃজনশীল মানুষদের  জীবনে  এসব  ঘটেই  থাকে   নতুন কী  আর !  এসব  অস্বাভাবিক কিছু  নয়
ননীঃ   আমাদের  কাছে  খবর  ছিল আপনি  সাহিত্যকৃতির জন্য  একটি সর্ব ভারতীয়  মিডিয়া  হাউসের (বাংলা নয়) অত্যন্ত  প্রেস্টিজিয়াস  পুরস্কার পাচ্ছেন
শঙ্খশুভ্রঃ খবরটা  সত্যি   এ বছর   মার্চের ২৮  তারিখ গুয়াহাটির  একটি  পাঁচ  তারকা  হোটেলে  অনুষ্ঠানের  কথা  ছিল কিন্তু  এরমধ্যেই  লকডাউন হয়ে  যাওয়ায় সব   ভেস্তে  গেল   তবে  এতে  দুঃখ  নেই  কোভিড ১৯ সংক্রমণ জনিত  কারণে  দেশে যে  অচলাবস্থার  সৃষ্টি  হয়েছিল  তার    সবচেয়ে  বিরূপ  প্রতিক্রিয়ার  শিকার  দেশের  অসংখ্য  পরিযায়ী  শ্রমিক   ওদের দুরাবস্থা,  পথেঘাটে  অসহায়  ক্ষুধার্ত  মানুষগুলির  মৃত্যু  হৃদয় বিদারক কোভিড  ১৯  ভয়াবহতা  আগামী  দিনে   থাকবে  না লোকে ভুলেও  যাবে অতিমারির  কথা  কিন্তু  পরিযায়ী শ্রমিকদের  দুরাবস্থার  কথা  দুঃস্বপ্নের  মতো  আগামী দিনেও  মনে ভেসে  উঠবে  এ এক  চিরস্থায়ী  ক্ষত  কোভিড  ১৯    বৈশ্বিক  অতিমারিতে  কমবেশি  ক্ষতিগ্রস্থ  সবাই  হয়েছে  কোনও না  কোনও ভাবে  কিন্তু  আমাদের  দেশের  পরিযায়ী   শ্রমিকদের  হেনস্থা  আর  দুরাবস্থার  তুলনায়  বাকি  সবই  তুচ্ছ  বলে  মনে হয়
ননীঃ   শেষ প্রশ্ন -  এতো  ব্যস্ততার মধ্যেও  আপনি  সময় বের করে  লিখেন  কী ভাবে ! 
শঙ্খশুভ্রঃ এই  প্রশ্ন আমাকেই অনেকে করেন  সবাইকে  একটা কথাই  বলি, প্যাশন  আর  প্লট মাথায়  ঘুরছে বলেই  শত  ব্যস্ততার  মধ্যে   লিখতে  পারছি   এই  প্যাশন   আর  প্লট    ফুরিয়ে    গেলে  লেখাও  আর  বেরোবে  না   সেদিন হয়তো অখন্ড  অবসরের মধ্যে  দিন কাটবে কিন্তু  প্যাশন  আর প্লটের  অভাবে  এক লাইনও   লেখা  সম্ভব  হবে  না   জোর করে  লিখতে  গেলে  তা-   নিজের  পুরোনো  লেখার  পুনরাবৃত্তি  হবে  শুধু  এ রকম প্যাশন আর প্লট  হারিয়ে  শেষ পর্যন্ত  কত  সৃজনশীল  ব্যক্তিকে   দেখেছি  পুনরাবৃত্তির  জালে  জড়িয়ে পড়ছে !   এ এক  ভয়াবহ  অবস্থা   এমন অবস্থা যেন কোনও  সৃজনশীল  ব্যক্তিরই  না হয় আমি  তো  এখনও লিখে  চলেছি যেদিন বুঝতে  পারবো  পুনরাবৃত্তি      আমায়  গ্রাস  করছে;  ফেঁসে  যাচ্ছি   -  কলম  উঠিয়ে  নেবো  সেদিন  

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.