Header Ads

পজিটিভ সংখ্যা বৃদ্ধি ও পরিযায়ী শ্রমিক !!


বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ

হ্যাঁ, করোনা আক্রান্তের ব্যাপক সংখ্যাবৃদ্ধিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে রাজ্যে হটস্পট থেকে ফিরে আসার একটা বড় ভুমিকা রয়েছে--তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। গত ১ মে থেকে--অর্থাৎ এক মাস আগে থেকেই বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে নিজের নিজের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের যখন ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করছে অন্যান্য রাজ্যগুলো তখন পশ্চিমবঙ্গের নোডাল অফিসার মাত্র দুটি ট্রেনে রাজস্থানের আজমেঢ় এবং হায়দ্রাবাদ থেকে এ রাজ্যের ‘‘তীর্থযাত্রী’’দের ফিরিয়ে এনে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলেন ! হরিদ্বার সহ উত্তরাখণ্ডে আরও প্রচুর তীর্থযাত্রী আটকা পড়ে চরম দুর্দশার মধ্যে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে চিকিৎসা করতে যাওয়া প্রচুর অসুস্থ মানুষ শ্রমিক ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন তাদের কথা ভেবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার ও রেলমন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ফিরিয়ে আনার কী বিপুল মানবিক প্রচেষ্টা করা হয়েছিল তা এখন সকলেরই জানা।
অর্থমন্ত্রী সীতারমণ পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যসরকারগুলিকে কি কি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল এবং রাজ্যগুলির জন্য কত টাকা বরাদ্দ করেছিল তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছিলেন--অনেকেই তা শুনতে পান নি ! সীতারমণ মিথ্যা কথা বলছেন এমন অভিযোগ অন্য কোনও রাজ্য করে নি। ১ মে থেকে রেলমন্ত্রক বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর ট্রেন এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ছুটে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে তখনও কোনো ট্রেন আসে নি--ট্রেনের রিকুইজেশন ডিমাণ্ডকে কেন্দ্র করে ‘তুই থুলি না মুই থুলি’ পালাগান শুরু হয়েছিল প্রবল বেগে ও
আবেগে !
ইতিমধ্যে গড়াতে গড়াতে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে যাওয়ার ফাঁকে উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় এবং গভীর অনিশ্চয়তায় অস্থির হয়ে ওঠা শ্রমিকদের দুর্দশা বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যা সঠিকভাবে বর্ণনার ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। হটস্পট হিসেবে ততদিনে মহারাষ্ট্র-গুজরাট-তামিলনাড়ু-রাজস্থান রাজ্যগুলো করোনা আক্রান্ত মানচিত্রে লাল রঙে নিজেদের রাঙিয়ে ফেলেছে--আর সেখানেই পরিযায়ী শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়েছে এবং তাদের সেই আন্দোলনে সামাজিক দূরত্ব জ্ঞান ছিল না--মুখে মাস্ক ছিল না--ফলে অনিবার্য্যভাবেই তাদের অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ফেরার আগে থেকেই। তারা ট্রেনে চেপেছেন--দল বেঁধে স্টেশনে নেমেছেন (কি ভাবে এসেছেন তার বর্ণনা দিতে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানির স্মৃতি ভেসে উঠবে)--কোথাও কোথাও তাদের কপালে জ্বর মাপার বন্দুক ঠেকিয়ে বলা হয়েছে--বাড়ি গিয়ে ১৪ দিন ঘরে থাকবে ! তাদের মধ্যে কত হাজার মানুষ উপসর্গহীন ক্যারিয়ার হিসেবে চেইন সিস্টেমে আরও কত হাজার বা লক্ষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে গেল তার কোনো ডেটা কোনোদনিই পাওয়া যাবে না।
যারা চাইছিলেন বা ভাবছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকরা এখন ফিরবেন
না--তারা সেটা ভাবছিলেন ‘রাজনৈতিক মানবিকতা’র অবস্থান থেকে অত্যন্ত অমানবিকভাবেই। প্রচণ্ড দুঃসময়ে তাদের তো নিজের ভিটেমাটিতে ফিরতেই হবে ! শুধু ভোটের সময়ে তারা ভোট দিয়ে যাবেন আর তার পর তাদের ভিটেমাটি সংসার পরিজন ভুলে মহাসঙ্কটকালেও হটস্পট রাজ্যে দেহত্যাগ করবেন--এটা তারা মেনে নেবেন কেন? তাদের থাকা-খাওয়া ফিরিয়ে আনার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা তো সংশ্লিষ্ট রাজ্যকেই নিতে হবে। কেন্দ্র রেলের ব্যবস্থা করবে, টাকার ব্যবস্থা করবে--এর বাইরে গিয়ে রাজ্যে রাজ্যে কিছু করার বা রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ কি কেন্দ্রের আছে? রাহুলবাবা, মহঃ সেলিম, সুজন চক্রবর্তীরা যদি ক্ষমতায় থাকতেন তাহলে যা একেবারেই করতে পারতেন না (ক্ষমতায় থেকেও করেন নি) তা কেন কেন্দ্র করছে না এই অভিযোগে মেদিনী কাঁপাচ্ছেন ! ক্ষমতায় থাকলে কতদূর কি করা যায় তা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এই মহাসঙ্কটকালে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তাদের বিরোধীরাও রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের পিণ্ডি চটকে চলেছে--এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন তারা ক্ষমতায় থাকলে ভারতবর্ষে করোনা ঢুকতোই না--ঢুকলেও কেউ আক্রান্ত হতো না--হলেও একজনও মারা যেত না !
গোটা বিশ্বের মধ্যে একমাত্র চীন প্রাক্ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল বলে তারা নিজেদের সামলে নেওয়ার অত্যন্ত সফল নাটক প্রদর্শন করতে পেরেছে। পারে নি ইতালী-ফ্রান্স-বেলজিয়াম-জাপান-বৃটেন-রাশিয়া-ইরান--এমন কী আমেরিকাও ! করোনা ভাইরাস এতটাই আকস্মিকভাবে এবং অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তার প্রকোপ থেকে বাঁচার ব্যবস্থা নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় কারুর হাতেই ছিল না। দ্রুত লকডাউন ঘোষণা করতে হয়েছে--কারণ কয়েক ঘন্টা দেরি হলে যে কতটা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে তার কোনো ধারণাই সূচনাপর্বে কোনো দেশেরই ছিল না। সেখানে ভারতের ধারণা থাকবে--যথেষ্ট সময় নিয়ে গালগপ্পো করে ধীরে সুস্থে ব্যবস্থা নেবে এ ভাবনার মধ্যে কোনোরকম পাণ্ডিত্য যেমন নেই ছিটেফোঁটা বিবেচনাবোধও নেই। গোটা দেশের কথা ভেবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। সেইসব পদক্ষেপ গ্রহণের আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনাও করা হয়েছে প্রতিবার। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের গাইডলাইন মেনে ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর যেসব রাজ্য গুরুত্ব দিতে পেরেছে তারা তাদের রাজ্যকে হটস্পট হতে দেয় নি। কেন্দ্রের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে রাজ্যের মানুষের স্বার্থে--যা এই মহাসঙ্কটকালে অত্যন্ত জরুরি ছিল। নিরবিচ্ছিন্ন দোষারোপের রাজনীতির সঙ্গে ইগোর লড়াই যে পরিণতির দিকে রাজ্যবাসীকে টেনে নিয়ে যেতে পারে সেই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু রাজ্য।
আমি মাস দু’য়েক আগে থেকেই বাংলা তথা উত্তরবঙ্গ--বিশেষ করে কোচবিহার নিয়ে তীব্র আশঙ্কা প্রকাশ করে এসেছি। কারণ, আমার কাছে নানান ধরণের খবর আসছিল--অপরীক্ষিত উত্তরবঙ্গ যে মহাসঙ্কটে পড়তে চলেছে তা আমি বার বার বলে এসেছি। দিন পনের আগেও কোচবিহার নিয়ে মহা আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছিলাম। এই মাথাভাঙ্গা মহকুমা সম্পর্কেও বার বার ইঙ্গিত দিয়েছি। কারণ আমি জানতাম--মাথাভাঙ্গা মহকুমাও রহস্যময় চাদরের নিচে ঢেকে রাখছে মহা অশনি সঙ্কেত ! সবকিছু যারা উড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত--দোষারোপের রাজনীতিতেই নিজেদের কেলোয়াত প্রমাণে অভ্যস্ত তারা নিজেরাও সময় থাকতে সচেতন হয় নি--সাধারণ মানুষকেও সচেতন করে নি। তথাকথিত ‘শিক্ষিতমুর্খ স্তাবক’-এর দল প্রতিদিন বড় বড় লেকচার ঝেড়ে শুধু বিপদই বাড়িয়ে গেছে ! কারণ তারা এই বিশ্বাসেই অটল ছিল যে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরবে না--ফিরলেও তারা করোনা ভাইরাস ছড়াবে না। ছড়ালেও জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে--কারণ, উন্নয়নের এই মহাযজ্ঞের রাজ্যে এইসব ভাইরাস-ফাইরাস তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ওস্তাদ করিগরের অভাব নেই কোথাও। ধমক-চমক-হুমকিতেই কেঁপে যাবে করোনা ভাইরাস !
কিন্তু বাস্তবের ছবিটা ভীষণরকমের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। পাঁচহাজার নমুনা পাঠালে এক হাজার রিপোর্ট আসতে আসতে কোয়ারেন্টাইনের ১৪ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে--কপালে জ্বর মাপার বন্দুক ঠেকিয়ে ‘ওকে’ বলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে এবং রিপোর্ট এলে দেখা যাচ্ছে তাদের ৮০%-ই কারোনা আক্রান্ত। তারপর কি হচ্ছে বা হতে চলেছে--ওস্তাদ রাজনৈতিক বাচালরা ভাবতে না পারলেও সাধারণ অজ্ঞ-মুর্খ মানুষমাত্রেই বুঝতে পারছে ! অপেক্ষার হিমশীতল প্রবাহের মধ্যে তারা নির্বাক্ হয়ে যাচ্ছে। কে কোথায় পা রাখবে--কোথায় থাকছে নির্ভেজাল নিশ্চয়তা--জবাব দেবার কেউ আশেপাশে কিন্তু নেই !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.